চিঠি

এই ইন্টারনেট–ফোনের যুগে অপলার কাছে চিঠি আসে! এ ৪ সাইজের সাদা কাগজে একদম বাংলা ভাষায় হাতে–কলমে লেখা চিঠি! ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। কিন্তু অপলা কাউকে বলতে পারে না। কীভাবে বলবে? কে বিশ্বাস করবে তাকে? বন্ধুরা তো হেসেই খুন হয়ে যাবে! অপলার খুব লজ্জা করে বিষয়টা ভাবতে। অপলা এটাও জানে না কে এই পত্রলেখক? সে অপলার ঠিকানা কোথায় পেল? কিংবা মানুষটা অপলার সামনে আসে না কেন? কী তার উদ্দেশ্য?

এই নিয়ে চিঠির সংখ্যা দাঁড়াল আটষট্টি! প্রতিটি চিঠির পেছনে কী একজনের কর্মকাণ্ড? নাকি অনেকেই? হতেও তো পারে অপলার পরিচিত কেউ কিংবা কোনো বন্ধু মজা করছে তার সঙ্গে! দূর থেকে অপলার হতবাক হওয়া দেখে খুব মজা পাচ্ছে কিনা কে জানে? অপলা কোনো বিষয়েই আটকে থাকতে পারে না। ক্রমাগত নতুন নতুন চিন্তা তার মনে ভর করে। তবে অপলা খোঁজার চেষ্টা করে না একদম! পত্রলেখকের যদি সামনে আসার ইচ্ছে থাকে, সে নিজেই আসবে। ব্যর্থ খোঁজাখুঁজি করে সময় নষ্ট করার মেয়ে অপলা নয়।

কিন্তু অপলা শান্তি পায় না একটুও। যেদিন চিঠি হাতে পায়, তার মন কেমন ছটফট করতে থাকে। তার কেবলই মনে হয় কেউ তাকে দেখছে, অনুসরণ করছে, তার ব্যাপারে ভাবছে! তার মন বলে, কেউ তার ব্যক্তিগত জীবনে বিচরণ করে। যদিও অপলার এ রকম ভাবার সুযোগ একদম নেই। কারণ, কোনো চিঠিতেই অপলাকে উদ্দেশ করে কিছু লেখা হয় না। এমনকি চিঠির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোথাও অপলার প্রসঙ্গে কিছুই লেখা থাকে না! কিন্তু চিঠিগুলো পড়তে তার ভীষণ ভালো লাগে। এত সুন্দর হাতের লেখা সে কখনো দেখেনি। ভাববাচ্যে লেখা প্রতিটা লাইন অপলার হৃদয় ছুঁয়ে দেয়। চিঠিগুলো শুরু হয় খুব অদ্ভুতভাবে। কোনো সম্বোধন নেই! কুশল বিনিময় নেই। কোনো এক পরিচিত কবিতার পরিচিত লাইন দিয়ে শুরু হয়! তারপর শুধুই পত্রলেখকের প্রসঙ্গ! হয়তো কোনো দিন তার মন খুব ভালো, সে জানালায় দাঁড়িয়ে তারাভরা আকাশ দেখছে। সে রকম একটা রাতের অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা। অপলা মুগ্ধ হয়ে পড়তে থাকে। পড়তে পড়তে কখন যে তারাভরা আকাশের কল্পনায় চলে যায়, অপলা নিজেও বুঝতে পারে না। আবার হয়তো পত্রলেখক বেড়াতে গিয়েছে কোনো পদ্মফোঁটা দিঘির ধারে। সেই দিঘির গল্প পড়তে পড়তে অপলার মনে হয় সে নিজেই পদ্মফুলের মাঝে বসে আছে!

