খরচ কমাব কিসে?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

করোনা মহামারির কারণে পাল্টে গেছে বিশ্ব, এখন এক নতুন বাস্তবতায় আমরা। মানুষ আবার যেন কেবল মৌলিক চাহিদা মেটানোর সময়ে ফিরে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে কঠিন এই চ্যালেঞ্জের সময়ে নতুন করে সঞ্চয় করার প্রয়োজন অনুভব করছি আমরা। ব্যয় বাঁচাতে ছোটখাটো খরচও আর অবহেলা করার উপায় নেই। করোনায় চাকরি হারিয়েছেন অনেকে, অনেকের আয় কমেছে, আবার ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যাওয়ায় অনেকে খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। আগে যেভাবে ব্যয় সমন্বয় করত পরিবারগুলো এখন তা আর সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, আয় কমতে পারে, তবে সংসার খরচের জায়গা কমানো কি অতটাই সহজ হয়? ‘সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা, আশা তার একমাত্র ভেলা’, এখন সেই আশা নিয়েই এই কঠিন সময় মোকাবিলা করতে হবে সবাইকে। কোনটা আগে জরুরি, কোনটা পরে হলেও চলে, হিসাবের এই প্যারাডক্স মেলাতে হচ্ছে প্রত্যেককেই।

রাফিয়া আক্তার ও আফসার আলমের ২০ বছরের সংসারে এমন সময় আর আসেনি। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন আফসার আলম। এত দিন সংসারে সঞ্চয় না হলেও টানাটানি ছিল না। দুই সন্তানের লেখাপড়া, সংসারের ব্যয় মিটিয়েও মাঝেমধ্যে সবাই মিলে একসঙ্গে খেতে যেতেন। মাসে, দুই মাসে পরিবারের সবার জন্য পোশাক কেনা হতে। তবে করোনায় যেন সব ওলট–পালট হয়ে গেল। গত তিন মাস ঘরবন্দী হয়ে অফিসের কাজ করেছেন আফসার। বেতন নিয়মিত পাননি। তাই প্রয়োজন ছাড়া কোনো কেনাকাটার কথা মাথায়ও আনেননি। সমস্যা হচ্ছে, সংসারে এটা লাগে তো কাল ওটা লাগে। এর মধ্যে তাদের ছোট ছেলেটা পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলল। এই টানাটানির সময়ে হঠাৎ করেই টাকার প্রয়োজন পড়ল। সেই হিসাব মেলাতে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে এই দম্পতিকে। এমনকি কিছু ঋণও করে ফেলেছেন তাঁরা।

আগে না জানলেও এই কয়েক মাসের পরিস্থিতিতে অনেকেই বুঝে গেছেন যে ঠিক কী কী না কিনলেও সংসার চলে যায়। কাজেই অতিরিক্ত কোনো জিনিসপত্র কিনে বোঝাই করছেন না মগবাজারের বাসিন্দা দিনা আলম। এ কয় মাসে জীবনযাপনের পরিবর্তনগুলো তাঁকে খুব ভাবাচ্ছে। জানালেন স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে এখন অনলাইনে বেশি কিনি। এতে খরচ একটু বেশি হচ্ছে, তাই অন্য জায়গায় খরচ কমাতে হচ্ছে। সাত সদস্যের পরিবার তাঁর। তিনি ও তাঁর স্বামী চাকরি করেন।

দিনা বললেন, ‘খরচ বেড়েছে। পরিবারের সবার মাস্ক, স্যানিটাইজার কিনতে হয়। সাবান, জীবাণুনাশক কেনার পরিমাণও অনেক বেড়েছে। তাই অন্যদিকে খরচ কমিয়ে দিয়েছি আমরা। আগে বাইরে থেকে প্রায়ই বিকেলের নাশতা আনতাম। সেটা বাদ দিয়েছি। বাচ্চাটা খুব খেলনার বায়না ধরে। তাকেও একটু বুঝ দিচ্ছি।’ এ ছাড়া বাসায় বিদ্যুৎ, ফোনের খরচ কমিয়েছেন তাঁরা।

আসলে করোনায় এক ‘নতুন স্বাভাবিক’ অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হচ্ছে মানুষকে। কোনটা একান্তই প্রয়োজনীয়, আর কোনটা নিছক বিলাসিতা, তা এই কদিনেই বুঝে গেছেন সবাই। তাই করোনার পরে যে সময়টা আসছে, তখন যেন আর্থিকভাবে বিপদে পড়তে না হয়, সে জন্য এখন থেকেই সহজ কিছু উপায় মেনে চলছেন অনেকে। এ জন্য মাসের খরচের খাতা নতুন করে খুলেছেন অনেকে।

