আমি কাপুরুষ নই

অলংকরণ: আরাফাত করিম

দুটি শব্দের বন্ধনে উচ্চারিত তোমার নামটা আজও ভুলতে পারিনি। যে শব্দের অর্থ অতিক্ষুদ্র একটা বস্তু। যা খালি চোখে দেখা যায় না। আর সেটাই হলো তোমার নাম, অনু।

তোমার পুরো নামটা হলো অনুরাধা রায়। নামটা খুব একটা বড় না হলেও আমি তোমাকে অনু বলেই ডাকতাম। এখনো মনের গহিনে সেই নাম ঘুরে বেড়ায় এবং সেই নামটা আমার বুকের বাঁ পাশে লোহার ছুরি দিয়ে খোদাই করে লেখা আছে। সেটা তুমিও জানো। থাকবে আজীবন। ভালোবাসা নাকি মানুষকে অন্ধ করে। কিন্তু তোমার ভালোবাসা আমাকে দিয়েছে এক চরম দীক্ষা।

কদমের তলে একাকী নিরলে তোমার জন্য আর প্রহর গোনা হয় না। আবাদি জমির আলে কিষানির সাজে সেই তুমি আর হাঁটো না। গ্রামের মেঠোপথে ঘুরে বেড়ানো সেই চঞ্চল–চপলা মেয়েটির দেখা নেই । যাকে একবার দেখব বলে, অধীর আকাঙ্ক্ষাতে চোখ মেলে থাকতাম। একটু দেখব বলে, বেলা–অবেলা পন্থ চেয়ে থাকা হতো। সখিদের সঙ্গে আমার সম্মুখ দিয়ে হেঁটে যেতে। যে একদিন বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে, সেদিন আমি স্তব্ধ ছিলাম দীর্ঘ সময়। কেন জানি মনে হলো, প্রেমের এই বুঝি সূচনা হলো।

প্রথম যেদিন তোমার চিঠি পাই, সেদিন নিদ্রাহীন রজনীতে শুধু তোমাকে ভেবেছিলাম। তোমার চিঠির উত্তর দেব বলে বেশি কিছু লিখিনি। এগারো পৃষ্ঠার একটা চিঠি লিখি। সেই চিঠির উত্তরে তুমি আমাকে ভালোবাসি বলেছিলে এবং চিঠির প্রসঙ্গ তুলে বলেছিলে, তোমার চিঠি পেয়ে ভেবেছিলাম, তুমি বুঝি আমাকে একটা পাণ্ডুলিপি দিয়েছ। অধীর আগ্রহে খুলে দেখি প্রথম পাতার মধ্যিখানে লিখেছ, আমি তোমাকে ভালোবাসি। পাতার নিচে ডান পাশে লেখা, অপর পৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য। পাতা ওলটাতে দেখি, একই লেখা। সব কটি পাতাতে একই কথা লেখা ছিল। শেষের পৃষ্ঠাতে লিখেছিলে,
অনু, আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি।
ইতি,
অয়ন
তারপর দুজনাতে সেকি ছোটাছুটি হতো। পুকুরঘাট, কদমের মগডালে ওঠা, পাশের বাড়ির বড় ঠাকুরদার গাছ থেকে লিচু চুরি করা, আম চুরি করা, একই আইসক্রিম দুজন চুষে খাওয়া, রেললাইনের পাশে কাশফুলের মাঝে হারিয়ে যাওয়া, কলেজ ফাঁকি দিয়ে সালমান শাহ–শাবনূরের ছবি দেখা।

ছবি: সংগৃহীত

তোমার কাছে আসতে হতো লুকিয়ে। বাবা জানলে রক্ষা নেই। আর মায়ের বকুনির তো সীমা নেই। তুমি বলতে, পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাদের প্রেমকে ভিন্ন করতে পারবে না। অয়ন, তুমি শুধু আমার। আমি শুধু তোমার।

একদিন তোমাকে একা পেয়ে পাশের গ্রামের রঞ্জিত জড়িয়ে ধরেছিল। সে নাকি তোমাকে ভালোবাসে। তুমি তাকে কষে চড় মেরেছিলে। সে কথা তুমি আমাকে কেঁদে কেঁদে বলেছিলে। আমি তোমাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলাম। সেদিন তুমি আমাকে ছাড়তে চাইছিলে না। তুমি বলেছিলে, রঞ্জিত যা দেখে, তুমি কি তা দেখো না অয়ন? কী যে বলো অনু, বিয়ের আগে এসব হয় নাকি!