অপলা প্রতিটা চিঠি এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে যে তার দাঁড়ি–কমাসুদ্ধ মুখস্থ হয়ে যায়। তবু সে ধরতে পারে না পত্রলেখক ছেলে নাকি মেয়ে? বুঝতে পারে না পত্রলেখকের ব্যাপারে কোনো একটা সূক্ষ্ম অংশ, যার মাধ্যমে সে কোনো সূত্র খুঁজে পাবে! সত্য কথা বলতে তার খুব একটা ইচ্ছেও নেই প্রেরকের পরিচয় জানার! বেনামি চিঠি পাওয়াটা তার কাছে অবাক বিষয় হলেও সে খুব উপভোগ করছে। তার মনের অজান্তেই সে চিঠি পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছে। এই অপেক্ষায় কোনো আশা নেই, আকাঙ্ক্ষা নেই, ভরসা নেই। হয়তো হুট করে চিঠি আসা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। তবু অপলার কোনো মাথাব্যথা নেই। সে জানে, এসব আনন্দ ক্ষণিক থাকাই ভালো। কিন্তু এই আনন্দ উপভোগ করায় কোনো বাধা নেই।

মাঝেমধ্যে তার মনে হয়, এভাবে যদি সবাই চিঠি লিখত! সবাই যদি একে অপরের সঙ্গে চিঠি আদান–প্রদান করত। তবে কী মজাটাই না হতো! একটা সময় ছিল, যখন নাকি যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল হাতে লেখা চিঠি। অপলা মা–নানিদের কাছে শুধু গল্পই শুনেছে। এখন সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্যবশত ব্যাপারটার সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেল। তার মনে হয় চিঠির জন্য অপেক্ষা করার অনুভূতি কত সুন্দর তা যদি এই যুগের মানুষেরা জানত, তবে হয়তো সবাই চিঠি লিখত! চিঠি পড়ার সময় যে পত্রলেখকের আবেগকে ছুঁয়ে দেখা যায় তার হাতের লেখার মাধ্যমে, সে সুযোগ কি টাইপিং মেশিন কখনো দিতে পারবে?

সে প্রসঙ্গ না হয় থাক। অপলা ভাবে হুট করে একদিন যদি চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায়! অপলা ঠিক করল চিঠি আসা বন্ধ হলেও সে চিঠি লিখবে। চিঠির এত সুন্দর ব্যবহার সে নষ্ট হতে দেবে না। সে চিঠি লিখবে তার বন্ধু, আত্মীয়দের কিংবা তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, তার বাবাকে। তার বাবা মস্ত বড় প্রকাশনীর কর্ণধার। তিনি নিশ্চয়ই কত মানুষের সুন্দর সুন্দর লেখা পড়েন। কিন্তু অপলা হলফ করে বলতে পারবে, এত সুন্দর চিঠি তার বাবা নিজেও কখনো পাননি। তাই অপলা ঠিক করল চিঠি লেখার প্রথা আবারও শুরু করবে। হয়তো সে এত সুন্দর করে লিখতে পারবে না, কিন্তু সে প্রতিটা চিঠির শেষে প্রাপকের কাছ থেকে চিঠি পাওয়ার প্রত্যাশার কথা লিখবে। কেউ সাড়া দেবে, কেউ দেবে না। কিন্তু অপলা হাল ছাড়বে না। চিঠি লিখেই যাবে!

এরপর হঠাৎ একদিন চিঠিতে এল নিমন্ত্রণের ডাক! বরাবরের মতো এই চিঠিতেও তার নাম লেখা নেই! লেখা নেই পত্র প্রেরকের নাম-ঠিকানা! তাহলে এই নিমন্ত্রণ রক্ষা করবে কীভাবে সে? এবারের চিঠিতে পরিষ্কার করে বলা আছে শহরের একমাত্র নদীটির কথা। নদীর সেই বাঁকটির কথা। যেখান দিয়ে নদীটি লুকিয়ে গেছে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার পেছনে। অতঃপর হঠাৎ পাহাড়ের পেছন দিকে দুই ভাগ হয়ে বয়ে চলে সম্পূর্ণ বিপরীত দুটো দিকে। এই জায়গাটা অপলার ভীষণ পছন্দ। হ্যাঁ, এই জায়গাটাতেই নিমন্ত্রণের আহ্বান! অপলা বারবার পড়ল।

‘কোনো এক রংধনু রাঙা বিকেলে দেখা হবে ওই বাঁকে। থাকব তোমার প্রতীক্ষায়।’

এটাই চিঠির শেষ কথা। অপলা খুশিতে ঝলমল করে উঠল। চির বৃষ্টির পাহাড়ি এই অঞ্চলে রংধনুর দেখা পাওয়া খুব স্বাভাবিক। অপলা ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করে কোনো এক রংধনু রাঙা বিকেলের জন্য।

