প্লাজমা থেরাপি নিয়ে যত কথা

>
করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি এখনো পরীক্ষামূলক পদ্ধতি
করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি এখনো পরীক্ষামূলক পদ্ধতি
‘কনভালসেন্ট প্লাজমা থেরাপি’ এখন বেশ আলোচিত বিষয়। করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় এই প্লাজমা থেরাপি কতটা কার্যকর? শর্তই–বা কী এই থেরাপির?

প্লাজমা হলো রক্তের জলীয় উপাদান। বাংলায় বলা হয় ‘রক্তরস’। প্লাজমাতে থাকে নানা দরকারি প্রোটিন, রক্ত জমাট বাঁধার প্রয়োজনীয় ফ্যাক্টর আর থাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন, যাকে আমরা অ্যান্টিবডি বলি।

কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে যাওয়া মানুষের শরীরে বিশেষ অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যা এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে। সেই অ্যান্টিবডিকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে সুস্থ হয়ে যাওয়া ব্যক্তির শরীর থেকে প্লাজমা নিয়ে আক্রান্তের দেহে পরিসঞ্চালন করা হয়। আশা করা হয় যে পরিণত অ্যান্টিবডি নতুন আক্রান্ত গ্রহীতার দেহে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে। এটি একধরনের ‘প্যাসিভ ইমিউনিটি’।

১৯১৮ সালে প্রথম স্প্যানিশ ফ্লু থেকে শুরু করে একালে ইবোলা, সার্স ও মার্সে প্লাজমা থেরাপি ব্যবহার করা হয়। করোনাভাইরাসে প্লাজমা থেরাপির ব্যবহার শুরু হয় চীন থেকে। এরপর পরীক্ষামূলকভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ অনেক দেশে অনুমোদন পাওয়ার পর এখন বাংলাদেশেও চলছে।

তবে মনে রাখা দরকার, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় এখনো সবকিছুই পরীক্ষামূলক বা ট্রায়াল। পূর্ববর্তী ট্রায়ালগুলো থেকে এখন পর্যন্ত খুব আশাব্যঞ্জক কিছু পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও কোভিড-১৯ সংক্রান্ত তাদের চিকিৎসা নীতিমালা থেকে প্লাজমা থেরাপি তুলে নিয়েছে। তবে পরীক্ষামূলক ব্যবহার চলতে পারে বলে জানিয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য এবং ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ) অবস্থানও তাই।

কারা প্লাজমা দিতে পারবেন

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন এমন যেকোনো ব্যক্তিই হতে পারেন সম্ভাব্য প্লাজমা ডোনার বা প্লাজমাদাতা। আগে কোভিড-১৯ পজিটিভ ছিলেন আর এখন পরপর দুবার নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ প্রমাণিত হয়েছেন এবং নেগেটিভ হওয়ার পর কমপক্ষে ১৪ দিন (কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২৮ দিন) কোনো উপসর্গ দেখা দেয়নি এমন ব্যক্তিই হতে পারেন প্লাজমাদাতা। প্লাজমা দানের আগে নিশ্চিত হতে হবে যে তাঁর শরীরে যথেষ্ট মাত্রায় অ্যান্টিবডি উৎপাদিত হয়েছে কি না। এ জন্য অ্যান্টিবডি টাইটার পরীক্ষা করা হয়। আমাদের দেশের নীতিমালা অনুযায়ী ১: ১৬০ টাইটার হলে প্লাজমা থেরাপির জন্য উপযুক্ত বলে ধরা হয়। রক্ত পরিসঞ্চালনের অন্যান্য শর্ত যেমন রক্তবাহিত রোগের (সিফিলিস, ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস, এইচআইভি ইত্যাদি) উপস্থিতি, প্লাজমাদাতার ওজন, রক্তচাপ, গর্ভাবস্থা—এই বিষয়গুলো তো দেখতেই হবে।

একজন দাতার শরীর থেকে একবারে ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিলিটার প্লাজমা নেওয়া সম্ভব। অ্যাফেরেসিস যন্ত্রের মাধ্যমে বিশেষ প্রক্রিয়ায় দাতার শরীর থেকে পুরো রক্ত না নিয়ে শুধু প্লাজমা নেওয়া সম্ভব। একজন দাতার প্লাজমা দিয়ে তিন ইউনিট পর্যন্ত (প্রতি ইউনিট ২০০ মিলিলিটার) প্লাজমা বানানো যায়। দাতা চাইলে একবার প্লাজমা দেওয়ার পরের সপ্তাহে আবারও প্লাজমা দিতে পারবেন।

প্লাজমা দান করার পর ২৪ ঘণ্টায় তিন লিটার পানি পান করলেই এর অভাব পূরণ হয়ে যায়।

প্লাজমা নিতে পারবেন যাঁরা

নমুনা পরীক্ষায় কোভিড-১৯ আক্রান্ত প্রমাণিত হয়েছেন, অন্তত মাঝারি ধরনের উপসর্গ আছে (যেমন শ্বাসকষ্ট, অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯৩-এর নিচে ইত্যাদি) তাঁরা এই ট্রায়ালে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। মৃদু উপসর্গ বা মাইল্ড সিম্পটম এই ট্রায়ালের অন্তর্ভুক্ত নয়। যাঁদের আগে প্লাজমা বা অন্যান্য রক্ত উপাদান গ্রহণে অ্যালার্জির ইতিহাস আছে, তাঁরাও প্লাজমা নিতে পারবেন না।

ঝুঁকি আছে কি না

যেহেতু এটি পরীক্ষামূলক, তাই এতে রোগী বা রোগীর বৈধ অভিভাবকের লিখিত সম্মতির প্রয়োজন হয়। এটি যে পরীক্ষামূলক এবং আরোগ্যের নিশ্চয়তা দেয় না, এই বিষয়টিও পরিষ্কার করতে হবে।

প্লাজমা থেরাপিতে তেমন কোনো ঝুঁকি এখনো পাওয়া যায়নি। তবে রক্ত বা রক্ত উপাদান পরিসঞ্চালনের যেসব ঝুঁকি আছে, তা এখানেও প্রযোজ্য। যেমন অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া, রক্তবাহিত জীবাণু সংক্রমণ, পরিসঞ্চালনজনিত ফুসফুসের সমস্যা ইত্যাদি।

 ডা. গুলজার হোসেন, রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