চিঠি যখন গবেষণার বিষয়

বাংলা গদ্যের প্রাচীনতম নিদর্শন কী?

কোচবিহারের কোচ রাজা নরনারায়ণ, যাঁর প্রকৃত নাম মল্লদেব, তিনি ষোলো শতকের মাঝামাঝি সময়ে ১৫৫৫-৫৬ সাল নাগাদ অহোমরাজ স্বর্গনারায়ণ চুখাম ফা কিংবা সুখাম্পাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। কেঁচোর রসে লেখা সে চিঠিই বাংলা গদ্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। বাংলাপিডিয়া জানাচ্ছে, সে চিঠির ভাষা ছিল অসমিয়া, কামতাপুরি, সংস্কৃত, বাংলা ও ফারসি মিশ্রিত।

আজ থেকে সাড়ে চার শ বছরের বেশি আগে লেখা কোচরাজের সেই চিঠির মাধ্যমে সহজে বোঝা সম্ভব বাংলা ভাষার বিবর্তন। এ ছাড়া বোঝা সম্ভব কোচবিহার ও আসামের প্রাচীন রাজনৈতিক সম্পর্ক এবং সেই সূত্রে বর্তমান অবস্থা। এসব কারণ আমলে নিয়ে গবেষকেরা বলছেন, মানুষের ব্যক্তিগত বিভিন্ন উপকরণকে যদি নিবিড় গবেষণার আওতায় আনা সম্ভব হয়, তাহলে ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে ইতিহাসের নিরিখে নতুন নতুন তথ্য জানা সম্ভব।

এ মূল বিষয়টিকে সামনে রেখে কুষ্টিয়ার অশ্রু আর্কাইভ (গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সংগ্রহশালা) একটি অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে সংগ্রহ করছে ব্যক্তিগত, প্রেমের চিঠি, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মকাণ্ডের চিঠি, গোপন কিংবা প্রকাশ্য যেকোনো রাজনৈতিক চিঠিসহ বিভিন্ন ধরনের চিঠি। এসব চিঠি ইতিহাসচর্চায় অনেক নতুন তথ্য যোগ করতে পারবে বলে বিশ্বাস করেন অশ্রু আর্কাইভের প্রতিষ্ঠাতা শিল্পী ও গবেষক শাওন আকন্দ।

শাওন আকন্দ জানান, লালন ফকির, রবীন্দ্রনাথ, কাঙাল হরিনাথ, মীর মশাররফ হোসেন, প্যারী সুন্দরীর স্মৃতিবিজড়িত অঞ্চল কুষ্টিয়া। বিখ্যাত মানুষদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের লিখিত চিঠিতেও আছে অনাবিষ্কৃত অনেক ঐতিহাসিক তথ্য। শাওন আকন্দ জানান, অশ্রু আর্কাইভ ‘পিপলস আর্কাইভ’-এর ধারণা নিয়ে কাজ করছে, যেখানে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন ও কর্মকাণ্ডকে মুখ্য বিবেচনা করা হয়। সরকারি বক্তব্য ও নথিপত্রের বাইরেও সাধারণ মানুষের জীবন আছে, বক্তব্য আছে। সাধারণ মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ বিভিন্ন অনুষঙ্গকে নিবিড় গবেষণার আওতায় আনলে অনেক নতুন বিষয় জানা যেতে পারে, যেগুলো আমাদের চেনা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদলে ভূমিকা রাখবে ভবিষ্যতে।

অশ্রু আর্কাইভ শুধু চিঠিপত্রই সংগ্রহ করছে না, ইতিহাস গবেষণার অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি সংগ্রহ করছে আলোকচিত্র। পারিবারিক কিংবা অন্যান্য যেকোনো আলোকচিত্রের প্রিন্ট ও ডিজিটাল কপি সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্পের কাজ চলছে অশ্রু আর্কাইভে। প্রাথমিকভাবে কুষ্টিয়া ও কুষ্টিয়াসংশ্লিষ্ট অঞ্চলের চিঠি ও আলোকচিত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করলেও পুরো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রকল্পের কাজ চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।

অশ্রু আর্কাইভ ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের অংশগ্রহণে একাধিক ওয়েবিনার সম্পন্ন করেছে। এ ওয়েবিনারগুলোতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সাবেক পরিচালক নীরু শামসুন্নাহার, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন-উর-রশিদ আসকারী, দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক রাজর্ষী দাশগুপ্ত, দিল্লির শিব নাডার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক শ্রীময় রায় চৌধুরী, ঢাকার বেগার্ট ইনস্টিটিউট অব ফটোগ্রাফির পরিচালক ও আলোকচিত্রী ইমতিয়াজ আলম বেগ, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সুরেস কে নায়ার, অশ্রু আর্কাইভের সাধারণ সম্পাদক ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সাজ্জাদ জাহিদ প্রমুখ।