যে আড্ডায় স্বামীরা থাকে না

কিটি পার্টিতে শুধু খাওয়াদাওয়া হয় তা নয়। অনেক আলোচনাও হয়। মডেল হয়েছেন ফারহানা জয়া, বুড়ি অালী, জিনিয়া ও রুপো শামস (বাঁ থেকে)। ছবি: কবির হোসেন
কিটি পার্টিতে শুধু খাওয়াদাওয়া হয় তা নয়। অনেক আলোচনাও হয়। মডেল হয়েছেন ফারহানা জয়া, বুড়ি অালী, জিনিয়া ও রুপো শামস (বাঁ থেকে)। ছবি: কবির হোসেন

ঢাকায় থাকেন শাহরীন ইমা। বিয়ে হয়ে যায় স্কুলের গণ্ডি পার হতে না হতেই। স্বামীর সরকারি চাকরি। তাই আজ এখানে তো কাল সেখানে। দেখতে দেখতে দুই সন্তানও অনেকটা বড় হয়ে গেছে। ছয়-সাত বছর আগে হঠাৎই ফেসবুকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে নিয়েছিলেন ইমা। সেখানেই ধীরে ধীরে তাঁর বন্ধু, সহকর্মীদের প্রায় সবাইকেই খুঁজে পান। ‘আমার এই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের খুঁজে পেয়ে যোগাযোগ করে একসঙ্গে একবার বসলাম একটা জায়গায়। এরপর কয়েক বছর ধরে আমরা অন্তত দুই মাসে একবার করে বন্ধুরা দেখা করছি কোথাও না কোথাও। কখনো কারও বাসায়, কখনো রেস্তোরাঁয়।’ এই যে নিয়ম করে ইমাদের বসা হয়, সেখানে যাঁরা থাকেন তাঁদের সবাই মেয়ে। এ আড্ডায় স্বামীরা থাকে না।
বেশি দিন আগের কথা নয়। বাড়ির মায়েদের পুরোটা সময়ই স্বামী আর সন্তানদের জন্য খরচ হয়ে যেত। যাঁরা চাকরিজীবী তাঁদের কাজের বাইরের জীবনটাও পুরোপুরিই পরিবারভিত্তিকই ছিল। নিজের জন্য কোনো সময়ই যখন আর থাকে না, তখন তাঁরা ডুবে যান হতাশায়। আবার কখনো মনের মধ্যেও জন্ম নিতে থাকে অতৃপ্তির অনুযোগ। যখন থেকে মেয়েরা বাইরে কাজ করতে শুরু করলেন, তখন থেকেই যেন একটু একটু করে নিজের জন্য সচেতন হয়ে উঠলেন। আর পরিবারের বাইরে তাঁদের জগৎটাও বড় হতে থাকল। পুরোনো সহপাঠী, বন্ধু, সহকর্মী আর নতুন গড়ে ওঠা প্রতিবেশী বা সন্তানের স্কুলের বন্ধুদের মায়েরা এলেন এই দলে। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে এসে ১৫-২০ এমনকি ৩০ বছর পরও কেউ কেউ খুঁজে পাচ্ছেন তাঁদের পুরোনো বন্ধুদের। কিন্তু খুঁজে পেয়েই কি শেষ? না। দেখা হওয়াটাও জরুরি। আর তাই কখনো দুপুরের লাঞ্চ বা বিকেলের চা এমনকি আয়োজন করে রাতের খাবারটাও সারছেন তাঁরা কোনো এক রেস্তোরাঁয় বা কারও একজনের বাড়িতে। আর নিয়ম করে পরবর্তী সময়ে একইভাবে বসা হয়তো অন্য কোথাও।
এ ধরনের আয়োজনের পুরোটাজুড়েই নারীদের দখল। কিন্তু তাই বলে অন্যরা যে বাঁকা চোখে দেখবে, ব্যাপারটা তার কিন্তু অবকাশ নেই। সমাজে এ ধরনের সামাজিকীকরণ জরুরি বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন মনে করেন, এ ধরনের মিথস্ক্রিয়া (ইন্টার-অ্যাকশন) একঘেয়েমি দূর করে। আর মেয়েরা একসঙ্গে কেবল পরচর্চা বা পরনিন্দা করেন সমাজের এই ধারণা পুরোটাই ঠিক নয়। বরং অন্যদের সম্পর্কে জানা এবং নিজের সম্পর্কে জানিয়ে একধরনের বন্ধন গড়ে ওঠে। এ ধরনের গ্রুপে সৃজনশীল কাজগুলো সম্পর্কেও অনেক আলাপ-আলোচনা হয়। আর এতে সর্বোপরি সমাজই উপকৃত হয়।

