আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস: উত্তম পুরুষ

বিশ্ব পুরুষ দিবস কয়েক দিন আগে পালিত হলো। নারীবাদীর জয়জয়কারের এই যুগে কেন পুরুষ দিবস গুরুত্বপূর্ণ হলো, সেটা বরং বলি। আমার এই অফিস এবং আগের অফিসে দিবসটি খুব ঘটা করে পালিত হতো। অনেস্টলি নারী দিবসের চেয়েও বেশি ঘটা করে পালন হতো। যেমন এই দিনে অফিসে ছোট্ট করে সকালের নাশতার আয়োজন হতো, তারপর কোনো পুরুষ স্বাস্থ্যবিষয়ক স্পেশালিস্ট আসতেন এবং তাঁরা নানান মোটিভেশনাল কথাবার্তা বলতেন।

গত বছর আমাদের অফিসে সব পুরুষ কর্মীকে ফুল বডি চেকআপ করার বন্দোবস্ত করা হয়। সুগার, কোলেস্টেরল, প্রেশার, ওয়েট, স্ট্রেন্থ ইত্যাদি চেক। কেন? কারণ, সমাজের এখনো একটি বড় অংশ মনে করে, পুরুষের স্বাস্থ্য খারাপ হতে নেই, স্বাস্থ্য খারাপ মানেই সে ঘাটের মরা টাইপ পুরুষ। পুরুষ হবে শক্তিশালী, সুঠাম এবং সুস্থ দেহের অধিকারী। তারা একটু–আধটু অসুখ সহ্য করে তাদের জীবন চালিয়ে নেবে, এমনটাই আমরা আশা করি।

ফলস্বরূপ বেশির ভাগ পুরুষের যেকোনো অসুখ ধরা পড়ে একদম লাস্ট স্টেজে। ধুম করে হার্ট অ্যাটাক করে তারা মারা যায়, কিংবা প্যারালাইজড হয়ে যায় এমন নজির আমরা অনেক দেখি। তাদের মৃত্যুর পর বা হার্ট ফেইলুরের পর আমরা প্রচণ্ড অবাক হয়ে বলি ‘একদম সুস্থ ছিল মানুষটা...কেমনে কী হইল বুঝলামই না।’ মোটেও না, সে ‘একদম সুস্থ’ ছিল না। কিন্তু সে একদম সুস্থ থাকার চেষ্টা বা ভান করে গেছে।

বাকি দুনিয়ার কথা জানি না, ‘মেন্স হেলথ’ অস্ট্রেলিয়ার হেলথ সেক্টরে সবচেয়ে ইগনরেড এরিয়া। শুধু কি শারীরিক অসুখ পুরুষেরা এড়িয়ে যায়? না, মানসিক অসুখও তারা সবার আগে এড়িয়ে যায়।

একটি ছেলে ডিপ্রেশনে, ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকলে আমরা কী ভাবব? আমরা ভাবব গাঞ্জা খেয়ে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। বন্ধুমহলে সেই ছেলেকে শুনতে হবে ‘আরে বেটা, মাইয়াগো মতোন কী ডিপ্রেশন ডিপ্রেশন করস?’

চারপাশে তাকান দেখবেন, বেশির ভাগ মেয়েই ডিপ্রেশনে পড়ছে কিন্তু ছেলেরা নয়, কেন? কারণ, তাদের ডিপ্রেশনের কথা বলতে নেই।

অথচ এই পৃথিবীতে প্রতি পাঁচজনের আত্মহত্যা কেসে চারজন হলো পুরুষ। আমেরিকায় ২০১৭ সালে ৪৭ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেছে, তার মধ্যে ৭০ ভাগ হলো পুরুষ। অস্ট্রেলিয়ায় এই পরিসংখ্যান হলো ৭৫ ভাগ। পুরুষ দিবসের মূল উদ্দেশ্যটাই হলো আমাদের সমাজে পুরুষের স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলার যে স্টিগমা তৈরি হয়েছে, সেটা দূর করা।

যাহোক পুরুষবাদীর ট্যাগ আমি অনেক আগে খেয়েছি। তবু আমার কখনোই কেন পুরুষদের ঢালাওভাবে ঘৃণা করতে ইচ্ছা করেনি, তার পেছনে আছে একজন সুপুরুষের গল্প। সেই মূল গল্পে এবার আসি।

আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে মানুষটি ছিল, সে ছিল একজন রাজপুত্রসম পুরুষ। এর মানে যদি হ্যান্ডসাম হয় তাহলে সেটাই ছিল। তার চোখের মণি ছিল বাদামি। তার চুল ছিল হালকা লালচে হলুদ আর গায়ের রং ছিল দুধে আলতা টাইপ। এতটাই হ্যান্ডসাম ছিল যে আমি পুরো জীবনে তার চেয়ে সুন্দর পুরুষ মানুষ খুব একটা দেখিনি। চশমা পরত, প্রচণ্ড রোদে তার গায়ের রং লাল আর চশমাটা কীভাবে কীভাবে যেন সানগ্লাস হয়ে যেত। সে সময় তাকে যে দেখত, সে–ই বলত উত্তমকুমার।

সুন্দর পুরুষদের অহংকার থাকে, কিন্তু তার কোনো অহংকার ছিল না। তার পুরো জীবনে কারও সঙ্গে উচ্চবাচ্যে কথা বলেনি, গলার স্বর ছিল নিচু এবং বিনয়ী। সে বেশির ভাগ সময় মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটত এবং ছোট–বড় সবাইকে সমীহ করত। তার সঙ্গে আমি যাকেই আলাপ করতে দেখেছি, আমি লক্ষ করতাম সে সবার আগে তার সামনে থাকা মানুষটার কথা শুনবে, তারপর তার নিজের বিবেচনা বলবে।

সে যেহেতু সুন্দর ছিল, তাই তাকে যেকোনো পোশাকেই অসম্ভব রূপবান লাগত। তবু তার অফিসে যাওয়ার জন্য নিয়ম করা দুটি প্যান্ট আর দুটি শার্ট ছিল। একটা আকাশি নীল, আরেকটা অফ হোয়াইট। শীতে তার একটাই চেকের সোয়েটার ছিল। সে ছিল অসম্ভব মেধাবী এবং উচ্চশিক্ষিত। মেধার কথা সাত গ্রাম জানত। খুব জটিল বিষয় ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে দিতে জানত। তার চাকরিজীবনে আমি দেখেছি, তাকে তার ম্যানেজার পর্যন্ত প্রচণ্ড সম্মান করতেন, তার সহকর্মীরা তাকে খুব সমীহ করত, মানত এবং বিশ্বাস করত।

ভোরবেলায় উঠত, যেখানে যে অবস্থায়ই থাকুক, নামাজ আদায় করত। তাকে আমি ভোরবেলায় জায়নামাজে বহুবার কাঁদতেও দেখেছি। সে সময় আমার ইচ্ছা করত, সেই জায়নামাজসহ তাকে নিয়ে আমি অনেক দূরে পালিয়ে যাই।

তার চোখের পানি আমার বুকে জড়িয়ে সারা জীবন থাকার প্রতিজ্ঞা আমি বহুবার করতে চেয়েছি কিন্তু সে বলত কাঁদতে হয় শুধু আল্লাহর দরবারে। আর কোথাও নয়, কারও কাছে নয়। তার যে বৈশিষ্ট্য আমাকে আজও ভাবায় সেটা হলো সে মিথ্যা বলত না। তাকে আমি অনেক সাংসারিক, পারিবারিক জটিলতায় পড়তে দেখেছি কিন্তু কখনো ভণ্ডামি বা মিথ্যা বলতে শুনিনি।

এত এত ভালো গুণের মানুষটার কি কিছুই খারাপ ছিল না? কোনো ভুল ছিল না? ভুল করেও কি সে কোনো ভুল করেনি?

ছিল...এই মানুষটারও ভুল ছিল। তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল সে তার নিজেকে ভালোবাসেনি। একফোঁটা না। সে নিজের স্বাস্থ্যের কথা ভাবেনি, সে নিজের জন্য ভাবেনি। তার চিন্তাজুড়ে ছিল সংসারের আয়রোজগার আর তার সন্তানেরা। এবং আমি সেসব সন্তানের মধ্যে একজন চরম দুর্ভাগ্যবতী সন্তান, যে তার বাবার জন্য জীবনে কিছুই করতে পারেনি। শত চেষ্টা করলেও আর পারবে না। শুধু স্বাস্থ্যের প্রতি তার অবহেলার জন্য, তাকে এই পৃথিবীর মায়া খুব অল্প বয়সে ত্যাগ করতে হয়েছিল।
অবশ্য পৃথিবীর প্রতি কি তার কোনো মায়া ছিল? নাকি সে পৃথিবীতে এসেছিল মায়া ছড়াতে? জানি না...

শুধু এটুকু বলব, মানসিক কিংবা শারীরিক স্বাস্থ্য সব মানুষের অধিকার, সে জায়গা থেকেই প্রতিটি পুরুষ মানুষের নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি স্পেশালি মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি আরও যত্নশীল হওয়া উচিত! সবাইকে বিশ্ব পুরুষ দিবসের লেট শুভেচ্ছা।

*লেখক: সাইকোলজিক্যাল ইনজুরি ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিলর, অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল কোর্ট, ক্যানবেরা