ফাস্টফুডকে 'না'!

সন্তানের বাইরে খাওয়ার অভ্যাস বদলানোর আগে মা–বাবার অভ্যাস বদলাতে হবে। মডেল: রাজেশ্বরী ও রুনা খান, ছবি: অধুনা
সন্তানের বাইরে খাওয়ার অভ্যাস বদলানোর আগে মা–বাবার অভ্যাস বদলাতে হবে। মডেল: রাজেশ্বরী ও রুনা খান, ছবি: অধুনা

ছয়-সাত বছর বয়স পর্যন্ত আমার মেয়ের প্রিয় টিফিন ছিল চিকেন নাগেট। ব্যাপারটা মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। তা জেনেও একজন চিকিৎসক হয়েও স্কুলের ব্যাগে এ রকম খাবারই ভরে দিতে হতো প্রায়, কেন তা আজকালকার যেকোনো কর্মজীবী ব্যস্ত মা-ই জানেন। কিন্তু মাঝেমধ্যেই পেটের ডান দিকে ব্যথা হতো ওর। বেশ ভালো রকমের ব্যথা, কেঁদে ফেলত, পেট চেপে বসে পড়ত অনেক সময়। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসকের কাছে ছোটাছুটি করেও ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না জিনিসটা কী। কেউ বলে অ্যাপেন্ডিসাইটিস, কেউ বলে কিছু নয়—সাইকোলজিক্যাল। উদ্বিগ্ন হয়ে আমাদের এক প্রিয় শিক্ষকের কাছে নিয়ে গেলাম ওকে। স্যার সবকিছু দেখেশুনে বললেন, বাড়িতে তৈরি টাটকা খাবারে বাচ্চাদের অভ্যাস করো। কষ্ট হবে প্রথম দিকে, তবু এটা দরকার।
তারপর আমরা ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে বসলাম। বিস্তারিত আলাপ করলাম। ওর চার বছরের বড় ভাই ইন্টারনেট থেকে নামিয়ে আনল এ ধরনের খাবারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তথ্যগুলো। আমরা একসঙ্গে সব পড়লাম। ছেলেমেয়েকে বোঝালাম। ছবি দিয়ে দেখালাম কী কী হয় এসব খাবার খেলে। বড় বড় বিজ্ঞানীরা ক্রমাগত বলে চলেছেন বাইরের খাবারের অপকার সম্পর্কে। এসবের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে অনেক বড় বড় রোগবালাইয়ের ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে, তা-ও বললাম। ওরাও মেনে নিল যে এগুলো ভালো নয়। কথা দিল, তারা এ নিয়ে আর বায়না ধরবে না। সেই থেকে আমার মেয়ে যুনাইরার আর পেটে ওই ব্যথাটা হয়নি। আর ধীরে ধীরে সত্যি ওরা এসব বদভ্যাসকে বিদায় জানাতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি বাইরে খেতে গিয়েও আমরা খাবারের সঙ্গে পানি অর্ডার দিতে অভ্যস্ত হয়েছি।
পছন্দের কোনো কেনা খাবার ওদের জন্য বরাদ্দ করেছি মাসে একবার। টিফিনে সবজি রুটি, বাড়িতে তৈরি স্যান্ডউইচ বা ফলমূল দিলে ওরা আর বিরক্ত হয় না। যুনাইরার স্কুলে যখন বাচ্চাদের লিখতে দিয়েছিল যেকোনো বিষয় নিয়ে ১০টা বাক্য সে তখন লেখে ফাস্টফুডের অপকারিতা সম্পর্কে। কীভাবে ওর ক্লাসের অন্য বন্ধুরা এতে আসক্ত এবং এটা কত ÿক্ষতি করছে সমাজের, সে সম্পর্কে ১০ লাইন লিখে ফেলে সে দ্রুত। শিক্ষকেরা যারপরনাই অবাক হন প্রথম শ্রেণির এক শিশুর লেখা পড়ে; সবাইকে সেটা পড়েও শোনান। এখন অন্যদের ফাস্টফুড খেতে দেখলে ওর আর হিংসা হয় না বরং ওই শিশুর জন্য খারাপ লাগে। সে না জেনে কত ক্ষতি করছে নিজের, তাই না মা—বলে সে।
