স্বাদের ইন্দ্রজাল

মসলা খাবারের স্বাদ বাড়ায়। ছবি: নকশা
মসলা খাবারের স্বাদ বাড়ায়। ছবি: নকশা

কাঁসার থালায় জুঁই ফুলের মতো সাদা ভাত। কাগজি লেবুর গন্ধ ছাড়িয়ে নাকে ঝাপটা মারে বিবিধ খুশবু। শর্ষের তেলে রান্না করা মাংসে কোনো আলু নেই। খাপখোলা তরবারি যেন! এসব দেখেই তেড়েফুঁড়ে ওঠে খিদে। সোনালি রঙের প্রেক্ষাপটে সাদা ভাতের ওপর যখন গাঢ় জাফরানি রঙের ঝোল হেসে ওঠে, পৃথিবীর তাবত কষ্ট ভুলে থাকা যায়। এই শহরে শ্রাবণে অগাধ বৃষ্টি নামলেও কষ্ট ভেজে না। কিন্তু ভাতের গন্ধে সহজেই ভেজে জিব। কষ্ট ভুলে থাকার এ এক গোপন পথ্য যেন।

অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে কষ্ট ভুলে থাকার গোপন পথ্য হলো খাবার। বাঙালির কাছে ভাতের গন্ধের চেয়ে প্রিয় সেটা আর কিছু নয়। কিন্তু ভাত সহচর ছাড়া প্রায় অচল। সে জন্যই ভাতকে রাঙাতে প্রয়োজন ঝোল, সেটা খাসির হোক, গরুর মাংসের কিংবা বিবিধ মাছের। কিন্তু খেয়াল করলেই দেখবেন, মাছ, মাংস ও সবজির ঝোলের রং আলাদা আলাদা, স্বাদও ভিন্ন। কারণ কী? নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায় মসলা।

পৃথিবীর সব দেশের, সব সংস্কৃতির, সব অঞ্চলের, সব ধর্মের মানুষের খাবারকে খুব সহজে পৃথক করে চেনার উপায় হলো মসলা। আপনার ঘ্রাণশক্তি যদি প্রখর হয়, স্বাদগ্রন্থির কার্যকারিতা যদি অটুট থাকে, তবে আপনি খাবার জিবে দিয়ে কিংবা ঘ্রাণ শুঁকেই বুঝতে পারবেন কোনটা হিন্দু বাড়িতে রাঁধা ডাল, আর কোনটা মুসলিম পরিবারে। কোনটা পাঁচফোড়নে ফোড়ন দেওয়া ডাল, আর কোনটা ডালের তরকারি। আবার কোন সবজি ঠিক কতক্ষণ ফোড়নের বাগাড়ে রেখে কষিয়ে রান্না করা হয়েছে, নাক আর জিবের আভিজাত্য না থাকলে সেটা বুঝতে পারবেন না।

গোটা-বাটা-গুঁড়া—এ তিনভাবে আমাদের দেশে শুধু নয়, প্রায় পুরো পৃথিবীতে মসলার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ইদানীং ‘পেস্ট’ বলে একটা ব্যাপার দেখা যায়। ‘গার্লিক পেস্ট’, ‘অনিয়ন পেস্ট’ কিংবা ‘চিলি পেস্ট’ হলেও ‘ব্ল্যাক পেপার’ ক্রাশ করেই দেওয়া হয় খাবারে। কিন্তু দারুচিনি কিংবা এলাচ অথবা লবঙ্গ কীভাবে ব্যবহার করা হবে? এখানে বলে রাখি, মসলা হলো সেই উপাদান, যেটা নিজের স্বাদ-গন্ধে সুবাসিত করে খাবার।

আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহার করা মসলার মধ্যে রয়েছে রসুন, পেঁয়াজ, আদা, মরিচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, এলাচ, তেজপাতা, গোলমরিচ, জয়ফল, জয়ত্রী, জিরা, কালিজিরা, হলুদ, মেথি, মৌরি, সরিষা, রাঁধুনি, ধনে, জোয়ান, হিং, কাবাবচিনি, চুঁই। আমাদের একেবারে স্থানীয় কিছু মসলা এককালে ব্যবহৃত হলেও এখন সেগুলোর ব্যবহার সংকুচিত হয়ে গেছে, যেমন পিপুল, বস ইত্যাদি। আবার মসলা না হলেও মসলার মতো ব্যবহার করা হয় কিছু শস্যদানা ও ফুলের কেশর, যেমন জাফরান, পোস্ত। এগুলো ছাড়া আছে কিছু ভেষজ। যেমন ধনেপাতা, কারিপাতা ইত্যাদি। প্রথাগতভাবে মসলা উৎপন্ন হয় মসলাজাতীয় উদ্ভিদের ফুল, ফল, কাণ্ড, বাকল ও শিকড় থেকে।

মসলার কাজই হলো নিজের স্বাদ-গন্ধে খাবারের স্বাদ বাড়ানো। মসলা আর গরমমসলা—এ রকম একটা ভাগ আছে আমাদের খাবারের সংস্কৃতিতে। এর সঙ্গে ইদানীং যুক্ত হয়েছে হার্বস। হার্বসের ধারণা আগে থেকে থাকলেও স্বাস্থ্য সচেতনতার যুগে এটা বেশ চাঙা। গরমমসলা হলো দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ ও গোলমরিচের সমন্বয়। অনেকে জিরাকে গরম মসলার মধ্যে ধরেন, অনেকে ধরেন না। গরম মসলায় থাক বা না–থাক, জিরা খুব গুরুত্বপূর্ণ মসলা। গোটা-গুঁড়ো-বাটা বা পেস্ট—সব রকমভাবে এক জিরা ব্যবহার করা যায়। গরম মসলার বাইরে বাকিগুলো শুধু মসলা। আর হার্বস হলো বিশেষ উদ্ভিদের পাতা বা নরম কাণ্ড কিংবা ফুল। বাঙালি অবশ্য রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ, তেজপাতা এবং হার্বসকে মসলা হিসেবে স্বীকার করে না কোনোকালেই।

ঢাকার মোহাম্মদপুরে ‘মজা’ নামের একটি রেস্তোরাঁ আছে। এর স্বত্বাধিকারীকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাঁর রেস্তোরাঁর খাবার এত মজার কেন? এককথায় উত্তর দিয়েছিলেন, ‘মসলা।’ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন বাটা মসলা ব্যবহার করি। প্রতিদিনের মসলা প্রতিদিন বাটা হয়।’ বেচে যাওয়া মসলা পরদিন ব্যবহার করা হয় না। তাজা মসলার গুণে খাবার সুস্বাদু হয় বলেই মনে করেন ‘মজা’ নামের রেস্টুরেন্টটির স্বত্বাধিকারী সাদাফ হাসনাইন। এর সঙ্গে যোগ করেন, কোন খাবারে মসলার পরিমাণ কেমন হবে, অবশ্যই সেটা জানা চাই। মসলার পরিমাণ খাবারের স্বাদ বাড়াতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে আছে কোন উপকরণের সঙ্গে কোন মসলার মেলবন্ধন কেমন হয়, সেটা জানা। এই জানা আর মসলার সঙ্গে বোঝাপড়া আমাদের ঘটেছে শত শত বছরের মিথস্ক্রিয়ার ফলে। এবং আমাদের নারীরা রন্ধনবিদ্যার এ জ্ঞান বয়ে নিয়ে চলেছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, নীরবে, কোনো স্বীকৃতি ছাড়াই।

খাবার যত শাহিই হোক, মসলা যদি ‘জাতের’ না হয়, সে খাবার সুস্বাদু হবে না। খাবারকে সুস্বাদু করার জন্যই পৃথিবীতে মসলার জন্য যুদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন পরাশক্তির মধ্যে। শেবার রানির মতো গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ যখন রাজা সলোমনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তখন উপহার হিসেবে সোনার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন মসলা! এসব ঘটনা ঘটেছে পৃথিবীর ইতিহাসে মসলাকে ঘিরে। শুধু খাবারের থালাতেই নয়, পৃথিবীর রাজনীতি-অর্থনীতি আর বাণিজ্য ইতিহাসে মোহময় ইন্দ্রজাল তৈরি করা বস্তুটি মসলা।