লেখিকা
লেখিকা

খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয় না তাকে। একদিন আকাশে একসঙ্গে দুটো রংধনু দেখা দেয়। অপলা কোনো রকম চিন্তাভাবনা ছাড়াই চলে যায় নদীর বাঁকে। যাওয়ার সময় চিঠিগুলো সঙ্গে নিতে ভোলে না। গিয়ে সে কাউকে দেখতে পেল না। এতটুকু হতাশ না হয়ে বসে পড়ল একটা গাছের গুঁড়িতে। চিঠিগুলো বের করে পড়তে থাকল। খুব ভালো লাগার একটা কাজ তার। একই চিঠি বারবার পড়া। ক্লান্ত হয় না একদমই। কতক্ষণ ধরে পড়ছিল সে জানে না, হঠাৎ একটা পুরুষ কণ্ঠে চমকে গেল সে!

‘আমার চিঠিগুলো তোমার কাছে কেন অপলা?’

মুখ তুলে তাকাল। না, এই মানুষটাকে চেনে না সে। দেখেওনি কখনো। খুব অবাক হয় বলল, ‘আপনি কি আমাকে বলছেন?’

ছেলেটিকে একটু বিরক্ত মনে হলো। বলল, ‘হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি। আমার এই চিঠিগুলো তুমি এখানে বসে পড়ছ কেন? কোথায় পেলে এগুলো?’

অপলা ভীষণ থতমত খেয়ে গেল! একটু রাগও হলো তার। সে বলল, ‘আপনি কে? আমার নাম জানেন কী করে?’

‘তুমি আমার স্যারের মেয়ে! চিনব না কেন তোমাকে?’

‘স্যার? আমার বাবা আপনার স্যার?’

‘সেটাই তো! নতুন জয়েন করেছি। স্যারের রুমে তোমার ছবি দেখেছিলাম। স্যার তো বেশ গল্প করে তোমাকে নিয়ে। না চিনে উপায় কী? তুমি আমার চেয়ে বয়সে চার–পাঁচ বছর ছোট হবে, তাই তুমি করে বলছি। রাগ করলে এখনই বলো, আপনি করে বলব।’

‘না, ঠিক আছে। আপনি আমাকে তুমি করেই বলবেন।’

‘অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু এখন বলো এগুলো তোমার হাতে কেন?’

অপলার চট করে প্রচণ্ড রাগ হলো। ইচ্ছে করল ছুটে পালিয়ে যায়। কিন্তু সে এমনটা করল না। শুধু বলল, ‘আমার ঠিকানায় চিঠি এলে সেটা আমার হাতে থাকবে না তো কার হাতে থাকবে বলে আপনি মনে করেন?’

‘কেন? তোমার বাবাকে পাঠানো চিঠি তুমি খুলে পড়ো, তা আমি কীভাবে জানব? এগুলো তো আমি তোমার বাবাকে পাঠিয়েছিলাম!’

‘মজা করেন? আমার বাবার অফিসে জয়েন করে আমার বাবার বাসায় চিঠি পাঠাবেন কেন? তা–ও আবার এই সব আবেগপ্রবণ কথাবার্তা? এত বড় মিথ্যুক আমি জীবনে দেখিনি। আর পাঠাবেন যখন, নাম লিখবেন না? না আছে প্রেরকের নাম, না আছে প্রাপকের নাম? কী করে বুঝব এটা কার জন্য? অদ্ভুত মানুষ তো!’

‘ওহ! এই কথা। আমি সত্যিই দুঃখিত। এ রকম হতে পারে আমি কল্পনাও করিনি।’

‘রাখেন আপনার দুঃখ। ঘটনা কী? আমার বাবাকে এসব পূর্ণিমা রাত্রি কিংবা পদ্মফুলের গল্প বলার কারণটা জানতে পারি?’

