অটোফেজি

ইফতার
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

নাসরিনের বিয়ে হয়েছে হুট করে। মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে হাঁফ ছেড়েছে মোটে ১৫ দিন। এর মধ্যে ওর মা রুমে ঢুকেছেন এক সকালে। হাতে চা। পরীক্ষা, ক্লাস বা পড়াশোনার জন্য এত দিন একসঙ্গে চা খাওয়া হতো না প্রায় মা-মেয়ের। এসব হচ্ছে ১৫ দিন ধরে এবং নাসরিনের সবচেয়ে প্রিয় সময় দিনের এই শুরুটা। বড় হয়ে গেলে মা আর মেয়ের যে বিশেষ বন্ধুত্ব হয়, এটা সে খুব এনজয় করে।

শীতের দিন, পায়ে সকালের রোদ এসে পড়েছে। এমন সময় মা এলেন। গরম চায়ের কাপে মাত্র চুমুক দিয়েছে নাসরিন, মা বললেন, ‘শোন, তারিক নামের একটা ছেলে তোর জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। সে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে। অসম্ভব ভালো একটা ছেলে। তুই একটু ভেবে দেখিস। তবে তোর যদি কোনো পছন্দ থাকে, তাহলে আলাদা কথা।’ নাসরিন একটু চিন্তা করল। কাজ যেহেতু নেই হাতে আপাতত, ছেলেটাকে দেখতে যাওয়া যায়। দেখলেই বিয়ে করতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই।

দিন তিনেক পর একটা রেস্তোরাঁয় দেখা করল ওরা। রেস্তোরাঁর নাম ভূত। আধো আলো-আঁধারিতে পাঞ্জাবি পরা একটা ছেলে বসে আছে, কনসেপ্টটাই অদ্ভুত। নাসরিন বসেই জিজ্ঞেস করল, ‘এ রকম অদ্ভুত জায়গায় দেখা করার কারণটা জানতে পারি?’ তারিক ত্বরিত উত্তর দিল, ‘আপনাকে ইমপ্রেস করার একটা ব্যাপার আছে না? একটু চমকে না দিতে পারলে কি আর আগ্রহ থাকবে আমাকে জানার?’ এরপর নাসরিনের রেজাল্ট কবে দেবে সেসব নিয়ে তারিকের আগ্রহ আর রেজাল্টের পর কী ধরনের চাকরি ওর পছন্দ ইত্যাদি বন্ধুর মতো কথা মনটা কেড়েছিল ওর।

এত সহজ সরল কথোপকথন শুরু হয়েছিল সেদিন। এরপর আর দেরি হয়নি সিদ্ধান্ত নিতে নাসরিনের। ছোট পরিসরে হয়েই গেল বিয়ে। বিয়ের পর নাসরিন এল তারিকের বাসায়। তারিক ওর মা-বাবার সঙ্গে থাকে। নয় তলার ওপর বাসা। শ্বশুর-শাশুড়ি নাসরিনকে মেয়ে হিসেবে কাছে টেনে নিলেন। নতুন সংসারে মানাতে এতটুকু কষ্ট হলো না যেন ওর।

তবে রোজ সকালে মনে হয় নাসরিনের, তারিক বোধ হয় সিগারেট খায়। ওর সামনে না, বারান্দায়, তবে কেমন একটা গুমোট গন্ধ হয়ে থাকে গায়ে। ও জিজ্ঞেস করল মাস তিনেক পর, ‘অ্যাই, তুমি কি সিগারেট খাও? আমার না খুব কষ্ট হয় নিশ্বাস নিতে এ গন্ধে। ছোটবেলায় শ্বাসকষ্ট ছিল তো।’ তারিক কিছু বলেনি সেদিন। এরপর থেকে নাসরিন কখনোই গন্ধটা আর পায়নি। মাসখানেক পর জিজ্ঞেস করছিল, তারিক এত সহজে এ অভ্যেস কীভাবে ছাড়লে? তারিক বলেছিল, ‘পৃথিবীতে ভালোবাসার মানুষের একটা হাত যদি আমার হাতটা না ধরে থাকে বা থাকতে চাইলেও যদি কষ্ট হয় তার নিশ্বাস নিতে, তাহলে এর চেয়ে বড় লজ্জার কথা একজন স্বামীর কাছে আর কী হতে পারে, সোনা?’ আনন্দের অশ্রু মুছতে মুছতে নাসরিন রান্নাঘরের দিকে গেল। মা মনে হয় আগেই চলে গেছেন নাশতার আয়োজনে।

প্রতীকী ছবি

রোজার মাস আসছে সামনে। নাসরিন অবাক হয়ে শুনল তারিক নাকি রোজা রাখতে পারে না। ওর গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা। নাসরিন তবু জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কখনোই রাখনি রোজা?’ তারিক বলল, ‘না। চেষ্টা করিনি, সুস্থ তো থাকতে হবে?’ ‘রোজাই তো তোমাকে সুস্থ রাখবে তারিক।’ হাসি হাসি মুখ করে তারিকের সোজাসুজি উত্তর, ‘নাহ, আমি পারব না।’

আজকে ছুটির দিন। তারিকের হাত ধরে চা নিয়ে বারান্দায় বসেছে নাসরিন। বলল, ‘জান, অটোফেজি ব্যাপারটা কি তুমি জানো?’ তারিক অবাক হয়ে তাকাতে নাসরিন বলল, ‘১৬ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় না খেয়ে থাকলে শরীরের কোষ নিজের মধ্যে কিছু পরিবর্তন আনে। বাজে পুরোনো অংশ ছেঁটে ফেলে কোষকে নতুন করে তোলে, যা ক্যানসারসহ অনেক রোগ প্রতিরোধ করে এবং যেকোনো ধরনের স্ট্রেস মোকাবিলা করতে শরীরকে তৈরি করে। ২০১৬ সালে জাপানি বিজ্ঞানী ইয়োশিনরি ওসুমি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এ তত্ত্বের জন্য তুমি জানো? একটু কি চেষ্টা করবে এ বছর রোজা রাখতে? আমি তো তোমার সঙ্গে দীর্ঘ সুস্থ একটা জীবন কাটাতে চাই।’

আর কোনো কথা হয়নি ওদের মধ্যে এ নিয়ে। নাসরিন কিছু চাকরির ইন্টারভিউ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। প্রথম রোজার আগের দিন সবাই অবাক হয়ে দেখল তারিক খুব মনোযোগ দিয়ে তারাবিহ পড়ছে। ভোররাতে সাহ্‌রি খেতে এসেছে। সবার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল সে। তারপর চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, ‘জীবনে অটোফেজির আগমন হয়েছে যখন, সুস্থ যে আমাকে থাকতেই হবে।’

পাঠক, প্রতিদিন দুপুরে এসব রোজাটোজা আমি আর পারব না বলতে বলতে, অনেক বেশি ইফতারির আবদার করে অল্প কিছু খেয়ে আরও অনেক কিছু করে তারিক ১০টা রোজা শেষ করেছে। বাকিগুলো রাখতে পারল কি না, ঈদের দিন নাসরিনের কাছ থেকে জেনে জানাব অবশ্যই। আপাতত এতটুকুই সংবাদ এই টক মিষ্টি ঝাল পরিবারের।

*লেখক: চিকিৎসক