দেশে থাকতে একটা ছাত্রাবাসের ছোট্ট একটা দায়িত্বসহ অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে নিয়মিত ফুল দেওয়া হতো, একুশের প্রথম প্রহরে যাওয়া হতো পাঞ্জাবি–পাজামা পরে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য প্রভাতফেরিতে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অন্য রকম শিহরণ জাগত। দোয়া করতাম তাঁদের আত্মার মাগফিরাতের জন্য, যাঁদের ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল আমার মায়ের ভাষা।
এবার দেশের বাইরে থাকার কারণে সেসবের কিছুই করা হয়ে ওঠেনি। রোজকার দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত মুখ নিয়েই উঠেছি সেদিনও। তবে চেষ্টা ছিল দু–একজন বিদেশি বন্ধুকে হলেও আজকের দিনের মহত্ত্ব তাদের শেখানো। কারণ, দিনটি আর শুধু বাংলার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না থেকে ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। এ দিনটি এখন সব মায়ের ভাষাকে সম্মান জানানোর দিন। আমার কয়েকজন বন্ধু বেশ আগ্রহ দেখাল ৫২কে জানার। আমার সাধ্যমতো জানানোর চেষ্টা করেছি।
তবে যখন দেশের দিকে তাকাই, তখন শুধু লোক দেখানো চেতনাই মনে হয় আমার কাছে। খুব কষ্ট পাই যখন দেখি অ, আ, ক, খ লেখা জামাকাপড় পরা, শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে হাসি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে শহীদের আত্মাকে ভ্রুকুটি করা৷ এ শুধু ছবি তোলার অনুষঙ্গ, সম্মানের নয়, তখন মনটাই খারাপ হয়ে যায়।
কয়েক দিন ধরে দেখছি পত্রিকার পাতায়, অনেক বোন লাঞ্ছিত হয়েছে বইমেলায় এসে। দেখার কেউ নেই। অসভ্য আর বর্বর জাতির খেতাব কবে শেষ হবে, কবে সত্যিকারের চেতনায় উজ্জীবিত হবে বাংলার যুবসমাজ, তা একমাত্র স্রষ্টাই বলতে পারবেন।
ভাষার বিকৃতি সর্বদাই ঘটে চলেছে। বিভিন্ন ভাষা শেখা দোষের কিছু নয় বরং বাড়তি গুণ। সেই গুণের নিরর্থক অপচয় হয় আমাদের দেশে। আমরা যদি কিছু শিখি, সেটা ধ্বংসের কাজেই লাগাতে ভালোবাসি। আমরা সেসব ভাষা ব্যবহার করি এমনভাবে যে নিজের কষ্টে অর্জিত মায়ের ভাষাই একসময় বিকৃত করে ফেলি। যে জাতি স্বকীয়তা হারায়, তাদের জন্য মাথা তুলে দাঁড়ানো বেশ কঠিন।
তবু মনে মনে ক্ষীণ আশার দীপ জ্বেলে যাই৷ আমার সোনার দেশের সোনার মানুষ একদিন ঠিকই হৃদয়ের গহিনে লালন করবে সত্যিকারের চেতনা আর ঠিক এগিয়ে নিয়ে যাবে আমার মায়ের ভাষাকে স্বমর্যাদায় বিশ্বের দরবারে। সেই সত্যিকারের একুশের চেতনার স্বপ্ন দুচোখে নিয়ে চেয়ে আছি, আমি, আমরা আর পুরো বাঙালি জাতি।
(শিক্ষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ৷ বর্তমানে শিক্ষার্থী, Wageningen University and Research, Wageningen, The Netherlands)