অয়ন

‘অয়ন আইসক্রিম খাবে...আইসক্রিম খাবে...আইসক্রিম খাবে...আইসক্রিম খাবে...’। সোমা গাড়ি চালাতে চালাতে খুব নির্লিপ্তভাবেই শুনে যাচ্ছে পাঁচ বছর বয়সী অয়নের কথাগুলো। প্রথম দিকে এ রকম একই কথা বারবার শুনতে ভীষণ অস্থির লাগত। আজকাল অনেক অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে।

প্রতি শনিবার সকাল ঠিক ১০টায় অয়নকে আইসক্রিমের দোকানে নিয়ে আসতে হয়। তার কোলে একটা কমলা রঙের ছোট বেয়ার আর কম্বল থাকে। ডালাসের একটি ছোট শহরের নেইবারহুডের কাছেই আইসক্রিম শপে আসতে ১০ মিনিট সময় লাগে। হাতের পু বেয়ারটিকে সে নখ দিয়ে একটু একটু করে খোঁটাতে থাকে। এতে তার সেন্সরি স্টিমুলেশন হয়। নরম কম্বলটাতেও হাত বোলায়। মুখে অনেক সময় বিজজজজজজ—এ রকম একটা শব্দ করে। প্লেগ্রাউন্ডের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সে পাখির মতো করে হ্যান্ড ফ্ল্যাপ করে। এটি তার আনন্দের অভিব্যক্তি। সোমাকে গাড়ি চালাতে চালাতে রাস্তার দিকে নজর রাখতে হয়, কারণ আইসক্রিম শপে একই রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। অন্য কোনো রাস্তা নিলেই অয়ন পেছন থেকে কাচের জানালায় জোরে জোরে আঘাত করে। ‘নো, নো...দিস ওয়ে দিস ওয়ে’। রাস্তা ভুল হলে মাফ নেই।

আইসক্রিমের দোকানে ঢুকেই সোমা একটা মিডিয়াম ভ্যানিলা ফ্লেভারের কোনো আইসক্রিম অর্ডার করে। তারপর দোকানটির বাইরে একটি গাছের নিচে ছায়াশীতল নীল বেঞ্চে গিয়ে অয়ন বসে। প্রথম দিন সোমা এই জায়গাটা বেছে নিয়েছিল, কারণ এখানে রোদের আলোর তীব্রতা নেই, ফ্লুরোসেন্ট লাইট নেই আর দোকানের মিউজিক শোনা যায় না। তীব্র আলো আর শব্দ অয়নকে ভয় পাইয়ে দেয়। নীল চেয়ারে বসে আইসক্রিম খাওয়ার সময় তাকে বেশ আনন্দিত মনে হয়, সে হাত নাড়তে থাকে পাখির মতো করে। খাওয়া শেষ হলে ফিরে আসার সময় আইসক্রিমের দোকানে যে মেয়েটি বসে থাকে, তাকে দরজায় দাঁড়িয়ে বলে ‘বাই মিরান্ডা’। অবশ্য মেয়েটির মুখের দিকে তাকাবে না। কখনো অয়নকে জড়িয়ে ধরতে চাইলেও সে তাকে সরিয়ে দেয়। মনে হয় সে তার নিজের জগতে আছে। সেই জগতে আর কারও প্রবেশাধিকার নেই, এমনকি সর্বক্ষণের সঙ্গী যে মা, তারও নেই।

এ সবকিছু রিলিজিয়াস রিচুয়ালের মতো নিয়ম করে করতে হবে। নিয়মে বাইরে কিছু হলেই অয়ন ভীষণ মুষড়ে পড়ে। তখন কানে হাত দিয়ে, হাত-পা ছুড়ে কান্না আর চিৎকার শুরু হয়। অটিস্টিক ‘মেল্টডাউন’ সে এক ভয়াবহ ব্যাপার।

