আহা রে ইলিশ

ইলিশের ধর্মীয়, সামাজিক ও লোকসাংস্কৃতিক মূল্যমান আড়াই হাজার কোটি টাকার ওপরে! বলছে গবেষণা। ছবি: লেখক
ইলিশের ধর্মীয়, সামাজিক ও লোকসাংস্কৃতিক মূল্যমান আড়াই হাজার কোটি টাকার ওপরে! বলছে গবেষণা। ছবি: লেখক

বৃষ্টি রিমঝিমিয়ে পড়ছে আজ, সারা বেলা-সারাক্ষণ। দূর আকাশে কুয়াশার মতো জেঁকে ধরেছে বর্ষাক্ষণ। জানালা দিয়ে দিগন্তরেখায় দৃষ্টি মেলাতে পারছি না; বারবার ফিরে ফিরে আসছে, চারদিকে ভেসে যাওয়া থইথই জলে বৃষ্টির তীব্র পতনে ঝাপসা আভায়। অথই জলের বুকে ঢেউয়ের দোলায় বৃষ্টিনৃত্যে। মাঝেমধ্যে মুখাবয়বে বাহুলতায় স্পর্শ দিচ্ছে ষোড়শী নারীর আলতো মায়ায়। এমন একটা বর্ষাদিনের দেখা মেলেছিল ২০০৪ সালে।

দোতলা লঞ্চের জানালা দিয়ে দেখছিলাম আগুনমুখা নদীর বুকে ঢেউয়ের দোলায় সেই বৃষ্টিনৃত্য। যাচ্ছিলাম গলাচিপার পানপট্টি থেকে চরমোন্তাজের ইলিশঘাটের অভিমুখে। সঙ্গে পেয়েছিলাম বরিশালের চমৎকার এক গল্পাকারকে। বরিশাল অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে কথা হবে আর ইলিশের গল্প হবে না, এ যেন অসম্ভব। সেই ইলিশরসিক বন্ধুর নাম জলিল প্যাদা। তাঁর অভিজ্ঞতার কোনো শেষ নেই, সবকিছুতেই তিনি একটু বেশি পটু যেন!

গল্পের এক পর্যায়ে তাঁকে ইলিশের স্বাদের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিক্ত, কটু, অম্ল, মধু, লবণ, কষা এই চিহ্নিত ছয়টি স্বাদের মধ্যে ইলিশে কয়টি স্বাদ রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ইলিশে সব স্বাদই বিদ্যমান। উত্তরটি শোনার পর আমি আগুনমুখা নদীর পানে তাকিয়ে দেখি দ্বিতলবিশিষ্ট লঞ্চটি ততক্ষণে মাঝনদীতে চলে এসেছে। চারদিকে থইথই জল। বৃষ্টি পড়ছে তীব্র বেগে। চরমোন্তাজের ইলিশঘাটে পৌঁছাতে এখনো তিন সাড়ে তিন ঘণ্টা বাকি। সুতরাং গল্পাকার মুখ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর মুখাবয়ব বাকপ্রতুলতায় ভরপুর; বেশ রসিয়ে রসিয়ে কথা বলতে পারেন।

গল্পের এক পর্যায়ে বললেন, একবার ঢাকাইয়া সাত সদস্যের একটি দল চরমোন্তাজে যাচ্ছিলেন। তাঁদের ইচ্ছা ছিল সাত দিন শুধু ইলিশ মাছ খেয়েই থাকবেন। অন্য কোনো আমিষ পাতে তুলবেন না। গল্পকার নাকি তাঁদের ইলিশ খাওয়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। প্রথম দিন তাঁর দেওয়া ইলিশ খেয়ে খুবই খুশি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন ভালোই চলল। কিন্তু চতুর্থ দিনে এসে পাকল জটিলতা। জটিলতা ছোটখাটো নয়। সেই দলের একজন পেটের পীড়ায় প্রণ্ড অসুস্থ হয়ে প্রথমে পটুয়াখালী সদর হাসপাতাল, সেখান হতে বরিশাল এবং শেষ পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হতে হয়।

