আমরা কেন ভিন্নমত মেনে নিতে পারি না

প্রতিদিন চাইছি, সেই দিনটার পর সপ্তাহ খানেক ছুটি। সম্ভব? কাজ জমে যায়, নোট সাইন অফ করতে হয়। ছুটি নেওয়ার শাস্তি হয়ে যায়। কী যে চাই ইদানীং...ছেলের ঠান্ডা লাগিয়ে বায়না, মা খাইয়ে দাও। এদিকে মেয়ে খেতে পারছে না, তার আক্কেলদাঁত তুলে দিয়েছে। শুকনো মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সকালে কাজে যেতেই শুনি, ডেথ সার্টিফিকেট সাইন করতে হবে। খুঁজে দেখি তিন সপ্তাহ আগেও তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, সুস্থ মানুষ। ন্যাচারাল ডেথ। হায় জীবন!

এই একটু সময়ের জন্য, তার সুখশান্তির জন্য নিরলস প্রচেষ্টা। ভালো মানুষ হও, রিলিজন, বিভাজন, দিনরাত দৌড়ের ওপর, এর দোষ/তার দোষ/নিজেদের ব্যক্তিত্বের অভাব, সংঘাত, লোভ, অপমান, অসহায়ত্ব, ভুল বোঝা, ভুল না ভাঙা, ইগো, আরও কত কিছুর মিশেল, পূর্ণাঙ্গ চলচিত্র। কারওটা বাম্পার হিট, বিষয়বস্তু ফাঁকা হলেও। কারওটা পুরোই ফ্লপ, যদিও তার কাহিনি অসাধারণ। সময়, সময়ের চাহিদা। জীবন। এই তো শেষ, তারপর কেউ পোড়ে, কেউ মাটির নিচে—হিম শীতল! অপেক্ষা, অপেক্ষা পরবর্তী লাইফের। কেউ বারবার জন্মায়, কেউ শুধু একবারই।

মন খারাপ হয়, তারপর ছক কষতে হয়। সময়ের হিসাব করতে হয়। নয়তো পরবর্তী অসুস্থ লোক অসন্তুষ্ট হয়। তার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিতে হয়। ভুলে যেতে হয় মৃত ব্যক্তির কথা। সময়ের হিসাব, কতক্ষণে লেখা শেষ করা যাবে।

প্রতিটি ব্যক্তির সমস্যা ভিন্ন, ভিন্ন তাদের স্ট্রাগল। কেউ দশটা মরণাপন্ন সমস্যা নিয়েও বেঁচে থাকে। কেউ এক সমস্যাই সামাল দিতে পারে না। সবার স্ট্রাগল দেখলে জীবনের গূঢ় মানে বোঝা যায়, আবার প্রশ্ন জাগে মনে, কেন? আসলেই কি কোনো মানে আছে?

প্রশ্ন জাগে মনে কত কিছুর। উত্তর কিছু জানা, কিছু অজানা। ক্যানসার সার্ভাইভার দেখলে যেমন মন ভালো হয়, খারাপ হয় তেমনি লক্ষণ ফিরে এলে। মৃত্যু! মৃত্যু কত সহজ। আবার কত কঠিন। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমরা কি ঘোরের মাঝে আছি? মনে হয়, মাল্টিপল ডির গ্লাস চোখে হয়তো সব চলছে। চশমাটা খুললে কি দেখা যাবে? কোনটা আসলে সত্যি? ঘুমের মাঝে স্বপ্ন, স্বপ্নের মাঝে জেগে থাকা! চেতনা–অবচেতন—কোথায় আমাদের বসবাস? কেন?

প্রথম যখন জেনেছিলাম, কেন একটা প্রশ্ন, আর সেটা করা যায় যতক্ষণ না উত্তর তোমাকে স্যাটিসফাই করে। বিরক্ত হয়েছিলাম যে বলাই বাহুল্য। আমরা প্রশ্ন করা সমাজ থেকে আসিনি। ভাববাচ্যের সমাজ থেকে এসেছি। অলিখিত নর্ম। প্রশ্ন করাটাই অপমানজনক, অসম্মানজনক, মূর্খতার প্রমাণ। আর কেউ যেকোনো উত্তর আসলেই জানে না বা জানলেও স্যাটিসফাইং উত্তল নেই, সেটা বলে না। দমন শুধু শক্তির জোরে। আবার স্যাটিসফাইং উত্তরও ডিপেন্ড করে কে কী উত্তর চাইছে বা উত্তর দিতে চাইছে—এত এত ভ্যারিয়েবল! বেঁচে থাকাটাই মিরাকল। মৃত্যুই সহজ। কিন্তু শেষ কী? কেন? কেন নয়?

হুম্‌, আমি জানি আমার প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই। যে যার মতো বলবে, তাদের অবস্থান থেকে, বিশ্বাস থেকে, শিক্ষা আর ম্যাচুরিটি থেকে। যেমন পৃথিবী একসময় চ্যাপটা ছিল। তারপর গোল হলো, তারপর কিছুটা কমলালেবুর মতো। মাত্রা! মাত্রা বদলায় সময়ের সঙ্গে! আকাশের তারারা গ্রহ হয়, নক্ষত্র হয়, সূর্য হয়। গ্রহগুলোও তাদের সম্মান হারায়, তারারাও খসে পড়ে, সূর্যেরও মৃত্যু হয়। সমুদ্র শুকিয়ে যায়, নদীরাও হারিয়ে যায়, মরুভূমি তৈরি হয়। আবার মরূদ্যান ও হয়, সময়ের ফেরে সেখানে শস্যও ফলে। মানুষের জাত বদলায়, রং বদলায়, বিশ্বাস বদলায়। আমরা কী নিয়ে পড়ে থাকি? কী নিয়ে হানাহানি করি? রিপুর তাড়না—মৃত্যু জেনেও আমৃত্যু সে তাড়না নিয়ে পড়ে থাকি।

প্রশ্ন আর প্রশ্ন। প্রথম পাঠ ধৈর্য। সে কোথায়? অস্থির, অসহিষ্ণু আমরা।
রেসপেক্ট—নিজের, অন্যের জন্য কোথায়? লোভ কেন যায় না? সুশিক্ষিত হই না কেন?
কেন অন্য ভিন্ন, সেটা মেনে নিতে পারি না?

  • লেখক: শারমীন বানু আনাম, আমেরিকা