করোনাকালে ডায়ালাইসিসের চিত্র

আমাদের দেশে বিপুলসংখ্যক কিডনি রোগী রয়েছেন। গুরুতর অসুস্থ কিডনি রোগীদের অনেকে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট বা ডায়ালাইসিসের মাধ্যম প্রায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করে থাকেন। দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্নাতকোত্তর ইনস্টিটিউট এবং বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস হয়। তবে তা সংখ্যার দিক থেকে খুব বেশি নয়।

কোভিড-১৯ সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। কোভিড-১৯ মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ বিধায় ডায়ালাইসিসের রোগী, চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসা সহায়তাকারীদের ভেতর একধরনের আতঙ্ক বিদ্যমান। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, হাঁপানি রোগী কোভিড সংক্রমিত হয়েও কিডনির জটিলতায় আক্রান্ত হতে পারেন। বিভিন্ন হাসপাতালে এই বিশেষায়িত সেবার সুযোগ অপ্রতুল বিধায় রোগীরা নানা ধরনের দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। নিম্নের উদাহরণের মাধ্যমে সে চিত্র তুলে ধরছি।

চিত্র-এক
ঢাকা মহানগরীর বিশেষায়িত এক হাসপাতালে কিডনি রোগীরা এসেছেন হেমোডায়ালাইসিস ইউনিটে। এসে শুনতে পান হাসপাতালের একজন নার্স করোনায় আক্রান্ত। সে কারণে ডায়ালাইসিস শুরু করা যাচ্ছে না।
রোগীরা আতঙ্কিত হন। তাঁদের কারও সপ্তাহে তিন দিন, কারও সপ্তাহে দুই দিন ডায়ালাইসিস করাতে হয়। ডায়ালাইসিসের দিন সকালে শরীর খারাপ থাকে। অস্বস্তি লাগে, ভারবোধ হয়। ডায়ালাইসিস শুরুর পর অস্বস্তিবোধ কমে আসে।
ডায়ালাইসিসের জন্য আসা রোগীদের উদ্ভূত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মন খারাপ হয়ে যায়। তাঁদের কারও শরীরে এক লিটার, কারও চার লিটার বা পাঁচ লিটার পানি জমেছে। হুইলচেয়ারে আরোহীদের শ্বাসকষ্টের উপসর্গও রয়েছে। তাঁরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছেন। ডায়ালাইসিস না হলে কোথায় যাবেন? করোনাকালে হাসপাতালগুলোতে নতুন রোগীর শিডিউল নিতে হলে করোনা টেস্ট বাধ্যতামূলক। কাজেই এই অবস্থায় নতুন সেন্টারে যেতে হলে কোথায় করাবেন করোনা টেস্ট? যাবেনই–বা কেমন করে? ডায়ালাইসিসের সুযোগ কি পাবেন?

চিত্র-দুই
এক নারী রোগী ডায়ালাইসিস ইউনিটে ডায়ালাইসিস করাতে এসে বিপাকে পড়েছেন। তাঁকে করোনা টেস্ট করতে বলা হয়েছে। রোগীর স্বামী বুঝতে পারছেন না কেন টেস্ট করাতে হবে। ইনচার্জ রোগীকে তাড়া দেন রিপোর্ট না পাওয়া অবধি ডায়ালাইসিস হবে না। কোথায় করাবেন টেস্ট? স্বামী জানতে চান। ইনচার্জ বললেন, যেখানে এই পরীক্ষা হয়, সেখানে গিয়ে করাবেন।
রোগী পরীক্ষার সেন্টারে গিয়েছিলেন। ওখানকার অফিস বলেছে চিকিৎসককে দেখাতে হবে। চিকিৎসক যদি মনে করেন রোগীর পরীক্ষা প্রয়োজন, তাহলে এসে রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে। তখনই সময় দেওয়া হবে। তবে তা দু-এক দিনের ভেতর পাওয়া যাবে না।

রোগী অসুস্থ শরীর নিয়ে আবার ডায়ালাইসিস সেন্টারে আসেন। ইনচার্জকে জানান পরীক্ষার বিষয়ে। রোগীর স্বামী বললেন, যে হারে পানি জমছে, ডায়ালাইসিস না হলে তা বেড়ে গিয়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে। অনুরোধ জানালেন যেন ডায়ালাইসিস করে দেওয়া হয়। ইনচার্জ তাঁর অক্ষমতার কথা পুনর্ব্যক্ত করে তাঁকে চলে যেতে বললেন। রোগীর স্বামী ডিপার্টমেন্টের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা করোনাকালের আগে যেভাবে প্রতিদিন হেমোডায়ালাইসিস ওয়ার্ডে আসতেন, এখন সেভাবে আসেন না। খুঁজতে গিয়ে প্রায় কক্ষ তালাবন্ধ দেখেন, যেগুলোতে তালা নেই, লেখা রয়েছে ‘প্রবেশ নিষেধ’। বাধ্য হয়ে ফিরে আসতে হয়।

করোনায় আক্রান্ত রোগীদের ডায়ালাইসিসের চিত্র
করোনার এই সময়কালে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের ডায়ালাইসিসের পরিস্থিতি খারাপ। করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে কার্যকর ডায়ালাইসিস ইউনিট নেই। কোনোমতে চলছে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা হাসপাতাল। কেবল মুগদা হাসপাতালে সাতটি মেশিনে ডায়ালাইসিস হয়। দৈনিক ১৪ জন রোগী ডায়ালাইসিস করাতে পারেন। জনবলের অভাবহেতু এই হাসপাতালের সব মেশিন চালানো যাচ্ছে না। সামরিক বাহিনীর হাসপাতালের ভেতর কেবল ঢাকা সিএমএইচে চারটি ডায়ালাইসিস মেশিন কোভিড রোগীদের জন্য নির্ধারিত।

কেমন চলছে ডায়ালাইসিস
চিকিৎসক ও নার্সের সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে জনবল–সংকট তীব্র আকার ধারণ করায় ডায়ালাইসিসের সময়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। রুটিন চার ঘণ্টার স্থলে তিন ঘণ্টায় ডায়ালাইসিস সম্পন্ন করা হচ্ছে। রোগীদের মনে এ বিষয়ে প্রশ্ন থাকলেও শঙ্কিতচিত্তে তাঁরা তা মেনে নিয়েছেন। রুটিন রোগী ও করোনায় আক্রান্ত রোগীরা ডায়ালাইসিস করাতে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।

পদক্ষেপ জরুরি
এ অবস্থায় আমাদের সীমিত সাধ্যের ভেতরে রোগীদের দুর্ভোগ লাঘবে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ‘নিয়মিত’ রোগীদের ডায়ালাইসিস নিশ্চিত করতে হবে। করোনায় আক্রান্ত ডায়ালাইসিস রোগীদের জন্য কেবল কোভিড নির্ধারিত নয়, অন্যান্য হাসপাতালেও ব্যবস্থা করতে হবে। ডায়ালাইসিস ওয়ার্ডের এক পাশে নির্ধারিত কয়েকটি মেশিনে তা করা যায়। স্নাতকোত্তর নেফ্রোলজির কোর্সের শিক্ষার্থীদের এ সময়ে স্বাস্থ্যসুরক্ষার ব্যবস্থা করে কাজে লাগাতে হবে। নার্সসহ চিকিৎসা সহায়তাকর্মীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করে নিয়োগ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে নেফ্রোলজিস্ট পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ ও প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

লেখক: অধ্যাপক মো. শফিকুল ইসলাম
(চক্ষু বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়)