আবারও পয়লা ফাল্গুন

ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২১। পয়লা ফাল্গুন! কোভিডের এই দুঃসময়ের মধ্যে অবশেষে সাত বছর পরে দিলশাত ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছে। আনন্দের এ মুহূর্তে হঠাৎ একজনের প্রশ্ন, ‘আর ইউ এ সিঙ্গেল মম’? দিলশাতের সঙ্গে মেয়ে দিহানা ছাড়া আর কেউ নেই। আনন্দের এই মুহূর্তে হাজবেন্ড পাশে নেই, স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন হতে পারে!

২০১৪ সালে, ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো, বোল্ডারে (University of Colorado, Boulder) দিলশাত মলিকুলার বায়োলজিতে পিএইচডি শুরু করেছিল। অনেকটা যুদ্ধ করে আসা। মেয়ের বয়স তখন মাত্র ১ বছর। অনেক দিনের ইচ্ছা উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাবে। যেকোনো ভালো কাজ করতে হলে আগে নিজেকে গড়তে হয়। সেই উদ্দেশ্যেই এই পথচলা। ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়া, মানুষের প্রয়োজনে সে জ্ঞান কাজে লাগানো, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অবদান রাখা—এটাই তার সব সময়ের চাওয়া। কিন্তু আশা পূরণের পথ সবার জীবনে সহজভাবে আসে না। তাই যুদ্ধটা দিলশাতকে একাই করতে হয়েছে।

দিলশাতের মনে পড়ছে যুদ্ধের পটভূমি। ‘এই তো সেদিন পয়লা ফাল্গুন। ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১২, রাকিবের সঙ্গে হঠাৎ করেই বিয়ে হলো। কার্জন হল থেকে বাসায় ফেরার পথে রিকশার জন্য হাঁটছি। আচমকা একটা গাড়ি এসে থামল। অবাক! গাড়ি থেকে নেমে একজন জিজ্ঞেস করল কার্জন হলের অগ্রণী ব্যাংকটা কোথায়? আগন্তুকের সঙ্গে কিছুটা পথ হেঁটে দেখিয়ে দিলাম। মাস্টার্স ফাইনাল তখন শেষ হয়েছে মাত্র।

বাসায় বিয়ের কথাবার্তা চলছে। বিয়ের ব্যাপারে না–সূচক কথা বলতে পারিনি। পারিবারিকভাবে পাত্রের সঙ্গে যখন পরিচয়পর্ব চলছে, আমি আবারও অবাক! এ তো গাড়ি থেকে নামা সেই মানুষটি!’

সেই মানুষটি রাকিব। নিজেরই একটি কনস্ট্রাকশন ফার্মের সিইও, যাকে বোঝা খুব কঠিন। অবশ্য বুঝতে পারার জন্য যেটুকু সময় একসঙ্গে থাকার প্রয়োজন, তার খুব একটা সুযোগ হয়নি। বিয়ের ৯ বছর চলছে, সাত বছর ধরেই দুজন দুই প্রান্তে। সব সময় রাকিবের নির্লিপ্ত ভাব দিলশাতকে খুব দ্বিধাগ্রস্ত করে। কোনো ব্যাপারে বাধা দেয় না, আবার খুব যে সাপোর্ট করে, তাও সঠিক করে বলা কঠিন!

‘বাচ্চা, সংসার এসব ছেড়ে কী যেতেই হবে। এ তো বেশ কয়েক বছরের ব্যাপার! দেখি কত বছর লাগায়? এত দিনে সংসারের কী হবে? পিএইচডি করার এত শখ থাকলে বিয়ে করার কী দরকার ছিল’? এসব ছাড়াও শাশুড়ির অনেক কথা শুনতে হয়েছিল সেদিন।
‘যার যা স্বপ্ন তা তাকে পূরণ করতে দাও।’ রাকিবের এই কথায় ভরসা পেয়ে অবশেষে আকাশপথে একাই পাড়ি দিয়ে কলোরাডোতে এসেছিল দিলশাত। দিহানা থাকল বাবার কাছে। আগে নিজে সব গুছিয়ে তারপর মেয়েকে নিয়ে যাবে, এটাই সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

বায়োলজিক্যাল সায়েন্সে পিএইচডি বেশ কয়েক বছরের একটি কমিটমেন্ট। কোর্সের লোড, রিসার্চের প্রেশার এবং অন্যান্য রিকয়ারমেন্ট সম্পূর্ণ করা ছাড়াও নানা রকম চড়াই-উতরাই! বিশেষ করে মায়েদের জন্য যেখানে অনেক দায়িত্ব থাকে একই সঙ্গে।

