তৃতীয়পক্ষ থেকে সাবধান!

তৃতীয়পক্ষের প্রবেশ সংসারে যত কম হয়, ততই ভালো। মডেল: আজাদ, কেয়া ও শোভা। ছবি: সুমন ইউসুফ
তৃতীয়পক্ষের প্রবেশ সংসারে যত কম হয়, ততই ভালো। মডেল: আজাদ, কেয়া ও শোভা। ছবি: সুমন ইউসুফ

নাক গলানো বা ‘নোজপোকিং’ শব্দটি বহুল প্রচলিত। কারও এই স্বভাবের কারণে চারপাশের মানুষের জীবনে নেমে আসে অহেতুক অশান্তি। পরিস্থিতি হয়ে ওঠে বিব্রতকর। দেখা দেয় সন্দেহ; কানকথার চালাচালিটাও বেড়ে যায় অনেক সময়। মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যাঁরা ‘নাক গলিয়ে’দের প্রশ্রয় দেন; তাঁরা সব সময়ই মানসিকভাবে দুর্বল প্রকৃতির হয়ে থাকেন। নিজেদের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা তাঁদের কম। এ সুযোগটাই নেয় তৃতীয়পক্ষ। শুভাকাঙ্ক্ষী বা পরম উপকারীর ছদ্মবেশে এরা অন্যের নানা সমস্যায় ঢুকে পড়ে; নানা রকম উড়ো-উটকো বুদ্ধি-পরামর্শ দেয়; সদুপদেশের মোড়কে কূটকচালী করে—তাতে সমস্যা বাড়ে বই কমে না। এই জীবনসংসারের চারপাশের মানুষের রূপ বড় বিচিত্র। কে সুজন, কে কুজন—সব সময় বোঝা সহজ নয়।

.
.

এটা ঠিক, সংসারজীবনে এই তৃতীয়পক্ষের উপস্থিতি একেবারে অস্বীকার করা যায় না। এরা পরিবারে, আত্মীয়মহলে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে—সব খানেই ছড়িয়ে আছে।
একজন চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা থেকে বলি—একমাত্র উপার্জনক্ষম বড় ভাই হুট করে বিয়ে করেছেন। পাগলের মতো পছন্দ করে বিয়ে। এটা মা, বোন কেউ মেনে নিতে পারেননি। যৌথ সংসারে সবার মন রক্ষা করে চলাটা বড় ভাইয়ের জন্য মানসিক, অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি করল। স্ত্রীর অগোচরে মা, কখনোবা বোন তাঁকে কানপড়া দিতে কসুর করেন না। পাশে থাকেন চাচি। তিনি আরেককাঠি এগিয়ে। সবাই দুষছেন লোকটার বিয়েকে। সোজা কথায় তাঁর বউকে। অথচ ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীর কোনো কথা একেবারেই আমলে নেন না। আত্মীয়স্বজনের সব কথাই তাঁর কাছে ঠিক। স্ত্রীই সব সমস্যার মূল। এ কারণেই আজ তাঁদের সংসারে ভাঙন ধরতে যাচ্ছে। ফলাফল হলো বউটি মহাদুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ভর্তি হলেন শ্বাসকষ্ট, অজ্ঞান হওয়ার রোগ নিয়ে। স্বামী বেচারা চারপাশের নানা কথার বাণ সইতে না পেরে শিকার হলেন মনোরোগের।
স্বামী-স্ত্রীর সংসার শান্ত, সচল, সৃজনশীল ও কল্যাণপ্রসূ অবস্থায় থাকুক—এটাই সবার কাম্য। আমরা এমন স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। কিন্তু যাপিত জীবনের রসায়ন সব সময় কল্যাণচিন্তার সমান্তরালে চলে না। আবার তৃতীয়পক্ষও সংসার-পরিবারেরই যেন অংশ।
হিংসা, মনের জ্বলুনি, অন্যের ভালো দেখতে না পারা—এসব মানবমনেরই অভিব্যক্তি। কমবেশি এই প্রবৃত্তিতে ভোগে অনেকেই। এরাই নাক গলায় কারণে-অকারণে। অন্যের ভালো এরা মন থেকে দেখতে চায় না। আশপাশের স্বজন-পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের জীবনে যাতে জটিলতা লেগে থাকে—তৃতীয়পক্ষ এ জন্য সব সময় আশায় থাকে। কারণ জটিলতা থাকলেই তাদের মূল্যায়ন হবে বেশি।
‘নোজপোকিং’-এ বিশেষজ্ঞরা সহাস্যে বাণীও দেন—সংসার, চাকরিক্ষেত্রে বা যেকোনো প্রশাসন চালাতে এই কূটকচাল বড় প্রয়োজন। নয়তো প্রশাসন চালানো কঠিন—এমন মত এঁদের।
সংসারকে ছোটখাটো একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনে যেসব সমস্যা থাকে, এখানেও সেটা স্বাভাবিক। এখানে পক্ষপাতদুষ্টতা একটি সাধারণ চিত্র। তার মধ্যে কানকথা বলার মতো লোক যদি থাকে আর তা বিশ্বাস করা হয়, তবে সংসার কুরুক্ষেত্র হতে বেশি দিন লাগে না।
দাম্পত্যজীবনের কোনো গোপন কথা কেউ বন্ধুদের কাছে মন হালকা করার জন্য বললেন। অনেক সময় দেখা যায়, তা নিয়ে সেই বন্ধু বা বান্ধবীর মগজে-মননে কূটচাল জট পাকাতে থাকে। ভুক্তভোগীর সংসারে উটকো ঝামেলা করার সুযোগ ঠিকই সে খুঁজে নেয়। আর তাতে স্বামী-স্ত্রীর দূরত্ব বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে ভাঙনের দিকে গড়ায়। বাস্তব জগতে বটেই; টিভি সিরিয়ালেও হরহামেশাই এ ঘটনাগুলো
দেখা যাচ্ছে।