গল্পের এ পর্যায়ে জলিল প্যাদার চোখেমুখে ভয়ের স্পষ্ট ছাপ বোঝা যাচ্ছিল। পনেরো-ষোলো বছর আগে শোনা গল্পটি আমার চোখের সামনে যেন জ্বলজ্বল করছে। গল্পকারের নাম আর তৎকালীন আমার প্রিয় বন্ধুর নাম একই ছিল। তাঁর চেয়েও বড় কথা তিনি আমাকে মাঝেমধ্যেই পায়রা নদীর বরফহীন ইলিশ কেনার জন্য ইটবাড়িয়ার নদীর ঘাটে নিয়ে যেতেন। তবে জলিল প্যাদা সেই যাত্রা থেকে বেঁচে যান। কারণ, ওই সদস্য নাকি পরবর্তী সময়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন।

স্মৃতির ঝুলিতে তরতাজা ইলিশের দারুণ দারুণ গল্প, নদীভ্রমণ আর চারদিকে বর্ষার কীর্তননৃত্য। নিজের জানালার ধারে বসে এই বর্ষানৃত্যে আমি ভেতরে ভেতরে কড়কড়ে ইলিশ ভাজা আর খিচুড়ির আকাঙ্ক্ষায় গলে যাচ্ছি। ইশ! বউ যদি ভরপুর এক প্লেট ইলিশ খিচুড়ি সামনে এনে বলত, এই নাও তোমার বর্ষার দিনের বর্ষাভাত! এই বর্ষাভাতের ইলিশ নিয়ে বাঙালি মেতেছেন যুগে যুগে সর্বাগ্রে, সর্বত্র। এই ধরুন, বর্ষার বাজারে রুই-কাতলা, কই, শিং-মাগুর, তেলাপিয়া, ভেটকি মাছের সরবরাহ প্রচুর; ইলিশ মাছ তেমন একটা নেই।

এ অবস্থায় পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম হয়, ‘বাজারে ইলিশের আকাল, ভোজনবিলাসী বাঙালি দিন গুনছে’ কিংবা ‘বাজারে ইলিশ–সংকট, ভোক্তারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে চাষের মাছ থেকে’। আবার বাজারে যখন প্রচুর ইলিশের সরবরাহ, তখন সংবাদ হবে, ‘ইলিশে ইলিশে বাজার সয়লাব, আকাশছোঁয়া দাম’। এ এক অতি আশ্চর্য মাছ; যিনি বাজারে থাকলেও সংবাদ শিরোনাম, না থাকলেও শিরোনাম আবার স্থিতিশীল সরবরাহেও সংবাদ শিরোনাম। আসল সম্রাট তো সেই, যার উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতি বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করে না, বরং তার নাম-পরিচয়, আভিজাত্য আর কৌলীন্য বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করে।

ইলিশের রূপ-লাবণ্য, জৌলুশময়তা, দাপট আর প্রাধান্য বিস্তারে এতটাই শক্তিশালী যে তাকে স্পর্শ করে এমন সাহস কার? আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডফিশসহ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার যৌথ গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, ইলিশই পৃথিবীর একমাত্র মাছ, যার ধর্মীয়, সামাজিক ও লোকসাংস্কৃতিক মূল্যমান আড়াই হাজার কোটি টাকার ওপরে!

রূপ-লাবণ্যে ভরপুর দাপুটে ইলিশের গল্পে বাঙালি যখন বুঁদ হয়ে গেছে, তখন আমি ফিরে গেছি ২০১১ সালে। আমার থিসিসের কাজে ডেটা সংগ্রহ ও কেস স্টাডির জন্য ইলিশ ভ্যালুচেইনের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম। তাঁদের যে কত ধরনের অভিব্যক্তি, তা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। তবে একই অভিব্যক্তির রূপ, অর্থ, প্রকাশ কেমন আলাদা হতে পারে, বদলে যেতে পারে সেসব একটু ভাগাভাগি না করে পারছি না।

