বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি : সংগৃহীত

১.

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে। তিনি বাঙালির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছিল বিশ্বাসের ভিত্তিতে। শেখ মুজিবুর রহমান সম্ভবত সেই মুষ্টিমেয় কয়েকজনের একজন ছিলেন। তিনি মৌলিক ত্রুটিযুক্ত ভিত্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, হাজার হাজার বছর ধরে বিদ্যমান সংস্কৃতিগত সুস্পষ্ট সহাবস্থানের পরিবর্তে সমাজের মেরুকরণকে নিন্দা করেছিলেন। দুটি ভিন্ন জাতির একত্র হওয়ার পথে তিনিই বাধা হয়ে দাঁড়ান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভের মাধ্যমে সেই দুঃস্বপ্ন বঙ্গোপসাগরে চিরতরে সমাহিত হয়।

শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কীর্তি সম্ভবত সবচেয়ে ভালোভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন কিংবদন্তি বাঙালি কবি ও প্রাবন্ধিক অন্নদাশঙ্কর রায়। তিনি লিখেছেন—
‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান...’

১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ পূর্ব বাংলার ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ সাবডিভিশনের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এক বিস্ময়কর তরুণ ও প্রগতিশীল উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনীতিবিদ হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান খুব দ্রুততার সঙ্গে প্রতিটি পদে উন্নতি করেন। হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করলে শেখ মুজিব মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে এই নতুন দলে যোগ দেন। তাকে দলের পূর্ব পাকিস্তান অংশের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন (১৯৫৩-৬৬)। অতঃপর আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত।

তিনি ১৯৪৪ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমান নাম মওলানা আজাদ কলেজ) থেকে আই.এ ও ১৯৪৭ সালে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন।

ছবি : সংগৃহীত

২.

রাওয়ালপিন্ডি থেকে সামরিক জান্তার অধীনে গণতন্ত্র এবং সংস্কারপন্থীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা অব্যাহত থাকায় পূর্বাংশের জনগণ স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের আমোদ-প্রমোদের জোগানস্বরূপ সীমার অধিক পীড়িত ও নিষ্পেষিত হচ্ছিল। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী প্রধান ফসলগুলোর একটি ছিল পাট, যার উৎস পূর্বদেশে এবং সেই বৈদেশিক মুদ্রার রাজস্ব তথাকথিত উন্নয়নের দশকে মূলত পাঞ্জাব আর করাচির উন্নয়নের জন্য বণ্টনহীনভাবে পাচার হয়েছিল। সেই ভয়াবহ সময়ে এই খণ্ডিত রাষ্ট্রের মধ্যে সমঝোতার লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার প্রস্তাব করেছিলেন। এটি ছিল বেঁচে থাকার সনদ এবং অত্যাচারীর লৌহমুষ্টির প্রতিস্থাপনের জন্য পূর্ব অংশের স্বায়ত্তশাসন ছিল এর লক্ষ্য। পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সামরিক, কৃষির মূল ভিতকে এটি কাঁপিয়ে দিয়েছিল এবং এর প্রতিশোধস্বরূপ একাধিক রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা সাজানো হয়েছিল, যা মূলত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। কিন্তু জনগণের অভূতপূর্ব চাপ, যা বিদ্রোহের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছায় এবং রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত মামলাটি বাতিল করতে বাধ্য হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বৈরাচারীর শিকল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং তখন তিনি হলেন ১৯৭০ সালের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের প্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জার। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে নির্বাচনের আগমুহূর্তে বঙ্গীয় বদ্বীপে একটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে, যা পরবর্তী সময়ে জোটের ভাগ্য নির্ধারণে রাজনৈতিক অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। অনুমান করা হয় যে এতে প্রায় অর্ধমিলিয়ন প্রাণের বিনাশ ঘটে এবং সে দুর্দশার আরও অবনতি ঘটে, যখন স্বৈরাচারী শাসকেরা কোনো ত্রাণ বা উদ্ধারকাজের ব্যবস্থা করেনি, এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতকেও সাহায্যের অনুমিত দেয়নি। পরে যখন পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য নিউইয়র্ক শহরের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে পণ্ডিত রবিশঙ্কর এবং বিটলসের গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসন কনসার্ট পরিবেশন করেছিলেন, তখন পশ্চিমা বিশ্ব এই বিপর্যয়ের মাত্রা সম্পর্কে জানতে পারে। এখন পর্যন্ত মানবজীবনকে আঘাত করা সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ছিল এটি।

পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি : সংগৃহীত

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যা পাকিস্তানের সামরিক শাসনের ইতিহাসে একটি বিরল ও ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত ছিল এবং ৩০০টি নির্বাচনী এলাকার মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জনগণের অখণ্ডনীয় আদেশপত্রে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ১৬২টি আসন লাভের মাধ্যমে জয় নিশ্চিত করে। কিন্তু পরাজিত পশ্চিম পাকিস্তান গণতন্ত্রের পথে একটি বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং ইচ্ছাকৃতভাবে স্বৈরাচার থেকে স্বায়ত্তশাসনের রূপান্তরকে বাধা দেয়। পশ্চিমারা তাদের উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি বর্বর নৃশংস গণহত্যার অভিযান চালায়, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীহ শিক্ষার্থী ও শিক্ষাবিদদের গুম করা হয়। শিগগিরই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিমবঙ্গে বন্দী অবস্থায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। মিলিটারিদের কঠোর উচ্ছেদের কারণে লাখো মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতে রিফিউজি হয়ে আশ্রয় নেয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ
ছবি : সংগৃহীত

৩.

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর, রোববার সন্ধ্যায়, স্থানীয় সময় ৫টা ৪০ মিনিটে পশ্চিম পাকিস্তান বিমানবাহিনী (পিএএফ) কার্যকরভাবে যুদ্ধ শুরু করার জন্য উত্তর-পশ্চিম ভারতের ১১টি বিমানবন্দরে হামলা চালায়। পূর্ব ফ্রন্টে ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর (বাঙালি প্রতিরোধ) সঙ্গে যোগদানপূর্বক সম্মিলিতভাবে মিত্রবাহিনী গঠন করে। পূর্ব পাকিস্তান কৌশলগত উপায়ে রাজধানী ঢাকায় সংযুক্ত যান্ত্রিক সাঁজোয়া ইউনিট এবং বিমানবাহিনীর সহায়তায় পদাতিক সৈন্যদের নয়টি বিভাগে একটি দ্রুত ও ত্রিপক্ষীয় আক্রমণ চালায়। দুর্গম ক্ষতির মুখোমুখি হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এক পাক্ষিকেরও কম সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করে। পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের চুক্তিটি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন ঢাকার রমনা রেসকোর্সে বেলা ৪টা ৩১ মিনিট নাগাদ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং পূর্ব পাকিস্তানে উপস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজির উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল, জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ছিলেন ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ। এক ভয়াবহ ও রক্তাক্ত ৯ মাসের লড়াইয়ের পর একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। দেশটি দখলদার পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে মুক্ত ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান পরবর্তীকালে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ : আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি। পাশে বসা মিত্রবাহিনীর লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা
ছবি: সংগৃহীত

ভুটান হলো প্রথম দেশ, যেখানে স্বতন্ত্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল, তারপর দিয়েছিল ভারত। বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এবং দেশটি সিক্ত হয়েছিল লাখো নিষ্পাপ মানুষের রক্তে, যাঁরা তাঁদের মাতৃভূমির জন্য ত্যাগের সর্বোচ্চটুকু দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে নিরীহ পূর্ব পাকিস্তানিদের রক্ত পশ্চিম পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী, রাজনীতিবিদ, আমলা এবং সেবায় সহযোগীদের সবচেয়ে অন্ধকার যুগের সাক্ষ্য দেয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি সপরিবার সেনাবাহিনীর কিছু অসন্তুষ্ট সদস্যের হাতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন
ছবি: সংগৃহীত

৪.

শেখ মুজিবের আপসহীন এবং ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের সাহসী নেতৃত্ব জনগণের হৃদয়ে অমর স্থান করে নেয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি সপরিবার সেনাবাহিনীর কিছু অসন্তুষ্ট সদস্যের হাতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের পরও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রে বাস্তবায়িত হচ্ছে। গণতন্ত্র ও সহিষ্ণুতার প্রতি মুজিবের অবিচ্ছিন্ন প্রতিশ্রুতির উত্তরাধিকার বজায় রাখার অব্যাহত চিরস্থায়ী তাৎপর্য কেবল সহকারী দেশগুলোর সঙ্গেই অংশীদারত্বের মাধ্যমে আরও পরিমার্জন করা যেতে পারে; বিশেষত, বৃহত্তর ভারতের অংশীদারত্বের মাধ্যমে।

  • লেখক: প্রিয়াজিৎ দেবশঙ্কর, ভারতীয় উপমহাদেশের ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশেষজ্ঞ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য। ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ: বিচিত্র বিশ্বাস, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, শিবপুর, ভারত।