অপার সৌন্দর্যের গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ

গ্রেট ব্যারিয়ার রিফছবি: লেখক

হঠাৎ করে ছুটি পেয়ে গেলাম একসঙ্গে আমি আর বাচ্চারা। ১০ দিন। ব্যস্ত জীবনে এটা অনেক সময়। ঠিক হলো, যাব কোরাল রিফ দেখতে। সান দিয়াগো থেকে সিডনি, ১০ ঘণ্টার উড়াল। ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করেও প্লেনে উঠে দেখি ঘুম আসে না। যাক, উদাস নয়নে মুভি দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম।

গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে যাওয়ার জন্য জাহাজে ওঠার আগে সন্তানদের সঙ্গে লেখক
ছবি: লেখক

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই দেখি ঝকঝকে রোদ চারদিকে। খালাতো ভাই রিসিভ করতে এসেছিল। বলল, আপু সানস্ক্রিন এনেছ তো? নয়তো পুড়ে ছাই হয়ে যাবে রোদে। ভাড়ার গাড়ি নিয়ে ছাই হয়ে যাওয়া এড়াতে প্রথমেই কিনে ফেললাম সানস্ক্রিন। কয়েকটি দিন সিডনিতে স্বপ্নের মতো কেটে গেল। সে স্মৃতি নাহয় অন্য আরেক দিনের জন্য তোলা থাক।
সিডনি থেকে প্লেনে করে নামলাম কেয়ার্ন্স সিটিতে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু ভিজিয়ে দিচ্ছে না। কাজিনের বাসায় গেলাম আমরা। বিকেলে বাসার কাছেই ওয়ালাবি (ছোট ক্যাঙারুর মতো) ফার্ম দেখতে গেলাম। দূর থেকে দেখলাম। ছোট ছোট দলে ঘুরছে, মাঝেমধ্যে বিস্মিত হয়ে দেখছে চলমান গাড়ির লাইট।

রাতের আড্ডা শেষে ঘুমিয়ে উঠে সকালে পৌঁছে গেলাম লেগুনে। টিকিট কাটা ছিল আগেই। উঠে গেলাম জাহাজে। একটু ভয় ছিল—মোশন সিকনেস আছে, কিন্তু প্রকৃতির তৈরি সপ্ত আশ্চর্যের একটি দেখার উত্তেজনায় কোনো কিছুই টের পাইনি যেন। দোতলা জাহাজের ওপরের তলাটা চাইনিজ ভাষাভাষীদের জন্য সংরক্ষিত। উত্তাল গানের শব্দে একটু উঁকি দিয়ে এলাম। বেশির ভাগই রংচঙে কাপড় পরা বুড়ো–বুড়ি। গানের তালে তালে নাচছে। এর মধ্যে লাঞ্চ সেরে নিলাম বুরিটো দিয়ে। ছিমছাম খাবার, তারপর চা আর কূলহীন সাগরে তাকিয়ে গন্তব্যের অপেক্ষা।

স্নরকেলিংয়ের অপেক্ষায় লেখক
ছবি: লেখক

চার ঘণ্টা পরে পৌঁছালাম গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে। নিচে উঁকি দিয়ে পানিতে রকমারি মাছের সমারোহ দেখলাম। বাচ্চাদের নিয়ে গ্লাস বোটে (নৌকার তলাটা কাচের) উঠলাম একটু পর। নিচে নীল, সাদা, সবুজ কোরাল আর তার মধ্যে মাছের নানা রঙের সমারোহ। জাহাজে ফিরে স্কুবা ডাইভিং করব চিন্তা করেও বাচ্চাদের কথা ভেবে বাদ দিলাম। স্নরকেলিং করব আমরা। সাগরের একটু গভীরে গেলেই সবকিছু অনেক বেশি সুন্দর শুনেছি। কাপড় বদলে আমি, আমার ছেলে আর মেয়ে তৈরি হয়ে নিলাম।

