কোভিড আইসিইউ থেকে বলছি

করোনাজয়ী চিকিৎসক রাফিয়া আলম। ছবি: সংগৃহীত
করোনাজয়ী চিকিৎসক রাফিয়া আলম। ছবি: সংগৃহীত

শিরোনামটা আগেই ভেবে রাখা ছিল। বদলাতে ইচ্ছা করল না। যদিও এখন আমি হোম আইসোলেশন থেকে বলছি। আগেই ভেবেছিলাম কোভিড আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখব। কিন্তু যখন লিখতে শুরু করলাম তখন আমি কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত। দেখা যাক লেখাটা শেষ হয় কী দিয়ে।

জুন মাসে কাজ শুরু করেছি কোভিড আইসিইউতে। কিছুদিন পর জ্বরে আক্রান্ত হলাম। পরীক্ষা করে জানা গেল, এ যেনতেন জ্বর নয়। মহামারি এবার হানা দিয়েছে আমার শরীরে। কোভিড–১৯ আক্রান্ত রোগীর সেবা দিতে দিতে নিজেই আক্রান্ত হয়ে পড়েছি।

কোভিড আইসিইউতে কাজ শুরু করার আগে অবশ্য একবার হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়েছিল (তখন নিউরো আইসিইউতে কাজ করতাম, দুই মাস আগের কথা বলছি)। করোনাভাইরাস মহামারির প্রকোপ শুরু হওয়ার সময় থেকে আমার জন্য দুশ্চিন্তা করছেন আমার মা-বাবা। আর এদিকে আমার দুশ্চিন্তা তাঁদের জন্য। বয়স ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা বিবেচনায় করোনাকালে তাঁদের ঝুঁকি বেশি।

হাসপাতালে কাজ করে আমি বাসায় ফিরছি, এতে তাঁদের ঝুঁকি আরও বাড়ছে। বাসায় মা-বাবা ছাড়াও আদরের বিড়ালছানা আছে চারটি। আমার কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে ওরাও। পৃথিবীতে লাখ লাখ মানুষ যেখানে মারা যাচ্ছে, সেখানে পোষা প্রাণীর কথা লিখছি বলে কেউ কেউ খেপে উঠতে পারেন। তবে খেপে ওঠার আগে একবার ভাবুন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের শারীরিক ও মানসিক কষ্টকে খুব কাছ থেকে দেখেছি বলেই এর কারণে প্রাণে যে কষ্ট হতে পারে, সেটি উপলব্ধি করতে পারি খুব সহজেই। তা সেই প্রাণটি যারই হোক না কেন। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে তাই সবার থেকে একটু দূরেই থাকি।

নিজে করোনা জয় করে আবার করোনারোগীর সেবায় ফিরেছেন ডা. রাফিয়া আলম। ছবি: সংগৃহীত
নিজে করোনা জয় করে আবার করোনারোগীর সেবায় ফিরেছেন ডা. রাফিয়া আলম। ছবি: সংগৃহীত

কোভিড আইসিইউতে শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের দেখেছি। দেখেছি আরও নানা জটিলতার রোগী। বর্ণনার সাধ্য নেই আমার। তবে যাঁরা এই রোগীদের সেবা দেন, তাঁদের কেমন অনুভূতি হয়, জানেন? ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী বা পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্টের (পিপিই) ভেতর থেকে তাঁরা শ্বাস নেন কেমন করে, কখনো মনে হয়েছে কি? হয়তো ভাবেননি, হয়তো ভেবেছেন।

আমার কিন্তু সেখানে কাজ করতে করতে প্রায়ই মনে হয়, এই পোশাক আর মাস্কের ভেতর দমটা বুঝি আটকে এল। দৃষ্টি কেমন বাধাগ্রস্ত হয়, জানেন? মাস্কের ওপরের দিক দিয়ে নিশ্বাস বেরিয়ে গগলসে বাষ্প জমতে থাকে। এই বাষ্প জমার হার কমাতে একেবারে ভেতরের স্তরের মাস্কটাকে নাক আর গালের সঙ্গে যুক্ত করি মাইক্রোপোরের সাহায্যে। মাইক্রোপোর হলো সাদা টেপের মতো যে জিনিস ক্যানুলা প্রভৃতিকে নির্দিষ্ট স্থানে আটকে রাখতে ব্যবহার করা হয়।

দীর্ঘ সময় পর রোগীর কাছ থেকে বেরিয়ে আসি আমরা। ধীরে ধীরে যখন সব সরিয়ে ফেলি, তখন হাত ধোয়ার বেসিনের ওপরের আয়নায় নিজেকে দেখলে কী মনে হয়, জানেন? মনে হয়, এই মুহূর্তে এই চেহারাটা আমার মা-বাবা দেখলে কান্নায় ভেঙে পড়তেন। একমাত্র সন্তানের এ কী হাল! আসলে সবার মা-বাবা এ রকমই ভাবতেন, সন্তান একমাত্র হোক আর ১০ জন। মাস্ক-গগলসের চাপে চামড়ায় ভাঁজ হয়ে দাগ পড়েছে নাক-গাল-কপালে। আঁটো হয়ে থাকা হাত দুটোর দশাও একই রকম। মাইক্রোপোর দিয়ে আটকে রাখা মাস্কটা খুলতে যে যন্ত্রণা হয়, সেটাও তো দেখা যায় না।

