আমার তিলোত্তমা

রাতুল, রাহুল, রোমেলসহ আমরা বন্ধুরা সবেমাত্র কলেজে উঠছি তো সবকিছু রঙিন রঙিন লাগছে, সবকিছুতেই একটু বেশি বাড়াবাড়ি। কলেজের সামনের মোড়ে বটতলায় ইদানীং এক জ্যোতিষীকে বসে থাকতে দেখা যায়। রাহুল আবার এসব ব্যাপারে বড়ই আগ্রহী, রোমেলও কম যায় না। খালি আমি–রাতুল শুধু এসব ব্যাপারে নয়, কেন জানি সব ক্ষেত্রে উদাসীন।

দুজনেই বলল হাত দেখাবে, আমার ওসব এ বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই কিন্তু নিরুপায় হয়ে যেতে রাজি হলাম কিন্তু হাত দেখাব না বললাম।

ওদের দুজনের দেখা শেষে জ্যোতিষী আমারটা দেখতে চাইল, দাও তোমারটা ফ্রি দেখে দিচ্ছি।

আমার হাতটা দেখে জ্যোতিষী যা বললেন, আমি কিছুটা পুলকিত হলাম! বলে কী পাগলা! আমি নাকি শিগগিরই প্রেমিকা পেতে যাচ্ছি! তাও এই সেই প্রেমিকা নয়, একদম তিলোত্তমা প্রেমিকা, তার সঙ্গে নাকি আমার বিয়েও হবে! বলে কী? আমি সরাসরি পাত্তা না দিলেও ওই যে বললাম না মনে মনে ঠিকই পুলক অনুভব করতে লাগলাম। তিনজনের হাতের রেখায় আমারটা নাকি ভালো কথা বলেছে, তাই শাস্তি হিসেবে আজকের নাশতার বিলটা নাকি আমাকেই দিতে হবে, শালা রোমেল কোত্থেকে যে এসব আইন বানায়!

সারাক্ষণ মাথায় জ্যোতিষীর কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। পরদিন ওই দুই শালাকে না জানিয়ে চুপিচুপি গেলাম জ্যোতিষীর কাছে, আমাকে দেখে একটু ভাব নিল, বললাম তাঁকে কাল যে বললেন আমার কপালে তিলোত্তমা প্রেমিকা জুটতে যাচ্ছে, তা কীভাবে?
১১১ টাকা লাগবে, একটা তাবিজ দিচ্ছি, ওটা বাহুতে লাগিয়ে ৩৩ দিন রাখতে হবে।
ভণ্ডর ফিগারগুলো শুনছেন, ১১১ টাকা, ৩৩ দিন, এরা ভালোই জানে মানুষকে বোকা বানাতে। তারপরও তার কথা আমার বিশ্বাস হতে লাগল।

পকেটে টিউশনির টাকা ছিল, নিয়েই নিলাম তাবিজ। যে আমি শীতকালেও হাফ শার্ট, টি-শার্ট গায়ে দিতাম, সেই আমাকে প্রচণ্ড গরমের মাঝে ফুলহাতা জামা গায়ে দিয়ে কলেজে আসতে বন্ধুরা সব অবাক। আমি তো তাবিজ লুকাতে গায়ে দিছি, সেটা কাউকে বুঝতে দিলাম না। বন্ধুরা যা বদ, তিলকে তাল বানিয়ে পুরা কলেজ নাচিয়ে ছাড়বে।

পুরো কলেজ ঘুরে একটা তিলোত্তমা মেয়ে খুঁজে পেলাম না। প্রথম বর্ষে (স্নাতক) ফরম নিতে এক মেয়েকে আসতে দেখলাম। ঠিক জ্যোতিষীর বর্ণনা দেওয়া সেই মেয়েটির মতো, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সিনিয়র। তারপরও তার ক্লাস শুরুর অপেক্ষা করতে থাকলাম। সেই মেয়েটিকে ভেবে দিন কাটছে এখন আমার। শুধু হিসাব মেলায়, আমার এক মামা তাঁর দুই বছরের বড় এক মেয়েকে বিয়ে করেছে, তাও প্রেম করে, বিশ্বখ্যাত তারকা ক্রিকেটার শচীন তাঁর চেয়ে বয়সে বড় নারীকে বিয়ে করে কি দিব্যি সুখে দিন কাটাচ্ছে, আমি কেন পারব না? এসব ভেবে ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম প্রপোজ করার।