বিভিন্ন টেস্ট আর ইভ্যালুয়েশনের পর আড়াই বছর বয়সে নিশ্চিতভাবে জানা গেল অয়নের মাইল্ড অটিজম আছে। প্রথম দিকে সোমার বিশ্বাস হতে চায়নি। অনেক দিন পর্যন্ত সে ভাবত কোথাও ভুল হচ্ছে। সোমা আর তার বর নাভিদ দুজনই মেধাবী। এমন একটা পরিবারের প্রথম সন্তান অনেক বুদ্ধিমান হবে, পরীক্ষায় পারফেক্ট স্কোর করবে—এমন প্রত্যাশা ছিল। অথচ আড়াই বছর হয়ে যাওয়ার পরও যখন কোনো কথা বলেনি, তখন সোমা চিন্তিত হলো। তারপরও মনে আশা ছিল হয়তো আস্তে আস্তে শিখবে। কিন্তু নিশ্চিতভাবে জানার পর কষ্ট, রাগ আর ডিপ্রেশন একসঙ্গে শুরু হলো। প্রথম দিন দরজা বন্ধ করে চিৎকার করে মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে কেঁদেছে। আমার সন্তান কেন এমন হবে?

তিন থেকে চার বছর ধরে তার জীবনযাত্রায় বড় পরিবর্তন করেছে। দাওয়াত, সোশ্যাল মিডিয়া, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন—সবকিছু থেকেই অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছে।

ছেলেকে নিয়ে বিভিন্ন থেরাপিতে ছুটতে হয় আর দুশ্চিন্তা করতে করতে নিজের ব্যক্তিতেও কিছু পরিবর্তন এসেছে। ঠিক ঈর্ষা নয়, কিন্তু অন্য বাবা-মায়েরা যখন বাচ্চার গ্রেড বা কোনো অর্জন নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে পার্টি দেয় বা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দেয়, সোমার খুব রাগ হয়। আগে সে এমনভাবে ভাবত না, কিন্তু এখন মনে হয় বাচ্চা মেধা নিয়ে জন্মেছে, তাই ভালো ফল করছে। এতে তোমার কৃতিত্ব কোথায়?
রাগগুলো অনেক সময় গিয়ে পরে নাভিদের ওপর।
- তুমি দায়ী।
- আমি দায়ী? কীভাবে?
- তোমার ব্লাডে প্রবলেম।
- ডাক্তার বলেছে তোমাকে?
- ডেফিনেটলি তুমি আর তোমার ফ্যামিলি দায়ী।

- দেখো, আমাকে ব্লেইম না করে ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নাও। ওর কেস মাইল্ড। ছেলেটা কথা বলতে পারছে, ধীরে ধীরে অনেক উন্নতি হয়েছে। ভালো জিনিসে ফোকাস করো, বি পজিটিভ। এর থেকে খারাপ কিছু হতে পারত। এভাবে ভেবে দেখো সিডিসির মতে ইউএসএতে এখন ৫৪টা বাচ্চার মধ্যে একজন অটিস্টিক। এটি ‘আনকমন’ কিছু নয়। অটিস্টিক বাচ্চাদের অনেক প্রতিভা থাকে।

নাভিদ অনেক স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছে, এটা সোমাকে ভীষণ রাগিয়ে দেয়। এত বড় এক চিন্তা মাথায় নিয়ে মানুষ এত নির্লিপ্ত থাকে কীভাবে? যখন আমরা থাকব না, তখন কী হবে এই ছেলের? ক্ষোভ থেকে আউট বার্স্ট হয়, চিৎকার-চেঁচামেচি করে। এসব থেকে যা হচ্ছে দুজনের মধ্যে দেয়াল তৈরি হচ্ছে। নাভিদ তাকে এড়িয়ে চলে। সারাক্ষণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ছেলের প্রতি কর্তব্য করছে না, তা নয়। কিন্তু একটা নীরব দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সোমা মাঝেমধ্যে কাঁদে, তখন নাভিদ দরজা খুলে বাসা থেকে চলে যায়। একবারও পাশে এসে বসে না, একবারও কিছু বলে না। যখন সবচেয়ে বেশি দরকার সাহচর্য, তখন কোথাও কেউ নেই।

