‘অমিয়ধারা’র উদ্যোগে কানাডায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড

কানাডার NRBtv–তে প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলো মানুষ বেশ পছন্দ করেছে
ছবি: সংগৃহীত

২০২০ সালের শুরুটা খুব ভালোভাবে আর নতুন নতুন পরিকল্পনা দিয়ে শুরু হলেও আস্তে আস্তে পুরো পৃথিবীর মতো ক্যালগেরি তথা কানাডাও করোনার বীভৎস আক্রমণের শিকার হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র বন্ধসহ সবাই নিজ নিজ গৃহে বন্দী হয়ে ঘরে বসে সামাজিক মিডিয়া, টিভি আর পত্রিকায় প্রতিনিয়ত চোখ রেখেছি, কোথায় কী হচ্ছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে। সেসব খবর দেখে দেখে সবাই আতঙ্ক আর ভয়ে অত্যন্ত কষ্টদায়ক বেদনাবহ দিন পার করেছি। কী দুঃসহ যন্ত্রণা! উফ সে কী উৎকণ্ঠা!!

এরই মধ্যে একদিন কথায় কথায় ঠিক হলো, কেমন হয় এই মন খারাপ করা সময়ে সবার মানসিক স্বস্তি দিতে একটা টিভি অনুষ্ঠান তৈরি করলে? শহীদুল ইসলাম মিন্টু ভাইয়ের সঙ্গে এর আগে বেশ কয়েকবার তাঁর NRBtv টরন্টোতে কাজ করার কথা থাকলেও হয়ে ওঠেনি। এবারও মিন্টু ভাই যথারীতি অভয় দিলেন। শুরু হলো অনুষ্ঠান বানানোর কার্যক্রম। এই সময় একটা কথা বলা দরকার, দেশে অনেক ভালো আর চমৎকার সব অনুষ্ঠান তৈরি করা সম্ভব, কিন্তু দেশের বাইরে ভিন্ন পরিবেশে তেমন কাজ করা একটু কষ্টের।

ক্যালগেরিতে Shaw tv channel-এর মাধ্যমে ১৯৯৮’র শেষ দিক থেকে বেশ কিছুদিন ‘বাংলা আমার বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রত্যেক সপ্তাহে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালিয়েছি আমরা। ২০০২-এ ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তিতে ‘রুপালি স্বপ্নের সুবর্ণপ্রান্তর’ এবং ‘মিলিত প্রাণের উচ্ছ্বাসে’ নামে অনুষ্ঠান করেছি। বিদেশের মাটিতে বসে দেশের সংস্কৃতি বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার আনন্দটা যে অন্য রকম, তা বেশ অনুভব করেছি।

বিশিষ্ট আবৃত্তিকার ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়
ছবি: লেখক

উদ্যোগ নেওয়ার শুরুতেই কথা হলো বিভিন্ন গুণীজন ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এবং বিশিষ্ট আবৃত্তিকার ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী আফরোজা বানু, কথাসাহিত্যিক, লেখক, নাট্যকার, কিশোর আলো সম্পাদক আনিসুল হক, আবৃত্তিকার নিশাত জাহান রানা, কলকাতার আবৃত্তিকার ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভন সুন্দর বসু এবং আমার দেশের স্বনামখ্যাত নাট্য ও সিনেমা পরিচালক অরুণ চৌধুরী, চয়নিকা চৌধুরী, দীপংকর দীপনসহ কানাডার শিল্পীদের আন্তরিকতা সহযোগিতা ও অংশগ্রহণে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা ও বিজয় দিবস উপলক্ষে পর পর ‘আঁধার কাটুক আনন্দে’, ‘আলোক পানে বসুন্ধরা’, ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’ নামে তিনটি অনুষ্ঠান বানিয়ে ফেলি। NRBtv-তে সেগুলো প্রচারিত হয় এবং অনুষ্ঠানগুলো সবাই বেশ পছন্দ করেছে। বিশেষ করে সম্মানিত বীরাঙ্গনা আর নারী মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসর্গ করে নির্মিত অনুষ্ঠান ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’ আমাদের প্রত্যাশার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

শুরুতেই যে উদ্দেশ্য ছিল করোনাকালে বিভিন্ন দিবসে আনন্দ দেওয়া, সেটাও মনে হয় সফল হয়েছে। স্থানীয়ভাবে ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সবার ব্যক্তিগত মতামত, সোশ্যাল মিডিয়ায় অভূতপূর্ব সাড়া আর সুন্দর সুন্দর গঠনমূলক সমালোচনায় আমরা অভিভূত। তারই কয়েকটি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি, যেগুলো সত্যিই আমাদের প্রেরণা দিয়েছে।

কানাডার শিল্পীদের আন্তরিকতা, সহযোগিতা ও অংশগ্রহণে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা ও বিজয় দিবস উপলক্ষে ‘আঁধার কাটুক আনন্দে’, ‘আলোক পানে বসুন্ধরা’, ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’ নামে তিনটি অনুষ্ঠান করা হয়েছে
ছবি: লেখক

