প্রযুক্তি হয়েছে সবার সঙ্গী

বয়স্ক কিংবা যাঁরা আগে প্রযুক্তি বেশি ব্যবহার করতেন না, এই সময়ে প্রয়োজন তাঁদের করেছে প্রযুক্তিমুখী। মডেল: মেহেদী হাসান, ছবি: খালেদ সরকার
বয়স্ক কিংবা যাঁরা আগে প্রযুক্তি বেশি ব্যবহার করতেন না, এই সময়ে প্রয়োজন তাঁদের করেছে প্রযুক্তিমুখী। মডেল: মেহেদী হাসান, ছবি: খালেদ সরকার

অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী। খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সুলেখক। প্রথম আলোর শুরু থেকেই লেখেন তিনি। আর লেখা পাঠান হাতে লিখে ডাকযোগে কিংবা সরাসরি। করোনাকালে তাঁর একটা লেখা লাগবে এই অধুনার জন্যই। ফোনে তিনি বললেন, লেখা তো লিখব কিন্তু পাঠাব কীভাবে। বললাম, লিখে ছবি তুলে মেসেঞ্জারে বা ই–মেইলে পাঠান। শুভাগত চৌধুরীর ফেসবুক আছে, তাতে সক্রিয়ও প্রায় ৭৪ বছর বয়সী এই অধ্যাপক। কথা বলার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মেসেঞ্জারে তিনি লিখলেন, ‘মেইল করেছি, গেছে?’

হ্যাঁ, শুভাগত চৌধুরীর ই–মেইল তখন এসেছিল। শুধু লেখার শিরোনাম দিয়ে। ওটা ছিল পরীক্ষামূলক, এরপর আরও দুটি মেইলে এল ইউনিকোডে টাইপ করা বাংলা লেখা। শুভাগত চৌধুরীর বই বেরিয়েছে ৬৭টির মতো। লিখে চলেছেন ছয় দশকের বেশি সময় ধরে। বললেন, ‘ফেসবুকে বাংলায় দু–চার লাইন স্ট্যাটাস বাংলায় লিখতাম। ইংরেজিতে ই–মেইলও লিখতাম। কিন্তু পুরো একটা লেখা বাংলায় লিখে এই প্রথম ই–মেইল করলাম।’ শুভাগত চৌধুরীর সেই লেখার শিরোনাম ছিল ‘নতুন স্বাভাবিক এল জীবনে’।

করোনাকালের নতুন শব্দযুগল ‘নিউ নরমাল’, বাংলায় নতুন স্বাভাবিক আমরা যাকে বলছি। জীবনযাপনের নতুন অভ্যস্ততায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছি আমরা। প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ছুটির দিনের জনপ্রিয় বিভাগ ‘আপনার রাশি’। এর লেখক কাওসার আহমেদ চৌধুরী অসুস্থতার জন্য দীর্ঘদিন কাগজে–কলমে লিখতে পারেন না। তিনি মুখে বলেন, একজন ল্যাপটপে টাইপ করে অফিসে পাঠিয়ে দেন। শ্রুতলিখন আরকি। মার্চ মাসে বাংলাদেশ করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর বাড়িতে বাইরের মানুষ যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। বিকল্প কী? উনি ফোনে বলবেন, আমরা কেউ লিখে নেব? তিনি ও পথে হাঁটলেন না। তাঁর ছেলের দেওয়া ট্যাবে মেসেঞ্জার খুলে একটা একটা করে রাশির কথা লেখেন আর পাঠাতে থাকেন। এভাবে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তৈরি হয়ে যায় ‘আপনার রাশি’।

নতুন স্বাভাবিক জমানায় প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে, তা তো বলা যায়। ওটা আর এখন ‘পোলাপানের ব্যাপার’ নেই। কাজের মানুষ যাঁরা, তাঁরা ঠিকই ব্যবহার করে চলেছেন। পাহাড়ের জুম চাষ, আর ছবি তোলার সময় ক্যামেরার লেন্স জুম করা ছাড়া ‘জুম’ শব্দ আর আমরা খুব বেশিজন কি শুনেছি? আর এখন প্রায় প্রতিদিনই জুম মিটিংয়ের কথা শুনতে হয়, করতে হয়। ভিডিও সভা করার জন্য জুম সফটওয়্যার, গুগল মিট—এগুলো তো এই করোনাকালেই জমে উঠল।

