অপ্রত্যাশিত আরেকটি ঈদ

প্রবাসে ঈদ। ছবি: সংগৃহীত
প্রবাসে ঈদ। ছবি: সংগৃহীত

ঈদুল ফিতরের চেয়ে ঈদুল আজহা অন্য রকম মজা লাগত। শুরুতে একটু ছোটবেলার স্মৃতিতে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কোরবানি ঈদের আয়োজন কয়েক দিন আগেই শুরু হয়। শৈশবে থেকে কোরবানির ঈদগুলো ছিল ভীষণ আনন্দের।

বাবা যেদিন হাটে যেতেন গরু কিনতে, সেদিন দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম অধীর আগ্রহে। কখন আসবেন গরু নিয়ে। আর অপেক্ষার সময়টুকুতে বাড়ির সামনে দিয়ে যেকোনো মানুষকে গরু কিনে বাসায় ফিরতে দেখলেই জিজ্ঞেস করতাম গরুর দাম কত? অন্য রকম একটা অনুভূতি কাজ করত। বাবা গরু নিয়ে বাসায় ফিরলে প্রথমেই খেয়াল করতাম, আমাদের গরুটা পাশের বাড়ির গরুর চেয়ে বড় এবং সুন্দর কি না। এটা ছিল ওই বয়সের একটা নিষ্পাপ প্রতিযোগিতা। আসলে শৈশবে আমাদের আত্মত্যাগের চিন্তা থেকে মজার চিন্তাটাই বেশি থাকত।

আর ঈদের দিনের হৃষ্টতা খুব সকাল থেকেই শুরু হয়। বাবার সঙ্গে ঈদের নামাজে যাওয়া, সবাইকে সালাম করা। ঈদে নামাজ শেষে বাসায় এসে গরু কোরবানি বা কাটাকাটি নিয়ে সবার মধ্যে অনেক উৎফুল্লতা ছিল। গরু-খাসি জবাই এরপর মাংসের ভাগ থেকে শুরু করে তা শেষ হয় মাংস বিলি করার মধ্য দিয়ে। এমনই ছিল শৈশবে থেকে কোরবানির ঈদ।

সময়ের সঙ্গে যেন পৃথিবীও তার আপন রং বদলে ফেলল। এক মহামারি মানবজীবনের স্বাভাবিক গতিধারাকে পাল্টে দিয়েছে! সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, খুশি-আনন্দের পরিবর্তে বেঁচে থাকার সংগ্রামটাই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে।

ঈদের জামাত শেষে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। ছবি: সংগৃহীত
ঈদের জামাত শেষে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। ছবি: সংগৃহীত

করোনাকালে ঈদুল ফিতর কেটে গিয়ে আরেকটি ঈদ ফিরে এল। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। হাসি, আনন্দ আর উদযাপনের বার্তা নিয়ে আসে এমন ঈদ। কিন্তু এবারও…! রোগশোক আর মৃত্যুর রঙে ধূসর এই পৃথিবীতে খুশির ঈদের যেন কোন রং নেই। আহারে এমন ঈদও এল পৃথিবীতে! নেই হাত মেলানো, নেই কোলাকুলি! নেই নতুন পোশাক! নেই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে ছবি তোলাতুলি। গা–ঘেঁষাঘেঁষি করে ছবি তুলতে না পারলেও আমরা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে ছবি তুলে করোনাকালের ঈদের স্মৃতি ধরে রেখেছি মাত্র। বলা যায় এবারের ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় হচ্ছে ভার্চ্যুয়াল জগতে। ঈদের দিন রাত থেকে মোবাইলে ঈদের শুভেচ্ছাবার্তা বলে দেয় আমরা কতটা ভার্চ্যুয়াল জগতের বাসিন্দা হয়ে গেলাম। তবে এমন শুভেচ্ছাবার্তা কতটুকু আন্তরিকতার পরিচয় দেয়?

একটা সময় সাধারণত মানুষ প্রিয়জন বা বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে বা বিভিন্ন রকম কার্ডের মাধ্যমে যেভাবে শুভেচ্ছা বিনিময় হতো, সে রেওয়াজটি তরুণদের মধ্যে অনেকটা উঠে গেছে। কিন্তু এখন সেটি দখল করে নিচ্ছে ভার্চ্যুয়াল শুভেচ্ছা। আবার একই মেসেজ বা বার্তা গণহারে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন জনের কাছে।

করোনাকালের ঈদ আর প্রবাসের ঈদ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো। ঈদ আসে–যায় কিন্তু ঈদের সেই আমেজটা যেন নেই। তবে প্রবাসীরা প্রবাসজীবনের শত কষ্ট আর বঞ্চনার মধ্যে ঈদের কয়েকটি দিন অন্তত খুঁজে নিত প্রবাসে অবস্থানরত অন্যান্য বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিচিতজনদের সঙ্গে। শেয়ার করত প্রবাসজীবনের সঞ্চিত ব্যথা, হালকা করত নিজেকে। একদিকে নিজেরা বেঁচে থাকার সংগ্রাম, অন্যদিকে করোনাকালে দেশে পরিবার-পরিজনদের নিয়ে চিন্তায় মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

স্মৃতিতে দক্ষিণ কোরিয়ার আনসান মসজিদের ঈদগাহে ঈদুল-আজহার জামাত। ছবি: সংগৃহীত
স্মৃতিতে দক্ষিণ কোরিয়ার আনসান মসজিদের ঈদগাহে ঈদুল-আজহার জামাত। ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ কোরিয়াতে সরকারিভাবে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর-আজহার কোনো ছুটি নেই। কিন্তু মাঝেমধ্যে কাকতালীয়ভাবে সাপ্তাহিক ছুটি বা সরকারি ছুটির সঙ্গে মিলে যায় ঈদের দিন। আর সেই দিনটি হয় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রবাসীদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের দিন। যেমনিভাবে উদযাপন করেছিল এবারের ঈদুল ফিতর। সরকারের পক্ষ থেকে ঈদের জামাতেরও অনুমতি ছিল।

কিন্তু কোরিয়াতে থেমে থেমে করোনার প্রকোপ বাড়ার কারণে এবারের ঈদুল আজহার জামাতের অনুমতি দেয়নি কোরীয় মুসলিম ফেডারেশন (কেএমএফ)।

যদি ঈদ আনন্দের সব অনুষঙ্গ ত্যাগ করেও পৃথিবী থেকে করোনা বিদায় নিত, তাহলে শান্তি পেত মন। অথচ আমরা এখনো ধারণাও করতে পারছি না যে কবে এই করোনাভাইরাস বিদায় নেবে মানবজাতির কাছ থেকে। পৃথিবী থেকে করোনার বিদায়ে মানুষ ঈদের আনন্দের চেয়ে বেশি আনন্দিত হবে এবং সেই আনন্দই পৃথিবীর বুকে আসুক দ্রুত, এটা এই করোনা দিনের ঈদপ্রত্যাশা। আর এমন অপ্রত্যাশিত ঈদ যেন আমাদের জীবনে আর না আসুক।