আমার আব্বু

বাবার সঙ্গে লেখিকা
বাবার সঙ্গে লেখিকা

বাবা দিবসের প্রাক্কালেই যে শুধু তাঁর কথা লিখতে ইচ্ছে করে, তা নয়। মনে হয় প্রতিদিন কিছু না কিছু লিখি তাঁকে নিয়ে। খুব কম কথার মানুষ। আমাদের তিন ভাইবোনের মাঝে আপু তাঁর অতি প্রিয় (ছোটবেলা থেকে আদর্শ মেয়ে হিসেবে আপু নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন)। সুতরাং এটা অবাক হওয়ার মতো কোনো ঘটনা নয়। অবাক হওয়ার ঘটনা, একটা–দুটা কথায় স্বপ্ন এনে দেওয়া জীবনে। আমার জন্মের সময় ফারহানা হক নামে বিবিসিতে একজন নিউজ কাস্টার ছিলেন। তাঁর নামে নাম রাখা হয়েছিল আমার। একটু বড় হতেই শুনতাম তাঁকে বলতে, আমার মামণিকে আমি ডাক্তার বানাব (যে ডাক্তার আন্টির হাতে আমার জন্ম তাঁর মতো) বা ফারহানা হকের মতো বিবিসির নিউজ কাস্টার বানাব। তার পরপরই ‘The Sands of Dee’ আবৃতি করে প্রথম হলাম স্কুলে। আমাদের জ্বর হলে সারা রাত মাথায় পানি ঢালার কাজটা সব সময় আব্বুরই ছিল।

খেলাধুলা অনেকটা নেশার মতো ছিল আমার। খেলার আগে আগে মাসখানেক কলোনিতে দৌড় প্র্যাকটিস করতাম আব্বুর সঙ্গে। অত সকালে উঠে কাজের আগে কম ঘুম হবে মাসখানেক, শুধু স্প্রিন্টার হিসেবে কয়েক বছর ফার্স্ট হব বলে। এতটা উদারতা কত কঠিন, নিজে মা হওয়ার পর বুঝতে পারছি। কাজের সপ্তাহে বাচ্চাদের ড্রাইভ করে নিয়ে যেতেও কত কষ্ট লাগে। সুইমিংয়ের হাতেখড়িও কিন্তু তাঁর হাতে। আগে পুলে বার ছেড়ে একটু গভীর পানির দিকে যেতে ভয় পেতাম। ভয় ভাঙার পর থেকে সুইমিং মাস্টারের কাছে শিখতে শুরু করেছিলাম আমি আর আমার ভাই। পিঠাপিঠি হওয়াতে যত দুষ্টামির সঙ্গী ছিলাম আমরা। বরাবরই খুব ফাঁকিবাজ পড়াশোনায়। কিন্তু ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর মন স্বপ্নটুকু বাস্তবে পরিণত করেছে, সেটাতো আব্বুরই উৎসাহে।

তাঁর নিজের বাবা মানে আমার দাদা মারা গিয়েছিলেন যখন আব্বু ক্লাস টুতে পড়তেন। সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজেকে। অসম্ভব সৎ জীবনযাপন করে নিজে ভাইদেরও প্রতিষ্ঠিত করেছেন কোনো কিছুর আশা না করে। খুলনা বিএল কলেজে আমার চাচা, কাজিন থেকে শুরু করে অনেকেই বছরের পর বছর আমাদের বাসায় থেকে পড়া শেষ করেছেন। খুলনা নিউজপ্রিন্টের মতো প্রতিষ্ঠানে জেনারেল ম্যানেজার হয়ে রিটায়ার করার পরও ঢাকায় ছোট্ট পাখির নীড়ে আছেন তাঁরা। সততার শিক্ষা দিয়ে দিয়েছেন আজীবনের সাথি করে। সেদিন হঠাৎ আম্মুর সঙ্গে ফোনে কথা বলছি, আব্বু জিজ্ঞেস করলেন আমাকে জিজ্ঞেস করতে, ক্লাস ফাইভ, এইট বা এসএসসিতে স্কলারশিপ পেয়েছিলাম, এগুলো আমাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল কিনা। হতভম্ব হয়ে আব্বুকে জিজ্ঞেস করলাম, কত বছর চাকরি করছি আপনার মনে আছে আব্বু?