ইলিশ জেলে মনি মাঝি কেজি সাইজের গোটা কতক ইলিশ ধরে মহাজনের নিকট সমর্পণ করে বলে উঠেছিলেন, আহা রে ইলিশ। পানের পিক ফেলে এই ইলিশগুলোর লেজ ধরে উঁচিয়ে তৃপ্তির হাসিতে মহাজন বলে উঠেছিলেন, আহা রে ইলিশ। সেই ইলিশ সন্ধ্যাবাজারের খুচরা দোকানির বরফশীতল ঝুড়িতে যখন বিদ্যুতালোকে রক্তিম শুভ্রবর্ণে শোভিত হচ্ছিল, তখন পাশের নিকারি একটু ভিন্ন স্বরে বলে উঠেছিলেন, আহা রে ইলিশ। রিকশাচালক রাহেলার বাবা বাজারে দেড় হাজার টাকা কেজি দরের সেই ইলিশ কিনতে না পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠেছিলেন, আহা রে ইলিশ! সেই মাছটিই টাকাওয়ালা অমুক সাহেব বুক ফুলিয়ে বাজারের থলিতে ভরে দম্ভভরে রসনাসিক্ত কণ্ঠে বলে উঠেছিলেন, আহা রে ইলিশ। দামি এই ইলিশ মাছটি কাটতে গিয়ে চাঁদপুরের ইলিশঘাট থেকে ঢাকায় আসা কাজের বুয়া রহিমা খালা অতীত স্মৃতি মাড়িয়ে বলে উঠেছিলেন, আহা রে ইলিশ। রান্না শেষে ধনীর দুলালী ইলিশ পাতুরি কিংবা সরষে ইলিশের পেটি খেয়ে তৃপ্তভরে বলে উঠেছিলেন, আহা রে ইলিশ। গত বছর বাজারে যখন ইলিশে ইলিশে সয়লাব, ক্রেতাদের দর-দামের ধরনধারণ দেখে ইলিশ ফড়িয়া কলিমুদ্দি বলে উঠেছিলেন, আহা রে ইলিশ।

ওদিকে কবি লিখেছেন,

ইলিশের আভিজাত্যে, উল্লাসে বিলাসে বলে উঠি

আহ্ রে ইলিশ ।

উচ্ছ্বাসে কিংবা দীর্ঘশ্বাসে,

ক্ষোভে-বিক্ষোভে আর কষ্টে রোদ্র ঘামে বলে উঠি

আহ্ রে ইলিশ।

স্বাদে বিষাদে কিংবা

রূপে গন্ধ্যে সন্ধ্যার আবছা আলোতে বলে উঠি

আহ্ রে ইলিশ।

রান্না শেষে বাঙালিয়ানা দেখাতে বড়াই করে বলি উঠি

আহা রে ইলিশ।

স্বাদ-বিষাদের এই ইলিশ নিয়ে আজকের দিনের কবি আর সাহিত্যিকেরা মেতেছেন গল্প-কবিতার আসরে। আরও মেতেছেন উঁচুতলার মানুষ থেকে শুরু করে মুটে-মুচেদের দলও। এত গল্প, কবিতা, সাহিত্য, রূপকথা; এত সংবাদ, সংগ্রাম, বিড়ম্বনা! এ শুধু ইলিশ নিয়েই সম্ভব। এই মাছকে নিয়ে গোষ্ঠী থেকে জাতিতে গড়ে উঠেছে ইলিশ সংস্কৃতি। রয়েছে এক বিশাল অর্থনৈতিক মূল্যমান। এই মাছকে নিয়ে পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক আলোচনার জল গঙ্গা-পদ্মায় কম গড়েনি। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই আমার ঘরের বর্ষাদেবী বর্ষাভাত নিয়ে উপস্থিত আমারই সামনে! এবার ভেতর থেকে সত্যি সত্যিই চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম, আহ্ রে ইলিশ! আহা রে ইলিশ।

লেখক: ট্রেনিং ম্যানেজার, ওয়ার্ল্ডফিশ, খুলনা