একঘেয়েমি কাটাতে এমন আড্ডা তো হতেই পারে
একঘেয়েমি কাটাতে এমন আড্ডা তো হতেই পারে

মেয়েদের এ ধরনের সামাজিক মিথস্ক্রিয়াকে ‘কিটি পার্টি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, আবার এখন তার সীমানা শুধু বসার ঘরের আড্ডায় সীমাবদ্ধ নেই। এ আয়োজন বাড়ির গণ্ডি পেরিয়ে এখন বাইরেও হচ্ছে। নারী উদ্যোক্তা তুতলী রহমান বললেন, ‘প্রত্যেক মানুষেরই তার নিজের জীবনকে উপভোগ করার অধিকার রয়েছে। একটা মেয়ে যত বেশি বাইরে যাবে আর ১০ জন মেয়ের সাথে মিশবে সে ততটাই সমৃদ্ধ হবে। মেয়েদের এ ধরনের দলে যে শুধু খাওয়া-দাওয়া হয় তা নয়। বরং অনেক ধরনের আলাপ-আলোচনাও হয়। পারিবারিক কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে খানিকটা পরামর্শও করে নেওয়া যায় গ্রুপের অন্যদের সঙ্গে। অনেকে উৎসব আয়োজন চিন্তা করে সেই বিশেষ দিনটিতে হয়তো কেউ কেউ একটা বিশেষ ভাবনা বা থিম ধরে পুরো আয়োজন করেও থাকে। থিম অনুযায়ী সবাই একই ধরনের পোশাক পরে এল আর নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলল। তারপর সেই ছবি গেল ফেসবুকে। নিজের জন্য এই বাড়তি যত্ন বা আয়োজন—এটাই বা কম কিসের।’
তুতলী রহমানের অভিজ্ঞতা বলে এ ধরনের দলগুলোতে যাঁরা থাকেন, তাঁরা একে অন্যের বিপদে-আপদে এগিয়ে যান সবার আগে। এখানে এমন এক বন্ধন তৈরি হয় যা একজন নারীকে চিন্তা করতে শেখায় পরিবারের বাইরেও যে তার বড় আরেকটি পরিবার আছে এবং সে একা নয়।
যাঁরা নিয়মিত এ ধরনের আয়োজনে অংশ নেন সেইসব মেয়েদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাঁদের আয়োজনের ছবি ফেসবুকে দিতে তাঁরা খুব ভালোবাসেন। আবার স্বামী, শাশুড়ি কিংবা ননদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার নানা কৌশল থেকে শুরু করে ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়তে যাওয়া কিংবা অফিসের বস সামলানো সব আলোচনাই এই আড্ডায় স্থান পায়। এমনকি নিজেদের মনের বিভিন্ন অনুভূতি নিয়েও আলাপ আলোচনা হয়। উইকিপিডিয়ায় কিটি পার্টির সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে দুটি। ভারত ও পাকিস্তানে যেসব অনুষ্ঠান নারীরা আয়োজন করেন, সেসবই কিটি পার্টি বলা হয়েছে এক সংজ্ঞায়। আবার আরেকটিতে দেখা যাচ্ছে, দল বা গ্রুপের একজনের পর আরেকজন আয়োজনটা করছেন। খাবার ও বসার জায়গার ব্যবস্থাও তিনি করেন। আমাদের এখানে দেখা যায় অনেক সময় এ রকম আয়োজনে একেকজন একেকটা খাবারের পদ নিয়েও হাজির হন। অনেক দল আবার বছরে অন্তত একবার বাইরে বেড়াতেও যায়। এই যে একসঙ্গে মেয়েরা মেয়েরা আড্ডা দেওয়া—সেখানে অর্থবহ কিংবা অর্থহীন দুরকমের গল্প–সল্পই
চলতে থাকে। চলতে থাকে অবিরাম হাসি কিংবা খুনসুটি।
মাহবুবা নাসরীন মনে করেন, এ ধরনের মিথস্ক্রিয়া যত বেশি হবে, ততটাই ভালো। তবে লক্ষ রাখতে হবে, তাতে যেন অনেক বেশি সৃজনশীলতা থাকে। আর নেতিবাচক দিকগুলো এড়িয়ে যত বেশি সম্ভব ভালো বিষয়ের চর্চা করতে হবে। চাকরিজীবী বা সংসারী যে কোনো নারীর সৃজনশীলতা এবং পারস্পরিক যে যোগাযোগ তাতে আস্থা রাখতে হবে। আর এভাবেই গড়ে ওঠে নারীদের অন্য ভুবন।