প্রথম দিন একটু ভাব জমানো কথা বলে, দ্বিতীয় দিন আগপিছ না ভেবে প্রস্তাব দিয়েই ফেললাম। নীলা আপুর রক্তচক্ষু দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। তিনি আমার আইডি কার্ড ভালোভাবে দেখে বললেন, বিকেলে তোমাকে ডাকা হবে, এখন যাও ভাইয়া...।

বিকেলে অরুপ ভাই আমাকে ডেকে পাঠালেন। অরুপ ভাই হলেন ছাত্র সংসদের ভিপি, আমাকে ডেকে সংসদের ভেতরে নিয়ে গেলেন, আমি তো ভয়ে অস্থির, আমি জানতাম না নীলা আপু অরুপ ভাইয়ের পেয়ারি...।

অরুপ ভাই কই কড়া কথার পাশাপাশি যা করলেন, শ্যামলা না হয়ে ফরসা হলে আমার গাল লাল হয়ে যেত নিশ্চিত, ভাগ্যিস কেউ ছিল না। মনে মনে জ্যোতিষীর ১৪ গোষ্ঠী উদ্ধার করছিলাম। রোমেল আর রাহুল উৎসুক হয়ে জানতে চাইল, অরুপ ভাই কেন ডেকেছিলেন।

আর বলিস না, আমি তো লেখালেখি করি, তাই সংসদের সাহিত্য সম্পাদকের পদটা আমায় দিতে চায়, বুঝলি? তোরা তো জানিস ওসবে আমি নাই, তাই মানা করে দিলাম।

পরদিন নীলা আপুর সঙ্গে দেখা, আমাকে ডেকে নিয়ে বলল, ভাই, কদিন পর প্রথমম বর্ষে অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়ে আসবে, ওখান থেকে একটা বেছে নিস, তোর যা চেহারা, তুই পেয়ে যাবি।

আর অরুপ যা করছে, তার জন্য আমি দুঃখিত ভাই। লজ্জায় মাথা ওঠাতে পারলাম না। কিছু বলা তো দূরের কথা, নিচের দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলে এলাম।

কিছুদিন পর প্রথম বর্ষের নবীনবরণ একটা মেয়েকে দেখলাম, মানে মেয়ে তো অনেক ছিল কিন্তু সেই তিলোত্তমা যাকে বলে, একজনই ছিল।

আমার কেন যেন মনে হলো মেয়েটি আমার জন্যই এই কলেজে এসেছে। নাহয় দুনিয়ায় তো আরও কলেজ ছিল, এখানে কেন?

এই মেয়ে নিশ্চয় আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। এই ভেবে অগ্রসর হতে লাগলাম। হাই, হ্যালোতে শুরু হলেও জানিয়ে দিলাম কোনো সমস্যা হলে যেন জানাই (অথচ নিজের সমস্যা নিয়ে যা তা অবস্থা)।

অনিতা মেয়েটির নাম, আমাকে সুন্দর করে রাতুল ভাইয়া ডাকত কিন্তু আমি চাইতাম শুধু রাতুল ডাকুক। সেদিন বলেই ফেললাম, অনিতা, তুমি আমাকে শুধু রাতুল ডেকো, আর আপনি নয়, তুমি করে বলবে।

কেন ভাইয়া?
প্রিয় মানুষের মুখে আপনি–ভাইয়া এসব মানায় না। তুমি বোঝো না অনিতা!

আমি তোমাকে ভালোবাসি অনিতা।

এরপর অনিতা যা শোনাল, আমি তো অবাক। তিনি নাকি ক্লাস এইট থেকে প্রেম করছেন, এক রাজকুমারের সঙ্গে। দেখেন তো অবস্থা!