ডিবেট কমপিটিশনের জন্য বা মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার জন্য কতবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল গিয়েছি আব্বুর সঙ্গে হিসাব নেই। চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি হয়ে কতবার সময়ের আগে টাকা শেষ করে ফেলেছি। তখন ব্যাংকের মাধ্যমে বা কুরিয়ারে টাকা আসতে সময় লাগত। বিসিআইসির কলিগের মাধ্যমে বা ইমার্জেন্সি কুরিয়ারে টাকা পাঠাতেন আব্বু। একবার আগের দিন মন খারাপ করে বললাম, আব্বু টাকা শেষ, পরদিন দুপুরে আব্বু হাজির।

গানের খুব ভক্ত ছিলেন তিনি। কত দিন সকালে ‘ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে আমি বনফুল গো’ বা ‘বনের তাপস কুমারী আমি গো সখী মোর বনলতা’ শুনে ঘুম ভেঙেছে। জাতীয় কবি নজরুলের ভক্ত ছিলেন তিনি। নজরুলের সব সৃষ্টির একনিষ্ঠ ভক্ত আমি সেই কোন ছেলেবেলা থেকে।

সময়ের দাবিতে এখন আমি দেশ থেকে অনেক দূরে। পাস করে এখানে চলে আসামাত্র আমাদের ছেলে আর মেয়ে এল জীবন আলো করে। পড়াশোনাটা যাতে শেষ করে প্র্যাকটিস করতে পারি তার জন্য কত দোয়া আব্বুর। কিন্তু আমেরিকার লাইসেন্সিং পরীক্ষা শেষ করে রেসিডেন্সি শেষ করে চাকরি নিলাম। তারপর বোর্ড সার্টিফায়েড হয়ে খুশি মনে দেশে গেলাম। দেখি আব্বুর মুখটা কালো। জিজ্ঞেস করতেই বললেন, তার মানে দেশে তুই আর কখনই ফেরত আসবি না? আব্বু আমি আপনার মতো খুব ইমোশনাল হয়েছি। এত বয়সেও যখন-তখন চোখে পানি আসে। এ দেশে আমার সবকিছু আছে, শুধু আপনারা নেই। সেদিন এক রোগী বলে বসলেন, এত মানুষের সেবা কর, অথচ যাঁরা এত কষ্ট করে ডাক্তার বানিয়েছে তাঁদের জন্য কিচ্ছু করতে পার না। সত্যি তো, একটা সাধারণ গিফট দিলেও নিতে চান না​।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হওয়াতে প্রায়ই অনেক কিছু ঠিক করে দিই। আব্বু ভেরিফাই করেন। একটু আরাম হলেই আম্মুকে বলেন, তোমার মেয়ে খুব ভালো ডাক্তার হয়েছে। কিন্তু আমি বুঝি ওনার সেই বাগানে বাগানে প্রজাপতি ধরে বেড়ানো ছোট মেয়ের এত বড় হয়ে হাজার মাইল দূরে চলে আসাটা একদম পছন্দ না। একবার লস অ্যাঞ্জেলেসে এসে আমাদের সংসার দেখে চোখে পানি নিয়ে আম্মুকে বলেছিলেন, আমার মেয়ে এত কষ্ট করে।

পৃথিবীর সব বাবারা খুব খুব খুব ভালো থাকুন। আপনাদের ছায়াটুকু সব সন্তানের খুব দরকার। ভালোবাসাটুকু খুব দরকার।