২.
‘আউট অব বিজনেস’
আইসক্রিমের দোকানের বাইরে কথাটা খুব বড় করে লেখা। এখানে তারা ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে।

সোমার মাথা কাজ করছে না। এ পর্যন্ত এসে আইসক্রিম না দিলে অয়ন ভয়ংকর কান্না জুড়ে দেবে, হয়তো নিজের মাথায় আঘাত করবে, এমনকি গাড়ির দরজা খুলে চলে যাওয়ার চেষ্টা করবে, রাগ হলে তার কোনো ভয় থাকে না। একবার শিকাগো এয়ারপোর্টে এক ঘণ্টা মাটিতে শুয়ে শুয়ে কেঁদেছিল পছন্দের আইসক্রিম না পেয়ে। সোমার ভীষণ দিশেহারা লাগছে।

সোমা ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, আজকে এখানে আইসক্রিম নেই। আমরা অন্য একটা দোকানে যাব।

আইসক্রিম খাবে...আইসক্রিম খাবে...আইসক্রিম খাবে...
সঙ্গে সঙ্গে সে হাত দ্রুত নাড়তে শুরু করল। সে যে উত্তেজিত হচ্ছে, এটি তার একটি সাইন। সোমা ব্যাক মিরর দিয়ে অয়নের দিকে তাকায়, যদিও সে জানে অয়ন চোখে চোখ রাখবে না। সোমা গাড়ি স্টার্ট করল আর সঙ্গে অয়ন জানালায় হাত দিয়ে জোরে জোরে আঘাত করে কাঁদতে শুরু করে দিল। এখন আর স্পষ্ট করে কথা বলতে পারছে না। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। মাথা দিয়ে কার সিটের ওপর আঘাত করছে।

এভাবে তো গাড়ি চালানো যাবে না। সোমা গাড়ি বন্ধ করে কাঁপা কাঁপা হাতে সেলফোন থেকে নোটস বের করল। কিছুদিন আগে এক সেশনে তাকে শেখানো হয়েছিল কীভাবে এ রকম সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে করা যায়। সে ওই নোটস নাভিদকে মেইল করল, তারপর তাকে কল করল।

খুব উত্তেজিত স্বরে বলল,
- আইসক্রিমের দোকান উঠে গেছে। অয়নকে নিয়ে অন্য কোথাও যাওয়া যাবে না। পেছনে ভীষণ কাঁদছে, ‘মেল্টডাউন’ হচ্ছে। আমি গাড়ি চালাতে পারছি না। তুমি আমাকে সাহায্য করো। আমি একটা ফাইল পাঠিয়েছি ওটা পড়ে আমাকে বলতে থাকো কী করতে হবে। আমার সঙ্গে ব্যাগ আছে যাতে, ওকে শান্ত করার সব খেলনা, মিউজিক আছে।

নাভিদ সব শুনে বলল,
- ঠিক আছে। প্রথমে তুমি জোরে শ্বাস নাও। তোমাকে শান্ত থাকতে হবে। তোমার গলার স্বরে কোনো উত্তেজনা থাকা চলবে না।
- আমি শান্ত আছি।
- ঠিক আছে এখন মন দিয়ে শোনো। একটা কামিং মিউজিক ছেড়ে দাও, যা ৬০ বিট পার মিনিটের হবে, মানুষ যখন রেস্ট করে তখন হার্টবিট ৬০ থাকে। এটা ওর ভেতর একটা শান্ত ভাব নিয়ে আসবে।
- গান দিলাম কিন্তু গান শুনছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
- ওর মুখে একটা টিথার দাও, এতে একধরনের স্টিমুলেশন হবে আর কান্না থামবে।
- মিউজিক দিয়েছি আর টিথার মুখে নিয়েছে, কিন্তু হাত ঝাঁকাচ্ছে, মাথা ঝাঁকাচ্ছে আর চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে না মিউজিকটা শুনছে।
- আচ্ছা ব্যাগে বাবল করার জিনিস আছে?
- হ্যাঁ আছে।
- ওর সামনে গিয়ে বাবল করতে থাকো। খুব ধীরে ধীরে ওর মনোযোগ ওই দিকে নিয়ে যাও।
- বাবল করছি, সে তাকিয়েছে।
- ও যখন খেয়াল করেছে, তখন বাবলগুলো ওকে হাত দিয়ে পপ করাও, যাতে ওর মন অন্যদিকে চলে যায়।
- হ্যাঁ বাবল পপ করছে।
- বাবল ওর হাতে দাও আর ওকে বাবল করতে বলো। এতে ওর ডিপ ব্রিধ হবে আর মনোযোগ ওই দিকে থাকবে।