‘আমার বাচ্চা তো চিকেন ফ্রাই ছাড়া কিছু খেতেই চায় না।’ ‘আমারটা তো ভাতই খায় না, প্রতি বেলায় ওর ফাস্টফুড চাই।’ ‘এগুলো না দিলে তো ও না খেয়েই থাকবে।’ মায়েরা এখন সন্তানদের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে এই কথাগুলোই বলে থাকেন। কিন্তু ভেবে দেখুন তো, অভ্যাস পরিবর্তনের কোনো চেষ্টা কি সত্যি আপনি করেছেন? সত্যি কি আপনি এ বিষয়ে সচেতন ও জোরদার ভূমিকা রাখছেন পরিবারে? নাকি ফাস্টফুড আপনার জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে বলে আপনিও ব্যাপারটা মেনেই নিয়েছেন।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, উন্নত দেশে শিশুরা ফাস্টফুড থেকে দৈনিক ১৬০ ক্যালরি ও টিনএজাররা দৈনিক ৩১০ ক্যালরি গ্রহণ করে থাকে। আর এ কারণে তারা শিকার হচ্ছে স্থূলতার, আর ঝুঁকি বাড়ছে হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ইত্যাদি রোগের। ৩০টা দেশের পাঁচ লাখ শিশু ও টিনএজারের ওপর এক জরিপে দেখা যায় যে যারা সপ্তাহে তিন দিন কোনো না-কোনো ফাস্টফুড খায়, তাদের অ্যালার্জি ও হাঁপানির ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে যায়। আপনার শিশুটি অপরিচ্ছন্ন অবিশুদ্ধ পানি খেতে চাইলে আপনি কিছুতেই তা দেবেন না, কেননা, তার কারণে সে অসুস্থ হতে পারে। তবে ফাস্টফুড খেতে চাইলে তা অবলীলায় কেন দিচ্ছেন? এটাও তো স্বাস্থ্যগত নানা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে সন্তানের। সন্তানের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন সবচেয়ে বেশি আপনিই; আর তার আর দেরি নয়। কীভাবে করতে পারেন সেটা?
* পড়তে বসা, ফল ভালো করা, আদবকায়দা শেখানো, কত কিছুই না নিয়ে নানা উপদেশ আর কথা বলে চলেছেন প্রতিদিন। খাবার নিয়ে কখনো বলেছেন? কোনটি ভালো কোনটি খারাপ। কেন ভালো কেন খারাপ। তাই কথা বা আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিদিন কিছু না কিছু এ বিষয়ে বলুন। গবেষণা, উপাত্ত, তথ্য দিয়ে বোঝান। শিশুরাও ভালোমন্দ বোঝে। ইন্টারনেটে এ বিষয়ে অনেক তথ্য পাবেন। সন্তানকে উৎসাহিত করুন গেম না খেলে বরং খাবারদাবারের ভালোমন্দ নিয়ে একটু দেখুক।
* সন্তানকে প্রভাবিত করতে হলে প্রথমে নিজেকে বদলে ফেলতে হবে। তাই নিজেকেও বদলান। বলুন, দেখো আমিও ছেড়ে দিয়েছি কোমল পানীয় পান করা। চলো, সবাই মিলেই ছাড়ি।
* বাইরের খাবার বা ফাস্টফুড-জাতীয় খাবার সীমিত করুন ধীরে ধীরে। মাসে এক বা দুই দিন বা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানেই কেবল এগুলো আনা হবে, সব সময় নয়। এমন একটা রীতি তৈরি করুন।
* বাইরে খেতে গেলে অপেক্ষাকৃত স্বাস্থ্যকর খাবার বেছে নিতে শিক্ষা দিন। যেমন স্টার্টার হিসেবে ভাজা বা ফ্রাই না নিয়ে সালাদ। কোমলপানীয় না নিয়ে ফলের রস বা পানি। ডাবল সাইজের বার্গার, চিকেন বা পিৎজা না নিয়ে ছোট সাইজেরটা নিন।
* প্রতিদিনের টিফিনে কেনা খাবার অবশ্যই বর্জনীয়। টিফিনে ফলমূল ও বাড়িতে তৈরি খাবার দেবেন। স্কুলে অন্যরা এ নিয়ে হয়তো হাসাহাসি করবে, কিন্তু তার জবাবে যুক্তি দিয়ে কী বলতে হবে তা-ও শিখিয়ে দিন।
* এসব খাবার কিনতে গিয়ে যে বাড়তি খরচটা হয়, সেটা হিসাব করে সন্তানকে প্রতি মাসে একটা পছন্দের খেলনা বা বই বা উপহার কিনে দিতে পারেন। ওই খাবারটা কেনা হলে এটা তুমি পেতে না—এটা স্পষ্ট বলে দিন।
লেখক: চিকিৎসক