আমাদের গাইড টিউব টেনে নিয়ে যাবেন, ১২ জন মোট, স্নরকেলিং করব। শুরু হলো সে স্বপ্নের যাত্রা, একটু পরপর কাছিম, স্টার ফিশ, হলুদ–কমলা–লাল সব মাছের দেখা আর মনকাড়া দৃশ্য, তারপর সবুজ–নীল–সাদা কোরাল। মনে হচ্ছিল, একটু নামলেই ছুঁতে পারব। কী অপূর্ব, কী অপূর্ব! গান বেজে চলেছে মনে মনে, ‘ভাবি শুধু এখানেই থাকব, দূরে যেতে মন নাহি চাইছে’। আমি তো স্বপ্নে এত দিন এই অজানাতেই আসতে চেয়েছি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল আমাদের। আবহাওয়া খারাপ থাকলে অনেক সময় নাকি জাহাজ আসে না।

বোটে ফিরে শাওয়ার নিয়ে ফেরার অপেক্ষা। চা খুঁজে নিলাম, ঘণ্টাখানেক পরে আবার তীরমুখী যাত্রা জাহাজের। যেতে যেতে রাত নামল, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। পানিতে অপার্থিব সৌন্দর্যের প্রতিবিম্ব। বাসায় ফিরে আড্ডা আর ডিনার করে ঘুমাতে গেলাম। পরদিন এক বেলা দেখব অ্যাবোরিজিন পল্লি আর এক বেলা ছোট্ট জু। কোয়ালার দেশে এসে কোয়ালা না দেখে কি আর ফিরে যাওয়া যায়?

আদিবাসীদের গ্রামে একজন আদিবাসী অভিনেতার সঙ্গে
ছবি: লেখক

সকালে গেলাম অ্যাবোরিজিন পল্লি জ্যাবেগাইয়ে। ঢুকে দেখলাম, মাটির নিচে বিশাল চুলায় ক্যাঙারু বারবিকিউ হচ্ছে। সেই সাথে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের সাজপোশাকে বহু বছর আগে কীভাবে বারবিকিউ হতো তার বর্ণনা। বাচ্চারা একটু খেয়ে দেখল কেমন টেস্ট। ভেতরে গিয়ে দেখি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীর সাজে হারবাল ফল-মূল-লতা-পাতা সাজিয়ে কোনটার কী গুণ বর্ণনা করছেন একজন। মাঝেমধ্যে একটু চেখে দেখতে দিচ্ছেন। এরপর গেলাম বল্লম ছুড়ে শিকার করার ট্রেনিং সেশনে, শেষে বুমেরাং ছোড়া শিখতে। এত রকম বুমেরাং যে আছে, সেটা তো জানতাম না। কোনো কোনোটি পাখিকে আহত করে নামানোর জন্য, আবার কোনোটি শিকারি পাখিকে মেরে ফেলার জন্য। আমার ছোড়া বুমেরাং কোনো পাখির নাগাল পায়নি ভাগ্যিস। তারপর কিনলাম পাখিকে আহত করার বুমেরাং, যেন বাসায় এসে একটা স্মৃতিচিহ্ন হওয়া ছাড়া এটার আরও কোনো কাজ আছে।

বিকেলে ছোট চিড়িয়াখানায় গেলাম কোয়ালা দেখতে। তাঁরা বললেন, সাপও ধরে দেখা যাবে। শুনেই চিৎকার করলাম বাংলায়, ‘আমার মাথায় কি ছিট আছে যে সাপ ধরব?’ ছেলেমেয়ে বুঝিয়ে বলল, তাদের মা সাপ ধরবে না, ওরা ধরবে। নিয়ে এল কোয়ালা। এত শান্ত–লক্ষ্মী কোয়ালা, কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইলাম। পরদিন বিকেলে ফ্লাইট। দুপুরে ফিশ অ্যান্ড চিপস খেয়ে গেলাম পাহাড়ের ওপরে বাঁধ দেখতে। চিকন আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে আধা ঘণ্টা ড্রাইভ করে খালাতো ভাই নিয়ে গেলেন ওপরে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। এটা নাকি সব সময়ের আবহাওয়া এখানে। মানুষের তৈরি বাঁধের সঙ্গে বন আর প্রকৃতি মিলে বর্ণনাতীত সৌন্দর্য।
ফিরতি পথে ভাবি দিলেন অ্যাবোরিজিনদের আর্ট। শত কাজের মধ্যেও ভাই–ভাবির তুলনাহীন আতিথেয়তার আনন্দ নিয়ে রওনা দিলাম সিডনির পথে।