করোনার ঢেউ বিতর্ক এবং টিকা প্রাপ্তি, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

করোনাভাইরাসের টিকা তৈরিতে কাজ করছেন গবেষকেরা
ছবি: রয়টার্স

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাস শনাক্তের কয়েক মাসের মধ্যেই এটি বিশ্বব্যাপী মহামারির রূপ নেয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নানা রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করে করোনা প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নিউজিল্যান্ড, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, ভুটান, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড। আবার কিছু দেশ যেমন অস্ট্রেলিয়া ও জাপান, করোনার প্রথম ঢেউ সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করার পর দ্বিতীয় ঢেউও নিয়ন্ত্রণ করেছে। অন্যদিকে, বিশ্বের অনেক দেশে, বিশেষ করে ভারত, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের অনেক দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউ এখনো শেষ হয়নি।

বাংলাদেশে করোনার প্রথম ঢেউ শেষ বা দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে কি না, সেটা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ ও গবেষক মনে করেন, অপর্যাপ্ত টেস্টিং, দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতিসহ নানা কারণে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া মুশকিল। এসব কারণে তাদের মতে, প্রতিদিন যেসংখ্যক করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হচ্ছে, বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান দেখলে সহজেই বোঝা যায়, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হয়েছে গত মে ও জুন মাসে। সংক্রমণের হার সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে কিছুটা কম হলেও করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেটা বলা যায় না। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে বা তুলনামূলকভাবে বেশি করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয়েছে। কাজেই বলা যায়, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউ এখনই শেষ হয়নি বা চলমান রয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, বাংলাদেশ করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ধীরগতির অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছে বলেই প্রথম ঢেউ চলমান রয়েছে। এমতাবস্থায়, করোনাভাইরাসের টিকার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

টিকা পাওয়া যেতে পারে, এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
ছবি: রয়টার্স

গত ৩ নভেম্বর অক্সফোর্ডের তৈরি করোনাভাইরাসের টিকার জন্য ভারতের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে প্রথম পর্যায়ে অক্সফোর্ডের তিন কোটি ডোজ করোনা টিকা সরবরাহ করবে সেরাম ইনস্টিটিউট। এই তিন কোটি টিকা ডোজ দুবার করে প্রতি ব্যক্তিকে দেওয়া হবে। কিন্তু সম্প্রতি জানা গেছে, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকা ট্রায়ালের ফলাফল ও অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয় (প্রথম আলো, ২ ডিসেম্বর ২০২০)। এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। গত ১ অক্টোবর দক্ষিণ ভারতের চেন্নাইয়ের বাসিন্দার শরীরে পরীক্ষামূলক টিকা প্রয়োগ করার পর তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় জানা গেছে, টিকা নেওয়ার কারণেই তাঁর শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে (সূত্র: বিবিসি বাংলা)। সুতরাং, ভারতের সেরামের করোনাভাইরাসের তিন কোটি ডোজ টিকা বাংলাদেশের জন্য যেমন অপ্রতুল, তেমনি আশাপ্রদ ফল নাও দিতে পারে। তাই বাংলাদেশের সরকারের উচিত টিকা প্রস্তুতকারক সব দেশ এবং সংস্থার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, যাতে উপযুক্ত এবং পর্যাপ্ত টিকা নিশ্চিত করা যায়।

ভারতে সেরাম ইনস্টিটিউটের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠান করোনার উপযুক্ত ও টেকসই টিকা তৈরি করার জন্য চেষ্টা করছে। সম্প্রতি, বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে যে ধনী দেশগুলো বেশির ভাগ করোনার টিকা অগ্রিম বুকিং দিচ্ছে। ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা ইকোনমিস্টের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধনী দেশগুলো সম্ভাব্য টিকার উৎপাদন সক্ষমতার অধিকাংশই কিনে ফেলেছে। গত ১২ নভেম্বরে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সম্ভাব্য টিকা পাওয়ার প্রতিযোগিতায় উন্নয়নশীল অনেক দেশ (যেমন: নেপাল, ভারত, ও ইন্দোনেশিয়া) থেকে পিছিয়ে আছে। আবিষ্কারে এগিয়ে থাকা টিকাগুলো যদি সফলও হয়, তবু ২০২২ সালের আগে বাংলাদেশসহ বিশ্বের দুই–তৃতীয়াংশ বা ৬১ শতাংশ মানুষ টিকা নিতে পারবে না বলে সতর্ক করেছে অক্সফাম (সূত্র: বিবিসি বাংলা)। তাই টিকা প্রাপ্তির এই দীর্ঘ সময়ে, লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা এবং তা বাস্তবায়ন করা বাঞ্ছনীয়।