চিকিৎসক যখন রোগী

এবার একটু রোগী–জীবনের কথা বলি। আমার বন্ধুর বাবা কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হওয়ার পর বলেছিলেন, এ রোগ হলে বোঝা যায় এটা আসলে কী। বয়সে তরুণ ও শরীরে অন্য কোনো ব্যাধি না থাকা সত্ত্বেও আমার নিজের অভিজ্ঞতা তেমনই। যে আমি বিকেলে বইমেলায় ঘুরে সন্ধ্যায় যানজটের কারণে বাংলা একাডেমি থেকে পান্থপথ পর্যন্ত হেঁটে এসে হাসপাতালে নাইট ডিউটি করেছি হাসিমুখে, সেই আমি আক্রান্ত হওয়ার পর বারান্দার গাছে পানি দিয়েছি কোনো রকমে বসে বসে। একই বাসায় থেকে আপনজনদের সঙ্গে ফোন বা ভিডিও কলে কথা বলা আমার নিত্যদিনের অংশ। এই সময়ে আমার সঙ্গী কয়েক পাতা বিভূতিভূষণ কিংবা শহীদুল্লা কায়সার, কখনো কয়েক পাতা সৈয়দ মুজতবা আলী, কখনো আবার কয়েক ঝলক কেডি পাঠক।

করোনার আইসিইউতে এই পোশাকে কাটে রাফিয়ার দিন। ছবি: সংগৃহীত
করোনার আইসিইউতে এই পোশাকে কাটে রাফিয়ার দিন। ছবি: সংগৃহীত

মন ভালো রাখা আবশ্যক। উপুড় হয়ে শুয়ে (ফুসফুসকে ভালো রাখার অংশ) তাই চাঁদও দেখি। দিনের আকাশের রং দেখি। ঘুড়ি দেখি। বারান্দায় গাছের চারাদের বেড়ে ওঠা দেখি। জানালা দিয়ে কর্মস্থলের দালানও দেখি। বৃষ্টি দেখি। হাত বাড়িয়ে দুফোঁটা বৃষ্টি ঘরেও নিয়ে আসি। চিকিৎসক-জীবনের চাপ নেই এখন, কোনো ফোন পেয়ে ছুটতে হবে না হাসপাতালে। তবে পাশের ঘরে মা কাশছেন কি না, কান খাড়া করে শুনি মাঝেমধ্যে। আপনজনের জন্য দুশ্চিন্তা যে সবারই।

আমার বিড়ালদের মন খারাপ, আমার সান্নিধ্য পেতে ওরা ব্যাকুল। নিচের তলা থেকে খালামণি আমাদের বাসায় (সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই) এসে চারটি বিড়ালের দৈনন্দিন দেখভাল করছেন। ওদিকে আমার ঘরলাগোয়া বারান্দা ছাড়া অন্য সব জায়গায় রাখা ছোট ছোট গাছে (৫০টির বেশি) আমার বাবা পানি দিচ্ছেন নিয়ম করে। অসুস্থতার সময় আমার দৈনন্দিন এসব কাজ করে দিচ্ছেন তাঁরা। আর আমার মা কী করছেন আমার ভালো থাকার জন্য, তা প্রকাশের ভাষাও বোধ হয় আমার অজানা।

আমি তো আমার কথা বললাম। আমার পরিবারের কথা বললাম। চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতালের অন্যান্য সেবাদানকারী—সবারই এ রকম আলাদা আলাদা জীবন। প্রত্যেকেই কারও সন্তান, কারও অভিভাবক, কারও বন্ধু, কারও আপনজন। আর সবাই চান তাঁর কাছ থেকে সেবা নেওয়া ব্যক্তি ভালো হয়ে উঠুক। আমিও তাই চেয়েছি সব সময়। রোগীর সেবা দিতে গিয়ে নিজেই যে আক্রান্ত হয়ে যাব, সেটা মেনে নিয়েই তো এই পেশায় এসেছি। তারপরও কিছু মানুষের আচরণ দেখে অবাক হই। মন আহত হয়।

অসুস্থতার ১৫ দিন কাটিয়েছি একা ঘরে চিকিৎসা নিয়ে। এই সময়টা যে কতটা কঠিন, সেটা লিখে পাঠকের ভয় বাড়াতে চাই না। তবে বুঝেছি করোনা মোকাবিলায় মনের জোর একটা বড় ওষুধ। নিজে সুস্থ হয়ে আবার কাজে যোগ দিয়েছি। আবার ফিরে এসেছি সেই রোগীদের মধ্যে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে যাঁরা রয়েছেন আইসিইউতে। নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে আবারও গায়ে চড়িয়েছি পিপিই, মাস্ক আর গগলস। আবারও বাষ্পে চোখ ঝাপসা, তবে চরম এই সংকটময় মুহূর্তে একেকজন মানুষের পাশে থাকতে চাই তাঁকে ভরসা দিতে।

সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বাঁচতে চাই এই দেশে।