রেললাইনের পাশে সাদা কাশবন খেলা করে। মধ্যাহ্নের চিকচিকে রবির আলোয় কাশের বন উজ্জীবিত হয়। রেলগাড়ি এই আসে, এই যায়। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য সেই কাশবনে তোমাকে নিয়ে কত যে হারিয়ে যেতাম। দখিনা বাতাসে কাশফুল দুলত।
এক বিকেলে তুমি জেদ ধরলে, আরেকটা ট্রেন এলে আমরা চলে যাব। তোমার এই ছেলেমানুষি দেখে সেদিন আমি হেসেছিলাম, খানিকটা অবাকও হয়েছিলাম। পরে অবশ্য অবাক হওয়ার সর্বোচ্চ সীমানায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। কেননা রেললাইনে দুজনেই বসে আছি। এই বুঝি একটা ট্রেন আসছে! কিন্তু এল না। সময় বয়ে চলেছে, ট্রেন আর আসছে না।

অনুর আবদার রক্ষায় আছি। ঘড়ির কাটা টিক টিক করে করে ঘুরছে। ক্রমেই পশ্চিম আকাশে রবির আলো ডুবে যাচ্ছে। পৃথিবীর চারপাশ ঘিরে অন্ধকার নামছে । আশ্চর্য, ট্রেন আর আসছে না! সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাতের আগমন। আমি কয়েকবার ওই তোমাকে বলেছি, চলে গেলে ভালো হয়। তুমি এক পা–ও নড়তে চাওনি। আমার অবশ্য খুব একটা খারাপ লাগেনি। তোমার সঙ্গ আমার বারবারই ভালো লাগে। তুমি যে আমার অনু।
সেদিন একনজরে তোমাকে খুব দেখেছি। চোখে কাজল, ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক, পরনে লম্বা শাড়ি। চুলগুলো স্নিগ্ধ বাতাসে উড়ছে। তোমাকে যা লাগছে! যত দেখি ততই ভালো লাগে।

অন্ধকারে পৃথিবী ঢেকে গেছে। চারপাশ জনশূন্য। আছে শুধু কাশবন এবং শক্ত পাথরের ওপরে তুমি আর আমি। ইচ্ছা করছে তোমার শাড়ির ভাঁজে নিজেকে লুকাতে। একটু তোমার ছোঁয়া পেতে। আকাশের দিকে তাকালাম। হঠাৎ তোমার স্পর্শ অনুভব করলাম। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরেছ। তোমার সঙ্গে আমার আলিঙ্গন, যেন স্বর্গের সুখ আমাকে ঘিরে ধরেছে। তোমার নিশ্বাসের শব্দে কান ভারী হয়ে এল। তোমার গায়ের পারফিউমের ঝাঁজালো গন্ধ আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল।

কী অদ্ভুত প্রকৃতির নিয়ম। একটু আগেও কিন্তু নিজ থেকে তোমার স্পর্শ কামনা করছিলাম। অথচ এখন তুমি আমাকে আঁকড়ে ধরে আছ। তবে এবার আমি সরে যেতে চাইছি। কিন্তু পারছি না। তোমার গায়ে এত শক্তি। হঠাৎ অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজেকে তোমার কাছে সঁপে দিলাম। দুজনের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ গভীর হতে লাগল। তুমি বললে, ‘ওগো, তুমি আমাকে তোমার শরীরের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলো। আমাকে মেরে ফেলো। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে চাই না।’ তোমার কপালে একটা চুমু এঁটে দিলাম। তোমার চাওয়ার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছি।