ব্যয়ের পরিবর্তন চিহ্নিত করুন

কোন কোন খাতে কমাতে হবে, হিসাবের খাতায় তা আগে নির্ধারণ করা উচিত। আপনার প্রয়োজনীয় ব্যয় এবং এখন এর কীভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তা দেখুন। সংকটের আগে, হয়তো প্রয়োজনীয় ব্যয়গুলোর জন্য মাসিক আয়ের ৫০ শতাংশ খরচ হতো, এখন হয়তো কিছু কিছু খাতে তা কমেছে। যেমন এখন আপনি যে বাড়ি থেকে কাজ করছেন, তার জন্য আপনার অফিস যাতায়াতের খরচ, দুপুরের খাবারের খরচ, পোশাকের খরচ হয়তো হচ্ছে না। এর থেকে সঞ্চয় করা যেতে পারে। আবার আগে বাইরে থেকে যেতেন, সিনেমা দেখতেন—যা এখন করছেন না সেই বাড়তি টাকাও যোগ করা যেতে পারে এই সঞ্চয়ে। এবার দেখতে হবে আগের চেয়ে বাড়তি খরচ হচ্ছে কীসে। জীবাণুনাশক, মাস্ক, পুষ্টিকর খাবার, ফলমূল, ওষুধে হয়তো খরচ বেড়েছে। এসব হিসাব করে যা থাকছে, তা সঞ্চয় করে ফেলা যায়। সম্ভব হলে ব্যাংক বা অন্য কোথাও সেই টাকা আলাদা করে ফেলতে পারেন।

করতে হবে বাজেট

খরচের হিসাব কষেই আয়ের একটা হিসাব করুন। এটি খুবই জরুরি। কারণ, তাহলে মাসে বাড়তি খরচের আশঙ্কা কমে যায়। অতি জরুরি কিছু না হলে হিসাবের বাইরে গিয়ে না কেনাই ভালো। প্রয়োজন না হলে সংসারের জন্য বাড়তি কিছু কিনবেন না। এতেই সংসারের বাজেট ধরে রাখতে পারবেন। ধার-বাকি নয়, কিছু কেনার পরিকল্পনা থাকলে তা মাসের শুরুতেই ঠিক করে নেওয়া ভালো। তবে এ সময় বাকিতে কিছু না কেনাই ভালো।

বুঝতে হবে প্রয়োজন ও চাহিদার পার্থক্য

করোনার এই সময়ে আসলে প্রয়োজন আর চাহিদার মধ্যে পার্থক্যটা বুঝতে হবে। ধারকর্জ করে শখ মেটানোর সময় এটা নয়। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে খুবই সতর্ক হতে হবে। অনলাইনে দেখে যা ইচ্ছা সব কিনে ফেললাম—ক্রেডিট কার্ডে কেনার এমন অভ্যাস থেকে বের হয়ে আসতে হবে। অনেক সময় ‘ডিসকাউন্ট অফার’-এর ফাঁদে পড়ে অনেক কেনাকাটা করে ফেলি আমরা, এই বিষয়ে খেয়াল করতে হবে।

নতুন গ্যাজেট এসেছে কিনে ফেলি, এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ও এখন নয়। খুব কেনাকাটা করার অভ্যাস থাকলে তাতে রাশ টানা জরুরি। আসলে শপিং একটি নেশার মতো। এই সময় ফিল গুড হরমোন ক্ষরণ বেড়ে যায় বলেও বিজ্ঞানীদের দাবি। অনেকেরই অবসর যাপনের অন্যতম সঙ্গী কেনাকাটা। তবে এতে অহেতুক অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা হয়ে যায়, খরচও হয় বেশি।

অবহেলার নেই অবকাশ

প্রবাদ আছে, বিন্দু বিন্দু জলে সিন্ধু হয়। তেমনি অল্প অল্প করে খরচ বাঁচালেও তা হয়তো একটা সময় যক্ষের ধন হবে। তাই আগে অবহেলা করলেও কিছু জিনিসে এখন আর তা করার অবকাশ নেই। যেমন: দিনের বেলা আলো জ্বালিয়ে রাখবেন না। খালি ঘরে ফ্যান চালিয়ে রাখা, অপ্রয়োজনে এসি চালানো, পানির ট্যাপ খুলে কাজ করা, এসব বদ অভ্যাস পাল্টালে যেমন নৈতিক বিকাশ হয়, তেমনি এই কঠিন সময়ে স্বস্তিজনক সঞ্চয়ও হতে পারে।

তবে এত হিসাব কষতে কষতে হয়তো হতাশা চলে আসতে পারে। মনে হতে পারে এমন করেই কি চলবে জীবন। তা কাটিয়ে ওঠাও খুব জরুরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, করোনায় খুবই গুরুতর সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, যা জীবনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত। তাই বর্তমান এই সময়ে পারিবারিক মানসিক শক্তির জায়গাটা সঞ্চয় করে একে অপরকে মোটিভেট করতে হবে। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যয়ের জায়গা কমিয়ে আনা। যতটুকু না হলেই নয়, ততটুকু ব্যয় করা। কারণ, অনেকের চাকরি চলে গেছে, অনেকের আয় কমেছে, তাই ব্যয়ের জায়গাটা কমিয়ে ফেলা খুবই জরুরি। সেই সঙ্গে আরও জরুরি ব্যয় কমাতে বাধ্য হওয়ায় যে হতাশার জায়গা তৈরি হচ্ছে, তা থেকে বেরিয়ে আসা। এটা মেনে নিতে হবে। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের এর জন্য বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। যতটুকু আছে, তা নিয়ে ব্যয় করা, সেই সঙ্গে সঞ্চয় করার গুরুত্ব পরিবারের মধ্যে বুঝিয়ে বলতে হবে। এখনকার এই সংকটময় বাস্তবতাকে শক্তিকে পরিণত করতে হবে।