মডার্নার ল্যাবে টিকা তৈরির কাজ চলছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

টিকা পাওয়ার প্রতিযোগিতার আশঙ্কা করেই গ্যাভি, সেপি এবং ডব্লিউএইচও কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস ফ্যাসিলিটি (কোভ্যাক্স) তৈরি করেছে। যেহেতু বড় দুটি দাতাদেশ চীন ও আমেরিকা কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটিতে যোগ দেয়নি, সেহেতু ডব্লিউএইচওর পরিকল্পিত এই আন্তর্জাতিক উদ্যোগ সফল নাও হতে পারে। যদি সফল হয়, কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির অধীনে বাংলাদেশসহ প্রতিটি দেশের ঝুঁকিপূর্ণ ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য টিকার নিশ্চয়তা দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। কিন্তু বাংলাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে কীভাবে টিকা বণ্টন করা হবে, সে–সংক্রান্ত একটি সুস্পষ্ট নীতিমালার অভাব রয়েছে। সুতরাং, বাংলাদেশ কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি থেকে করোনার টিকা পেলে সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে কীভাবে বণ্টন করা হবে, সে জন্য সরকারের সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত। এ ছাড়া সরকারের উচিত কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প পন্থায় টিকার ব্যবস্থা করা, যাতে বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যাকে টিকার কাভারেজের আওতায় আনা যায়।

করোনার টিকা নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন গবেষকেরা
ছবি: রয়টার্স

২ ডিসেম্বর বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্য ফাইজার/বায়োএনটেকের করোনার টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিও ডিসেম্বরেই টিকা দিতে শুরু করবে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ আগামী বছরের শুরুর দিকে করোনা টিকা পেতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, টিকা সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিতরণের সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে কি?

এক বাক্যে উত্তর দিলে বলতে হয়, বাংলাদেশের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) আওতায় জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও শিশুদের টিকা সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্য যে ব্যবস্থা আছে, তার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হলো মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু মর্ডানা ও ফাইজার যে এমআরএনএ প্রযুক্তিভিত্তিক টিকা তৈরি করেছে, তা সংরক্ষণ করতে হবে মাইনাস ৭০ থেকে ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়, করোনার টিকা সংরক্ষণের জন্য শীতল ব্যবস্থা থাকলেও পর্যাপ্ত নয়। জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে টিকা সংরক্ষণ ব্যবস্থা না-ই বললেই চলে। তা ছাড়া, রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় ও উপজেলায় টিকা পরিবহন ও বিতরণের জন্য যে পরিবহনব্যবস্থা ব্যবহার করা হবে, সেগুলোর উপযুক্ততা যাচাই করা উচিত।

পরিশেষে বলা যায়, গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউ চলমান। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করার মতো করোনাভাইরাসের টিকার সুফল পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বাংলাদেশ টিকা পেলেও তা সফলভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে তিন থেকে চার বছর সময় লেগে যেতে পারে। তাই একদিকে কার্যকর টিকা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের খুব শিগগির একটি জাতীয় কোভিড টিকা নীতিমালা তৈরি এবং তা বাস্তবায়ন করা উচিত, অন্যদিকে টিকা প্রাপ্তির এই দীর্ঘ সময়ে লকডাউন বাস্তবায়ন করার এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা উচিত।

লেখক: ড. মো. নাজমুল হুদা, অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের জনস্বাস্থ্য গবেষক এবং একাডেমিক। [email protected]। মো. উজ্জ্বল তালুকদার, প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়