ক্লাস এইটে থাকতে আমাকে আম্মু মাথায় সিঁথি কেটে না দিলে স্কুলে যেতে পারতাম না। আর তিনি সেই কালের প্রেমিকা, সেদিন থেকে প্রেম–ভালোবাসাকে সালাম জানিয়ে ইস্তফা দিয়েছিলাম।

পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবন শুরু করে দিয়েছি দুই বছর। কিছুদিন হলো অফিসে জুনিয়র এক কলিগ জয়েন করল। হৃদিতা নাম।

অফিসের সবাই হৃদি নামে ডাকে। তিলের মোহ আমার কেটে গিয়েছিল। ঠোঁটের নিচে হৃদির তিলটি আমাকে আবার প্রেমের হাতছানি দিয়ে ডাক দিচ্ছিল। বাড়ি থেকে মামার ফোন পেলাম। তিনি নাকি তাঁর কোনো বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে মোটামুটি পাকা করে ফেলেছেন। তারপরও দেখি, যদি হৃদিকে পটাতে পারি, মামারটাতে রাজি হব না।

এখন তো আর প্রেমের অফার করার বয়স নেই, তাই সরাসরি বিয়ের কথাই বললাম হৃদিকে।

কিন্তু তার নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে অনেকটা। আগামী মাসে হয়তো হয়ে যাবে। হতাশ হলাম আরও একবার।

অবশেষে মামার ঠিক করা মেয়ে দেখতে বাড়ির পথে রওনা দিলাম। আমার পছন্দ হলে হয়তো এঙ্গেজমেন্ট এমনকি বিয়েও হয়ে যাবে। বাসস্টেশনে হৃদির সঙ্গে দেখা। ও বাড়ি যাচ্ছে, তার বাড়ি আমার মামাবাড়ির কাছাকাছি। তবে ঢাকা থেকে একই বাসে যেতে হয়। যদিও সে আমার এক ঘণ্টা আগে নেমে যাবে। খুব ভালো লাগছে অন্তত তিন ঘণ্টা এই তিলোত্তমার পাশে বসে যেতে পারব।

নিজের বিয়ের কথাটা জানালাম না। অনেক গল্প হলো সারাটা পথ। হৃদি যখন ঘুমাচ্ছিল, জানালা দিয়ে আসা পাগলা হাওয়া তার চুলগুলোকে তিলের ওপর আনা–নেওয়া করছিল।

আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। এ সময়টুকুতে তাকে অনেক আপন লাগছিল। কী এমন ক্ষতি হতো যদি সে আমার হতো। হৃদির নেমে যাওয়ার সময় হলো। যাওয়ার সময় অনেক খারাপ লাগছিল, ইচ্ছা করছিল তাকে বসিয়ে রাখি আমার পাশে, কিন্তু তার আর আমার পথ তো দুদিকে বেঁকে গেছে আরও আগে। তাই শুধু তার চলে যাওয়াটাই দেখলাম।

পরদিন ভোরে মামাবাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম, সঙ্গে ছোট বোন, বড় বোন, আর আমার ছোট খালা। মামা বাড়ি থেকে আরও একটা মামাতো বোন আর মামি যোগ দেবেন আমাদের সঙ্গে তারপর কনে দেখতে যাব।

অবশেষে মেয়েদের বাড়ি গেলাম আমরা। মেয়েকে নিয়ে আসা হলো আমাদের সামনে। হালকা ঘোমটা টানা ছিল, ঘোমটা সরাতেই যে জিনিসটা আমার নজরে পড়ল, সেটা হলো ঠোঁটের নিচের তিলটি। আমি তো তখনই রাজি হয়ে গেছি মনে মনে। মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে তো আমি অবাক, মেয়েটিও। আরে এ যে হৃদিতা! আমি স্বপ্ন দেখছি না তো! কিসের এঙ্গেজমেন্ট, আমি তো চাইছিলাম তখনই বিয়ে করে ফেলি...।

তার দুদিন পরেই আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। এখন মা–বাবাসহ আমরা ঢাকাতেই থাকি। দুজনেই সকালে একসঙ্গে অফিসে যাই, একসঙ্গে ফিরি।

মাঝেমধ্যে রাস্তার মোড়ে কোথাও জ্যোতিষী দেখলে আমি থমকে দাড়াই, খুঁজেফিরি সেই মুখ। হৃদি আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে বলে, কী দেখো ওসব ভণ্ডের দিকে। আমি মুচকি হাসি হৃদির হাতখানি শক্ত করে ধরে সামনের দিকে পা বাড়াই ...।

*লেখক: জুলেখা হাসপাতালে কর্মরত, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত। [email protected]