কিছুক্ষণ ওই প্রান্ত থেকে কিছু শুনতে পেল না নাভিদ। তারপর সোমা আস্তে করে বলল,
- একটু শান্ত হয়েছে। বাবল করছে।
- ঠিক আছে আমি কোনো আইসক্রিম নিয়ে আসছি।

কিছুক্ষণ পর সোমার মন হলো কেউ একজন জানালায় ছোট ছোট টোকা দিচ্ছে। সোমা ঘুরে তাকাল, নাভিদ এত দ্রুত চলে এসেছে?

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, আইসক্রিমের দোকানের মিরান্ডা মেয়েটি। মেয়েটি সম্ভবত স্প্যানিশ, হালকা বাদামি চুল। একটি মিডিয়াম সাইজের কোণ নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু তা-ই নয়, তার হাতে ছোট বাচ্চাদের একটি নীল চেয়ার। মনে হলো আকাশ থেকে দেবতা যেন একজন দূত পাঠিয়েছে।

- আমার মনে হয়েছিল তুমি শনিবার আসবে। আমি ভাবছিলাম তোমার ছেলে এসে খুব হতাশ হয়ে যাবে আর ওর মেল্টডাউন হতে পারে। আমি স্পেশাল নিড বাচ্চাদের নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করি। তুমি যখন ওকে নিয়ে আসতে, আমি ওকে খেয়াল করতাম। দোকানের সব ফার্নিচার যখন বিক্রি করে দিচ্ছিল, আমি এই নীল চেয়ারটি কিনে নিলাম।

দুজনে মিলে আগের জায়গায় চেয়ার দিয়ে অয়নকে বসিয়ে আইসক্রিম খাওয়াল। অয়ন আইসক্রিম খাচ্ছে আর পাখির মতো অন্য হাতটি নাড়ছে। সমুদ্রে ঝড় ওঠার পর যেমন আবার সূর্য উঠে আর সব শান্ত হয়ে যায় তেমন। মেয়েটি খুশিমনে তাকিয়ে আছে। সে বলল,
- আজকে তোমার পেছনে দাঁড়িয়ে দেখেছি, তুমি খুব সুন্দরভাবে ওকে ম্যানেজ করেছ। ইউ আর এ ওয়ান্ডারফুল মম অ্যান্ড হি ইজ অ্যান অ্যাঞ্জেল। বাই দ্য ওয়ে, ওর নাম কী?
- অয়ন
- বাহ চমৎকার নাম, শুনতে মনে হয় অ্যাঞ্জেল।

ততক্ষণে নাভিদ চলে এসেছে। মেয়েটিকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে ওরা বাসায় ফিরে এল।
গাড়িতে শান্ত একটা অ্যাঞ্জেলের মতো অয়ন ঘুমিয়ে আছে। দেবশিশুর মতো চেহারা, খাঁড়া নাক, ঝাঁকড়া চুল। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সোমার মনে হলো অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয় না। আজকে ছেলেটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে সন্ধ্যার জন্মদিনের পার্টিতে যাবে। মিরান্ডার মতো অনেক মানুষ আছে, যারা নিশ্চয়ই তার অ্যাঞ্জেলকে ভালোবাসবে।