প্রথম তিন বছর খুব ব্যস্ত সময়। প্রথম সেমিস্টার শুধু ল্যাব রোটেশন অর্থাৎ তিনটা ল্যাবে রিসার্চ করার পর প্রফেসর বাছাই করার সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর রিসার্চের কাজ শুরু হয় প্রধান মেন্টরের সঙ্গে। সব কোর্স ওয়ার্ক শেষ করে কোয়ালিফাইং পরীক্ষা দিতে হয়। টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট (Teaching Assistant, TA) হিসেবে কাজ, রিসার্চে কিছুটা প্রোগ্রেস, তারপর প্রিলিতে (Preliminary Exam) বসতে হয়। এই পরীক্ষায় পাস করলে পিএইচডি ক্যান্ডিডেট হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া যায়। এরপর রিসার্চ শেষ করে ফাইনাল ডিফেন্সে করে তবেই ডক্টরেট ডিগ্রি নিতে হয়। এসব সম্পূর্ণ করতে বেশ কয়েক বছর তো লাগবেই!

দিলশাত এক এক করে সব বাধা অতিক্রম করে প্রিলি পরীক্ষার দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই অনেক কষ্ট করে মেয়েকে নিজের কাছে আনতে পেরেছে। স্কুলে ভর্তি করেছে। সবকিছু সামলাতে কষ্ট হলেও তা চালিয়ে নিতে হয়েছে।

শুধু দিলশাত নয় আরও অনেক পিএইচডি স্টুডেন্ট আছে, যাদের পরিস্থিতি ভিন্ন হলেও যুদ্ধটা একই রকম। গ্ল্যাডিস একজন সিনিয়র স্টুডেন্ট, প্রিলি শেষ করে ফাইনাল ডিফেন্সের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ও নাইজেরিয়ার মেয়ে। চার বাচ্চাসহ স্বামী নাইজেরিয়াই থাকে। কাজের ফাঁকে বছরে একবার ছুটি নিয়ে পরিবারের সঙ্গে দেখা করে আসে। ক্যারোলিনা সিঙ্গেল মা, তিন বছরের ছেলে আছে একটি। ক্যারোলিনার মা একই শহরে থাকায় মাঝেমধ্যে ছেলেকে তার মায়ের কাছে রেখে কাজ সামলাতে হয়।

নেহাত কম কষ্ট হয় না মেয়েটির। ইউলন্ডার তিন মেয়ে, তার স্বামী সপ্তাহের শেষে গাড়ি চালিয়ে অ্যারিজোনা থেকে এসে দেখা করে যায়। স্বামী-স্ত্রী দুজন দুই জায়গায় থাকছে, বাচ্চাদের নিয়ে মা ইউলন্ডা কষ্ট করে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু পিএইচডি শেষ করার জন্য। এসব মা তাদের বাচ্চাদের দেখাশোনা করে সব দিক সামলে চলে।

বিভিন্ন মায়েদের পরিস্থিতি দেখে মনের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করেছে দিলশাত সব সময়। ভাবতে অবাক লাগে সবার কালচার ভিন্ন হলেও সব মা একই লক্ষ্যের জন্য লড়ছে। এদের সবার চোখে স্বপ্ন, মনে অসম্ভব দৃঢ়তা। গন্তব্য শুধু একটিই—ভালো কাজ করা, প্রোফেশনাল হয়ে কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে অবদান রাখা। তাই সবাই লড়ছে, কারণ টিকে থাকার নামই জীবন—ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে নয়।

দিলশাতও কখনো হাল ছেড়ে দেয়নি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ২০১৯ সালে প্রিলি পরীক্ষায় পাস করেছে। এই আনন্দের খবরটা শ্বশুরবাড়িতে জানিয়েছিল, ‘আমি এখন Ph.D. Candidate’। উত্তরে শাশুড়ি বলেছিলেন, ‘মাত্র candidate? তোমার Ph.D নিয়ে তুমিই থাকো’। তিনি কখনোই নিজস্ব চিন্তাধারা বা মতবাদের বাইরে কথা বলেন না। তাই দিলশাতকে নানা রকম কথা সহ্য করতে হয়। এই নিয়ে অনেকবার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তাঁর ছেলের জীবনে দিলশাতের আর প্রয়োজন নেই।