গত ডিসেম্বরে জুম ব্যবহার করে ভিডিও সভা হতো প্রতিদিন ১ কোটি। দুই মাসের মার্চে সেটার পরিমাণ ২০ গুণ। এপ্রিলে এসে প্রতিদিন জুম মিটিং করেন ৩০ কোটি ব্যবহারকারী। গুগল মিটেও সভার সংখ্যা বেড়েছে। এপ্রিলে প্রতিদিন এই সেবা ব্যবহার করেছেন ৩০ লাখ মানুষ। [তথ্যসূত্র: দ্য ভার্জ]

এরপর আছে লাইভ, বিশেষ করে ফেসবুক লাইভে এখন আসছেন অনেকেই। ছেলে, বুড়ো, মেজ—সবাই। প্রথম প্রথম অনেকেরই হয়তো টুকটাক সমস্যা হয়। কারও ক্যামেরা চালু হয় না, কারও–বা মাইক্রোফোন। কথা শোনা যায় না। কেউ হয়তো পেছনে আলো রেখে বসে পর্দায় নিজেকে অন্ধকার করে ফেলেছেন। ক্ষতি হচ্ছে না। এসব তো ক্ষণিকের। অংশগ্রহণকারীদের কেউ কিংবা হোস্ট (সঞ্চালক) বলে দিচ্ছেন কীভাবে তাঁকে স্পষ্ট দেখা যাবে, শোনা যাবে।

এমনিতে দেখা–সাক্ষাতের দিন তো আর নেই। কবে হবে আগের মতো, তা–ও অজানা। তাই ভিডিও কল, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার—এগুলো এখন নাতির যেমন জানা, তেমনি দাদা–দাদিরও। বয়স আর এ সময় প্রযুক্তি ব্যবহারের অন্তরায় হচ্ছে না। বয়স্করা বরং দ্রুতই শিখে নিচ্ছেন এবং যথাযথ ব্যবহার করছেন। অনলাইনে ক্লাসেও পাওয়া যাচ্ছে ঋদ্ধ অধ্যাপককে। যিনি হয়তো মোবাইল ফোনে কল করা কিংবা দাপ্তরিক ই–মেইল ছাড়া হাল প্রযুক্তির পথ মাড়াতেন না। তিনিই এখন যথারীতি হাজির অনলাইন ক্লাসে, আগে তৈরি লিংক নিয়ে প্রস্তুত।

হোম অফিসের কথাই–বা কজন জানত এই বঙ্গদেশে। ‘বাসাটাকেও অফিস বানিয়ে ফেললে?’ অফিসের কাজ বাসায় শুনলে এমন বাঁকা বাণীই তো বর্ষিত হতো পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের মুখ থেকে। আমরাই কি আর ভেবেছিলাম পুরো একটা পত্রিকার লেখা, সম্পাদনা, প্রুফ দেখা, পৃষ্ঠাসজ্জা, গ্রাফিকস—সব কাজ বাসা থেকে করে সেটা ছাপানোর কথা?

এমন কিছুই আমরা ভাবিনি। ‘টেক স্যাভি’ কারও কারও কল্পনায় থাকলেও তার বাস্তবায়ন সম্ভব, এটা ভাবা যায়নি। করোনাকালের নতুন স্বাভাবিক অবস্থা তা শুধু ভাবিয়েছে, সেটিই নয়, আমাদের দিয়েই করিয়ে নিচ্ছে। ঘরে ঘরে কাজ করে এই আমরাই তো কাগজের পত্রিকা বের করে পাঠকের হাতে তুলে দিলাম।

কয়েক দিন আগে একটা ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় কম্পিউটার বিজ্ঞানের অধ্যাপক সৈয়দ আখতার বললেন, ‘বাংলাদেশ তো বটেই, পুরো দুনিয়াতেই প্রযুক্তির যে রকম বা যেসব ব্যবহার হওয়ার কথা ছিল ২০৩০ সালে, করোনার কারণে তা ২০২০ সালে দেখা যাচ্ছে।’

শারীরিকভাবে যেহেতু দেখা করা এখন ঠিক নয় বা সহজ নয়, তাই দূর থেকে কাছে যাওয়ার কাজটা করতে হচ্ছে। তরুণ তুর্কিরা তো নতুন বিষয়, নতুন প্রযুক্তির মশাল হাতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেনই, তাই বলে জ্যেষ্ঠরাও পিছিয়ে নেই। দরকারে দ্রুত এটা–ওটার ব্যবহার শিখে, এটা–ওটার নাম শিখে প্রযুক্তিকে বন্ধু বানিয়ে ফেলছেন। পরিচিত কেউ যদি তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, আরে, আপনি ভিডিও মিটিংও করেন? তখন তিনি বলতেই পারেন, ‘পুরান চাল ভাতে বাড়ে।’