ডেঙ্গুজ্বর: আতঙ্ক নয়, প্রতিরোধ করুন

ডেঙ্গু জ্বরে শরীরের তাপমাত্রা বাড়ে এবং তীব্র ব্যথা থাকে। ছবি: অধুনা
ডেঙ্গু জ্বরে শরীরের তাপমাত্রা বাড়ে এবং তীব্র ব্যথা থাকে। ছবি: অধুনা

ডেঙ্গু ভাইরাসের মাধ্যমে এবং এই ভাইরাসবাহিত এডিস ইজিপ্টাই মশার কামড়ে হয়ে থাকে। ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণুবাহী মশা কাউকে কামড়ালে সেই ব্যক্তি চার থেকে সাত দিনের মধ্যে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়। এবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশা ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে। তবে ডেঙ্গু ছোঁয়াচে রোগ নয়।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক প্রধান ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, এই জ্বর এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে এটি শরীরে জটিলতা সৃষ্টি করে। তবে জ্বরে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে কয়েক দিনে ডেঙ্গু পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়।
ডেঙ্গুজ্বর কখন এবং কাদের বেশি হয়
মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, বিশেষ করে গরম ও বর্ষার সময়ে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বেশি থাকে। শীতকালে সাধারণত এই জ্বর হয় না বললেই চলে। শীতে লার্ভা অবস্থায় এই মশা অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারে। বর্ষার শুরুতে সেগুলো থেকে নতুন করে ডেঙ্গু ভাইরাসবাহিত মশা বিস্তার লাভ করে। সাধারণত শহর অঞ্চলে, অভিজাত এলাকায়, বড় বড় দালানকোঠায় এই প্রাদুর্ভাব বেশি, তাই ডেঙ্গুজ্বরও এই এলাকার বাসিন্দাদের বেশি হয়। গ্রামে বসবাসরত লোকজনের ডেঙ্গু কম হয়।

লক্ষণ কী
ডেঙ্গুজ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর এবং সেই সঙ্গে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। জ্বর ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়। এ ছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। জ্বর হওয়ার চার বা পাঁচ দিনের সময় শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা যায়। যাকে বলা হয় স্কিন র্যা শ, অনেকটা অ্যালার্জি বা ঘামাচির মতো। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব এমনকি বমি হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তি বোধ করে এবং রুচি কমে যায়। এই অবস্থাটা যেকোনো সময় জটিল হয়ে উঠতে পারে। যেমন অন্য সমস্যার পাশাপাশি যদি শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। যেমন চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, মাড়ি ও দাঁত থেকে, কফের সঙ্গে, রক্তবমি, পায়খানার সঙ্গে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, চোখের মধ্যে এবং চোখের বাইরে রক্ত পড়তে পারে। মেয়েদের বেলায় অসময়ে ঋতুস্রাব অথবা রক্তক্ষরণ শুরু হলে অনেক দিন পর্যন্ত রক্ত পড়তে থাকা ইত্যাদি হতে পারে।

কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন
ডেঙ্গুজ্বরের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। তবে এই জ্বর সাধারণত নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। তাই উপসর্গ অনুযায়ী সাধারণ চিকিৎসা যথেষ্ট। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই ভালো। যেমন
* শরীরের যেকোনো অংশে রক্তপাত হলে
* প্লাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে
* শ্বাসকষ্ট হলে বা পেট ফুলে পানি এলে
* প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে
* জন্ডিস দেখা দিলে
* অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা দেখা দিলে
* প্রচণ্ড পেটে ব্যথা বা বমি হলে।

চিকিৎসা কী
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগী সাধারণত ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। এমনকি কোনো চিকিৎসা না করালেও। তবে রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চলতে হবে। যাতে ডেঙ্গুজনিত কোনো মারাত্মক জটিলতা না হয়। সাধারণত লক্ষণ বুঝেই চিকিৎসা দেওয়া হয়।
* সম্পূর্ণ ভালো না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রামে থাকতে হবে।
* যথেষ্ট পরিমাণে পানি, শরবত, ডাবের পানি ও অন্যান্য তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে।
* খেতে না পারলে দরকার হলে শিরাপথে স্যালাইন দেওয়া যেতে পারে।
* জ্বর কমানোর জন্য শুধু প্যারাসিটামল জাতীয় ব্যথার ওষুধই যথেষ্ট। এসপিরিন বা ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ব্যথার ওষুধ কোনোক্রমেই খাওয়া যাবে না। এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়বে।
* জ্বর কমানোর জন্য ভেজা কাপড় দিয়ে গা মোছাতে হবে।

প্রতিরোধ কীভাবে
ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধের মূল মন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। জমানো স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এরা ডিম পাড়ে। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই সঙ্গে মশা নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
যেহেতু এডিস মশা মূলত এমন বস্তুর মধ্যে ডিম পাড়ে, যেখানে স্বচ্ছ পানি জমে থাকে। তাই ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোলা, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে।
ঘরের বাথরুমে বা কোথাও জমানো পানি পাঁচ দিনের বেশি যেন না থাকে। অ্যাকুয়ারিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ারকন্ডিশনারের নিচেও যেন পানি জমে না থাকে।
এডিস মশা দিনের বেলা কামড়ায়। তবে অন্য কোনো সময়ও কামড়াতে পারে। তাই দিনের বেলা শরীরে ভালোভাবে কাপড় ঢেকে বের হতে হবে, প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। ঘরের দরজা-জানালায় নেট লাগাতে হবে।
দিনের বেলায় মশারি টানিয়ে অথবা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমাতে হবে।
বাচ্চাদের যারা স্কুলে যায়, তাদের হাফপ্যান্ট না পরিয়ে ফুলপ্যান্ট পরিয়ে স্কুলে পাঠাতে হবে।
মশা নিধনের স্পে, কয়েল, ম্যাট ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য দিনে ও রাতে মশারি ব্যবহার করতে হবে।
ডেঙ্গু-আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই সব সময় মশারির মধ্যে রাখতে হবে, যাতে করে কোনো মশা কামড়াতে না পারে।

ডেঙ্গুজ্বরের মশা এ দেশে আগেও ছিল, এখনো আছে, মশা প্রজননের এবং বংশবৃদ্ধির পরিবেশও আছে। তাই একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে বাঁচা সম্ভব।

সাধারণ কিছু প্রশ্ন
গর্ভবতী মা আক্রান্ত হলে কি গর্ভের সন্তানও আক্রান্ত হয়?
গর্ভবতী মা আক্রান্ত হলে গভের্র সন্তানও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে এমন ঘটনা খুবই কম। তাই গর্ভবতী মায়ের এই সময়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধব্যবস্থা মেনে চলা উচিত।
ডেঙ্গু-আক্রান্ত মা কি তাঁর বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করাতে পারবেন?
হ্যাঁ, পারবেন। ডেঙ্গু-আক্রান্ত মায়ের তাঁর বাচ্চাকে দুধ পান করাতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ, মায়ের বুকের দুধের সঙ্গে এই জীবাণু ছড়ায় না।
লেখক: চিকিৎসক