ক্যালগেরি থেকে জয়দীপ স্যানাল বলেছেন, ‘আঁধার কাটুক আনন্দে’ এক কথায় দারুণ লাগলে। সুনিপুণ গ্রন্থনা ও সম্পাদনা অনুষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করেছে। স্বল্প সময়ের যথার্থ ব্যবহার আর পরিবেশনায় বৈচিত্র্য প্রশংসার দাবি রাখে। সবচেয়ে ভালো লাগলে পরিশীলিত উপস্থাপনা, ভাস্বর দার দরাজ কণ্ঠে আবৃত্তি, নক্ষত্রর অনবদ্য নাচ আর অনিন্দ্যর সুরেলা কণ্ঠে গান। প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীসহ যাঁরা সহযোগিতা করেছেন, সবার জন্য প্রাণঢালা অভিনন্দন। সবশেষে মনে হলো, শেষ হয়েও হলো না শেষ! পরের অনুষ্ঠান দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

ক্যালগেরির লতিফুল কবির বলেন, নামে চমক আছে। বসুন্ধরাকে নতুন করে আবিষ্কারের নেশা হয়তো পেয়ে বসে কারও না কারও মাঝে। অমিয় মুরতাজ তাঁদেরই একজন। বসবাস ক্যালগেরি শহরে। তিনি গভীর মনের মানুষ। শিল্পী মনে তাঁর কত কিছু খেলা করে। তারপর সেগুলোকে একত্র করে টেলিভিশনের পর্দায় হাজির করেন। এবারের কোরবানির ঈদে তাঁর তেমন এক আয়োজন ছিল ‘আলোক পানে বসুন্ধরা’। কী ছিল না তাতে? এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত বাঙালিকে সান্ত্বনার পরশ দিতে শুভাশীষ তাই এন্ড্রুকেই বেছে নিয়েছেন। ওর কণ্ঠে গান শুনতে শুনতে এন্ড্রুর কথা কার মনে পড়েনি? রীতা কর্মকারকে যাঁরা কেবল রবীন্দ্রনাথের গানে দেখেছেন বা শুনেছেন, তাঁরা এবার এক নতুন রীতাকে আবিষ্কারে সক্ষম হবেন। আর ভরাট গলার ইকবাল, মিষ্টি সুরের উম্মে হাবিবা মিলি কিংবা মিষ্টি হাসির রুবিনা ইয়াসমিন, কার চেয়ে কে কম যায়?

কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক
ছবি: লেখক

কবিতায় ব্রততীকে দেখতে দেখতে ও শুনতে শুনতে সময় আটকে যায়। অমিয় মুরতাজ নিজেই একজন অসাধারণ আবৃত্তিকার, এবার তিনি পুঁথি পাঠে তাঁর মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। গল্পকার আবু সাঈদ লিপু যে পুঁথি লিখতে পারেন, সেটা ক্যালগেরিবাসী কীভাবে জানবে? আর এই অধম কীভাবে অনুষ্ঠানের শেষ চমক গম্ভীরা লেখে? আমার বেলায় এটা সম্ভব হয়েছে অমিয় মুরতাজের কারণে। আর গম্ভীরা দেখতে দেখতে আমার তো বিস্ময়ে বোবা হওয়ার দশা। সাসক্যাচুয়ানের শিল্পীরা গম্ভীরার চিরায়ত ঢং-কে অনুসরণ করে কী চমৎকার পরিবেশনা দেখাল!

আমার মুগ্ধতা শেষ হওয়ার আগেই ফোন দিয়ে বসলাম অমিয় ভাইকে। জানতে চাইলাম, দীপংকর দীপন, চয়নিকা চৌধুরী, অরুণ চৌধুরীদের শুভেচ্ছাবার্তাগুলো এভাবে উপস্থাপনার বুদ্ধিটা কার। বললেন, ক্যারিগরি দিকটা নক্ষত্র করেছে। তো নক্ষত্র কেবল নৃত্যই না, টেকনিক্যাল জায়গাতেও সে যে বিশ্বমানের, সেটা আর গোপন থাকল না। নক্ষত্র ও শুভজিৎ পালের দ্বৈত নৃত্য ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে কীভাবে ব্লেন্ড হয়ে গেছে, চোখ মেলে দেখার মতো। লাঠি নৃত্যে শারমিনের পারমফরম্যান্স দেখে কেবল যে এই নাচটি কারও বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে চিত্রায়ণ করা। শোভন সুন্দরকে বাদ দিলে নজরুলের কবিতার এমন চমৎকার আবৃত্তি কীভাবে সম্ভব হতো? আবহসংগীত তো বটেই, পেছনের দৃশ্যপট নির্বাচনে এবং তাকে যথাযথভাবে ক্যামেরাবন্দী করে আনা সহজ কথা না। টিম অমিয় সেটি করেছে সার্থকভাবে। পুরো অনুষ্ঠানটি জমজমাট হওয়ার নেপথ্যে এডিটিং এক বিশাল বিষয়, ৫৩ মিনিটের অনুষ্ঠান তাই কয়েক পলকের মতো মনে হয়। বন্ধুদের কথা যেমন ফুরোয় না, ভালো অনুষ্ঠান সেই বন্ধুর মতো, যাকে ছাড়তে ইচ্ছা করে না।