খবরটা শুনে রাকিব যে খুব খুশি হয়েছে বোঝা যায়নি, শুধু জানতে ছেয়েছিল ‘আর কত দিন লাগতে পারে’? গত সাত বছরে রাকিবের সঙ্গে মাত্র একবার দেখা হয়েছে যখন মেয়েকে আনতে ঢাকা গিয়েছিল। দিলশাত সব সময় ফোন, ই–মেইল, টেক্সট, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, যা আছে সবকিছুর মাধ্যমেই যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু রাকিব বাচ্চার খবর জানতে চাওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে খুব বেশি কথা বলে না।

দিলশাত প্রায়ই ভাবে, ‘আমার অপরাধ কী? শুধু উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে এসেছি, এটাই কি আমার প্রধান অপরাধ। আমি তো বিয়ের রাতেই বলেছি লেখাপড়া আর গবেষণা করা হলো আমার কাজ। তবে অবশ্যই সেটা আমার সংসারকে উপেক্ষা করে নয়। শুধু পরিস্থিতির কারণে সংসার থেকে দূরে আছি এর বেশি তো কিছু না।

সময়ের অপেক্ষায় আছি। ডিগ্রিটা হয়ে গেলেই এক জায়গায় স্থির হতে হবে। কিন্তু দেশে বা সংসারে আমার জায়গা হবে তো’?

দিলশাত তার কাজ, স্বপ্ন, স্বামী, সংসার, পরিবার সবকিছুকে ভালোবাসে বলেই ধৈর্যের সঙ্গে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। দুঃখ শুধু যে এই কথাগুলোই সে যেভাবে বোঝাতে চায় পরিবারের লোকেরা সেভাবে নিতে পারে না! তাই খুব শঙ্কা হয়, এত কিছুর বিনিময়ে সে কি সে তার সংসার হারাবে? শোনা যাচ্ছে রাকিবকে আরেকটি বিয়ে করার জন্য তার মা খুব জোরাজুরি করছে। রাকিব কেন নিশ্চুপ? দিলশাত জানে না তার জীবন তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।

পরিশেষে, ‘পয়লা ফাল্গুন আমার জীবনে সব সময় নতুন কিছু পাওয়ার দিন—রাকিবের সঙ্গে বিয়ে, দিহানার জন্ম আর আজ সাত বছরের বিনিময়ে পিএইচডি। এত আনন্দের মুহূর্তে রাকিব কি কিছুই জানাবে না’?

পোস্টডক্টরাল পজিশনের জন্য দিলশাত বিভিন্ন জায়গায় কথা বলছে। কোথায় জয়েন করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। রাকিবের সঙ্গে কথা বলা খুবই জরুরি। বিভিন্ন ই–মেইল দেখছিল হঠাৎ স্তম্ভিত! কেন তার চোখ খুব জ্বলছে! যেন ‘নয়নের জল নয়নে রহেনা, অঝোর ধারায় ঝরিছে’।

‘চোখের দ্যুতি কি সবার একইভাবে প্রজ্বলিত হয়? তোমার চোখে ‘স্পার্কলিং’ দেখেছি প্রথম দিনই! তোমার মূল্যবোধ আমায় এই সাত বছর অপেক্ষা করা শিখিয়েছে। মা আমায় নানাভাবে বলেছে এই মেয়ে স্ফুলিঙ্গ, সংসার করার জন্য নয়। আমি জানি, যে স্ফুলিঙ্গ দিয়ে আমার এই দহন তা অন্য কিছুতে শান্ত হবে না। আমার ভেতরে যার জন্য আলো অনির্বাণ, তা কেউ নেভাতে পারবে না। তাই এত দিন নীরব থেকেছি যেন তোমার লেখাপড়ার কোনো ক্ষতি না হয়। তোমার যুদ্ধটা তুমি একাই করে জয়ী হবে—এই দিনের প্রতীক্ষায় ছিলাম।

ডক্টর দিলশাত জাহান, ইউ আর নট এ সিঙ্গেল মম। আমি রাকিব আহসান সব সময়ই আছি তোমার পাশে। আমরা যেখানেই থাকি একসঙ্গে থাকব।

আজ আবারও পয়লা ফাল্গুন! দিলশাতের জীবনে এর চেয়ে মূল্যবান আর কী হতে পারে!


* লেখক: ড. ফারহানা রুনা, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র