কী করণীয়
 দাম্পত্যজীবনে স্বামী-স্ত্রী শুধু একটা কাগুজে সম্পর্ক নয়। সবচেয়ে বড় বিশ্বাস, আস্থা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তাকে অটুট রাখতে পারস্পরিক সন্মানবোধ থাকাটা জরুরি। এই বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ককে কেন্দ্র হিসেবে ধরে নিতে হবে। যাতে কোনো ধরনের ঝড়ঝাপটায় হেলে বা ভেঙে পড়তে না পারে।
 কোনো গোপন বিষয় পারতপক্ষে অন্যের সঙ্গে আলোচনা না করাই ভালো। আগে নিজেরা আলোচনা করে নিন। তারপর প্রয়োজন হলে অন্যের সুপরামর্শ নিন।
 কোনো সমস্যার মুখোমুখি হলে সবার সামনে ভেঙে পড়বেন না। নিজেকে সামলে নিন। আত্মমূল্যায়ন করুন। সমস্যা যার সঙ্গে, ধৈর্য ও সহনশীলতা নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনায় বসুন। নিজের কথা ও যুক্তি বলুন। তার কথাও ততোধিক গুরুত্ব দিয়ে শুনুন।
 সংসার, পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্রে মানুষজনকে নিয়েই যাপিত জীবনের জীবন্ত চিত্রনাট্য। চারপাশের চরিত্রগুলোকে গুরুত্ব অনুযায়ী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যায়ন করুন। কাউকে বৈরী করা যেমন ঠিক নয়, তেমনি অতিমূল্যায়ন করাও উচিত নয়।
 জীবনের কয়েকটা ভাগ—শৈশব, কৈশোর, যৌবন-মধ্য বয়স ও বার্ধক্য। এক পর্বের একেকরকম চ্যালেঞ্জ। দায়দায়িত্ব, বিবেচনাবোধ বয়সের সঙ্গে মানানসই হওয়া দরকার। যে বয়সে যার প্রতি যা দায়িত্ব ও কর্তব্য, তা নিয়ে আমাদের সচেতন থাকা উচিত।
 আবেগ নয়—কর্তব্য, দায়বোধ, দায়িত্বপালন ও কর্ম দিয়ে নিজেকে সব সময় স্মার্ট ও আপ টু ডেট রাখুন।
 কাউকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করবেন না। আবার কাউকে অতিরিক্ত অবহেলা, অবমূল্যায়ন করবেন না। এই ভারসাম্য বড় গুরুত্বপূর্ণ। দাম্পত্য সুখ; সমাজ-সংসারের সামষ্টিক সুখ সবাই ধরে রাখতে পারে না। ধরে রাখতে চাই পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও নির্ভরতার আশ্বাস।

বিজ্ঞজনেরা বলেন
খ্যাতিমান আইরিশ অভিনেতা-কথক ব্রেনডেন গ্লিসনের পরামর্শ হলো, ‘আমার জীবন, আমার পছন্দ-অপছন্দ; আমার শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা, আমার ভুলত্রুটি—এসব একান্তই আমার। সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হলো, এসবে অন্যকে নাক গলাতে না দিয়ে নিজেই আত্মপর্যালোচনা করা।’
তাই বলে কি তৃতীয়পক্ষের কথা একদমই শুনবেন না? কে ক্ষতিকর তৃতীয়পক্ষ, সেটা যাচাই করাও তো বড় মুশকিল।
লেখক-পরামর্শক সোনিয়া পার্কার বলছেন, ‘যারা অযাচিত পরামর্শের ডালি নিয়ে আপনার কাছে আসে, তাদের চিনে রাখুন। দক্ষতার সঙ্গে যাচাই করুন। তাদের বদঅভ্যাস থেকে নিজেকে রক্ষা করুন। যদি অন্যের জীবনে নাক গলানো থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেন; তবে নিজের জীবনকে সুন্দর করে সাজাতে আপনি আরও বেশি সময় পাচ্ছেন।’
রাজনীতিক ও গ্রিসের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টোনিস সামারাসের সরস মন্তব্য, ‘তৃতীয়পক্ষের অভিমত হলো বিমানযাত্রীর গ্রুপ ইনস্যুরেন্সের মতো, খুবই লোভনীয় ও আকর্ষণীয়। কিন্তু বিরল ক্ষেত্রেই এগুলো লাভজনক হয়। পরামর্শ যদি নিতেই হয়, তবে তাঁর নিন; যিনি আপনার আইনজীবীর মতো মামলার হার-জিতের দায় নিয়ে আপনাকে বুদ্ধি বাতলে দিচ্ছেন।’

সুলতানা আলগিন : সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।