‘তোমাকে বলা ঠিক হবে কিনা জানি না। কিন্তু যেহেতু একটা ভুল–বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে, তোমাকে আমি পরিষ্কার করেই বলতে চাই। আসলে, আমার একটা বই বের করার খুব শখ। নিজের লেখা বই। তোমার বাবার প্রকাশনীতে জয়েন করার কারণ এটাই। নইলে আমার পারিবারিক ব্যবসা রেখে নয়টা–পাঁচটার চাকরি করার তেমন প্রয়োজন ছিল না। তো যা হোক, কত দিন ধরে স্যারের পেছন পেছন ঘুরছি আমার পাণ্ডুলিপি নিয়ে! পড়তেই চান না। এত এত নতুন লেখকের বই প্রকাশ করে দিচ্ছেন স্যার। শুধু আমার পাণ্ডুলিপি পড়ার সময় নেই! যখনই স্যারকে পড়তে বলি, তখনই বলেন পরে পড়বেন। আমার এত রাগ হলো। তাই আমি বেনামে চিঠি পাঠানো শুরু করি স্যারের বাসায়। একেকটা চিঠি আসলে আমার বইয়ের এক একটা অধ্যায়। আমার পরিকল্পনা ছিল সবগুলো অধ্যায় এভাবে পাঠানো হয়ে গেলে স্যারের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করব এটা প্রকাশ করার উপযোগী কিনা। ভেবেছিলাম আমার নাম দেখলে হয়তো স্যার লেখা পড়বেন না। কিন্তু কে জানত, বেনামি এসব চিঠি স্যারের মেয়ের হাতে পড়বে? আমি খুব লজ্জিত অপলা।’

‘সব বুঝলাম! কিন্তু এখানে আসার নিমন্ত্রণ?’

‘এটাও একটা অধ্যায়। আমাদের এলাকার নদীর এই বাঁকের অংশটা আমার খুব পছন্দ। আমি এখানে মাঝে মাঝেই আসি। রংধনু হলে তো আসতেই হবে আমার! উপন্যাসে ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যবহার করেছি বিষয়টা। কিন্তু আমি কল্পনাও করিনি এটা কেউ ধরতে পারবে। তা–ও আবার সুন্দরী একটা মেয়ে এই সাধারণ বিষয়টাকে পুঁজি করে এখানে চলে আসবে! আমি সত্যিই ভাবিনি অপলা। তবে আমার মন সব সময় এমন কিছু চাইত। তাই হয়তো আমি লিখেছিলাম। আমি খুব দুঃখিত অপলা।’

‘এত দুঃখিত হওয়ার কিছু হয়নি। আমিই আপনাকে বিব্রত করার জন্য দুঃখিত। আপনার চিঠিগুলো সত্যিই খুব সুন্দর। প্রতিটা চিঠি পড়ার পর পরেরটা পড়ার আগ্রহ জাগে। আসলে আমি কখনো কারও কাছ থেকে চিঠি পাইনি। চিঠি পাওয়ার ব্যাপারটা আমার জন্য একেবারেই নতুন। আমি ভেবেছিলাম আমিও চিঠি লেখা শুরু করব। যা হোক, আপনার সব চিঠি আমি বাবাকে পড়তে বলব। আমার ধারণা, আমি বললে বাবা অবশ্যই পড়বেন। আমি তাহলে এখন যাই।’

‘অপলা, একটা মিনিট। আমার মনে হয়, স্যারকে এগুলো দেওয়ার দরকার নেই। তুমি প্রথম মানুষ যে আমার পাণ্ডুলিপির প্রায় অর্ধেকটা পড়েছ আর পছন্দও করেছ। তোমার আপত্তি না থাকলে আমি বাকি চিঠিগুলো তোমাকেই পাঠাতে চাই।’

‘আমাকে! সরি, আমি বেনামি চিঠি দ্বারা প্রতারিত হতে পারব না। আপনি বাবাকেই পাঠাবেন।’

‘তোমার সঙ্গে প্রতারণা করার সাধ্য কার আছে অপলা? কথা দিচ্ছি, পরের চিঠিটায় নাম থাকবে। প্রেরকের নাম, প্রাপকের নাম আর নীল খাম।’

‘নীল খাম কেন?’ বলেই হঠাৎ অপলার খুব হাসি পেল। সে হাসতে থাকল। তার দেখাদেখি পত্রলেখকও হাসতে শুরু করল। হাসতে হাসতে অপলা বলল, আচ্ছা, আপনার নামটাই তো জানা হলো না!’

‘পরের চিঠি থেকেই জেনে নিয়ো।’

অতঃপর প্রযুক্তির তাণ্ডব উপেক্ষা করে একটি বিশুদ্ধ পত্র প্রেমের যাত্রা শুরু হলো।
...

কাজী সাবরিনা তাবাসসুম: মিলান, ইতালি।