হঠাৎ ফকফকা আলো চোখে লাগল। দুজনই উঠে দাঁড়ালাম। রাত ১০টা নাগাদ ট্রেন এল। ট্রেনের আলোকে হার মানাবে তোমার রূপের আলো। ট্রেন চলে যাওয়ার পর আবার নীরবতা। অনুর শাড়ির ভাঁজটা আর আগের মতো নেই। তোমার আবেদন, এসো....। কিন্তু আমি বলি, ‘ট্রেন এল, চলেও গেল। এবার চলো আমাদের যাওয়া যাক।’ তুমি আমাকে বারণ করলে। আমি আর তোমার কথা শুনতে চাইনি। অন্ধকার হলেও বুঝতে পারছি, তোমার ভেতরে প্রচণ্ড অভিমান কাজ করছিল। কিংবা আক্রোশও বলা যেতে পারে। সেটা বুঝতে পেরেছি, যখন তুমি আমাকে বলেছিলে কাপুরুষ।

গত দুই দিন তোমার সঙ্গে দেখা নেই। ফোনে তোমাকে পাচ্ছি না। তিন দিন পর জানতে পারি, তুমি শহরে চলে গেছ। তোমার কাপুরুষ বলাটার কারণ হয়তো এখন আমি বুঝতে পারছি। তুমি হয়তো সবকিছু জেনেশুনে সেদিন আমাকে তোমার রূপসাগরে ভাসাতে চেয়েছিলে। কেননা তুমি আমার থেকে অনেক দূরে চলে যাবে, সেটা আমি না জানলেও তুমি জানতে। আমার অশ্রু সাক্ষী। আমি তো তোমাকে এভাবে কখনো চাইনি, অনু। সেদিন তুমি যেভাবে চেয়েছিলে! কারণ, আমি কাপুরুষ নই। কত দিন হয়ে গেল। বছরের পর বছর কেটে গেল। কিন্তু তোমার দেখা আর পেলাম না। আজও তোমাকে দেখব বলে বেঁচে আছি, বেঁচে থাকি।

মনে পড়ে অনু, এক সকালে তুমি এলে লাল রক্তজবা নিয়ে। রক্তজবা আমার হাতে দিয়ে তুমি বলেছিলে, ‘চলো একটা ছবি দেখে আসি।’ আমি বললাম, ‘কী ছবি?’ তুমি আমার চোখে চোখ রেখে হাসিমাখা মুখে বলেছিলে, ‘ভালোবাসি তোমাকে।’
তোমার মুখে ভালোবাসি শব্দটা শুনে আমার খুব ভালো লেগেছিল। যার জন্য আবার জানতে চেয়েছিলাম, ‘ছবির নামটা যেন কী?’ তুমি তোমার স্কার্ফ দিয়ে আমার গলায় পেঁচিয়ে টান দিয়ে, তোমার খুব কাছে নিয়ে বললে, ‘ভালোবাসি তোমাকে।’ সেই তুমি আমাকে ছেড়ে আছ বহুদূরে।

শুনেছি, তোমার স্বামীর সঙ্গে বেশ সুখেই আছ। জীবনের জন্য ছুটে চলেছি। তোমাকে ভুলতে চেষ্টা করি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তোমাকে যত ভোলার চেষ্টা করি, তার চেয়ে বেশি মনের মধ্যে তুমি ফিরে আসো। তাই তোমাকে আর ভোলা হয় না। মাঝেমধ্যে তোমাকে ভাবলে আকাশটা কেন জানি কালো হয়ে যায়। কেন জানি পৃথিবীটা ঝাপসা হয়ে যায়। বড্ড অভিমানে জমাট হয় বেদনার অশ্রু। যে আমি তোমার অস্তিত্ব ছিলাম, সেই তুমি এতটা বদলে গেলে কীভাবে? অনুরাধা, বড্ড জানতে ইচ্ছা করে, ভুলেও কি একটু আমাকে পড়ে না মনে? তোমার জন্য মনটা কাঁদে। একটা কথা মনে রেখো অনু, তোমার অয়ন এখনো তোমারই আছে।

লেখক: এম হৃদয়, সিঙ্গাপুর