আসলেই কি বিদেশ ভালো

মেয়ে তাহিয়া আর ছেলে রায়ানের সঙ্গে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

অস্ট্রেলিয়াতে এখন চলছে শীতকাল। সময়ের হিসাবে অস্ট্রেলিয়াতে মোট চারটি ঋতু। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি গ্রীষ্মকাল, মার্চ থেকে মে শরৎকাল, জুন থেকে আগস্ট শীতকাল আর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর বসন্তকাল। অবশ্য সিডনিতে একটা কথা প্রচলিত আছে। সেটা হলো, তিনটি ‘ডাব্লিউ (W)’কে বিশ্বাস করতে নেই; সেগুলো হলো ওয়ার্ক (Work), ওমেন (Women) এবং ওয়েদার (Weather)। এখানকার আবহাওয়ার আসলেই কোনো ঠিক–ঠিকানা নেই। বলা হয়ে থাকে, এখানে একই দিনে চার ঋতুর দেখা মেলে হরহামেশা। তবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এখানে আসলে ঋতু দুটি—গ্রীষ্ম ও শীত।

গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা অনেক জায়গায় পঞ্চাশের ওপরে উঠে যায়, আবার শীতকালে তাপমাত্রা অনেক সময় শূন্যের নিচে নেমে আসে। আর শীত–গ্রীষ্ম দুই ঋতুতেই আবহাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে গরম অথবা ঠান্ডা ঝোড়ো বাতাস। গরমে এখানে বুশ ফায়ার (বনে আগুন লাগা) খুবই সাধারণ ঘটনা। আর শীতকালে শীতের তীব্রতা বাড়াতে মাঝেমধ্যেই শুরু হয় টানা বর্ষণ।

শীতকালে দিনের তাপমাত্রা যেমনই থাকুক, রাতের তাপমাত্রা অনেক কমে যায়। শীতের পোশাক, যেমন গরম পায়জামা–জ্যাকেটের পাশাপাশি পায়ে মোজা, মাথায় টুপিও পরতে হয়ে। আর শোয়ার সময় রুমে হিটার চালানো অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। রাতের এই কম তাপমাত্রার জের সকাল পর্যন্ত থাকে। এরপর আবার সন্ধ্যা থেকে হঠাৎ তাপমাত্রা কমতে শুরু করে। আবার এপ্রিলের প্রায় শুরু থেকেই ডে–লাইট সেভিংটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেটা আবার চালু হয় অক্টোবর থেকে। ফলে ভোর ছয়টা সাড়ে ছয়টার সময়ও বাইরে থাকে রাতের আঁধার। মানুষ উঠে পড়লেও তখনো পাখিদের কলকাকলি শোনা যায় না। এই সময়ে উঠে বড়দের কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হয়। সেখানে কলের গরম পানিই ভরসা। এরপর পুরোপুরি শীতের পোশাকে আবৃত করে বাইরে বের হতে হয়। এভাবেই চলে শীতকালের সময়টা। আর মানুষ এতে অভ্যস্তও হয়ে গেছে।

আমাদের পরিবারে আমরা মোট চারজন সদস্য। আমাদের মেয়ে তাহিয়ার বয়স ১১ বছর আর ছেলে রায়ানের বয়স ৫ বছর। মেয়ে পড়ে ইয়ার সিক্সে, পরের বছর হাইস্কুলে যাবে। সে হিসাবে তাকে বড়দের কাতারেই ফেলে দেওয়া যায়। আর রায়ান এ বছরই স্কুল শুরু করেছে। শুরুতে স্কুলে না যেতে চাইলেও এখন স্কুল বেশ উপভোগই করছে বোঝা যায়। আর আমাদের দুজনেরই ফুল টাইম জব, তাই বাধ্যতামূলকভাবেই ওদের আগে ও পরে স্কুল–কেয়ারে দিতে হয়। কেয়ার থেকে অন্য আরেকজন ওদেরকে স্কুলে নেওয়া ও আনার কাজটা করে। সকালে ওদের কেয়ারে নামিয়ে দিয়ে যার যার কাজে যাই। আবার কাজ থেকে ফিরে ওদের কেয়ার থেকে তুলে নিয়ে আসি। সময়ের হিসাবে সব মিলিয়ে দিনের ২৪ ঘণ্টার ১২ ঘণ্টাই ওরা কেয়ারে থাকে। বাকি ১২ ঘণ্টার মধ্যে যদি ৮ ঘণ্টা ঘুমের জন্য বাদ দেওয়া হয় আর থাকে মাত্র ৪ ঘণ্টা। তার মধ্যে আছে গোসল খাওয়াদাওয়া। সব মিলিয়ে ওদের সঙ্গে আসলে দিনের মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা আমরা থাকার সুযোগ পাই। আমরা সেই ক্ষতিটা কিছুটা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি সপ্তাহান্তের দিনগুলোতে ওদের সময় দিয়ে। অবশ্য সেখানেও থাকে অনেক ব্যস্ততা। বিভিন্ন প্রকারের বিষয় শেখার ব্যস্ততা। এভাবেই যন্ত্রের মতো চলে বিদেশের জীবন। আমি নিশ্চিত, বিভিন্ন দেশে প্রবাসী প্রথম প্রজন্মের জীবনযুদ্ধের চিত্রটা মোটামুটি একই রকম।

মাসুক হেলাল

যা–ই হোক, এবার আসি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়। আমাদের বাসা থেকে আমার অফিসের দূরত্ব ট্রেন–বাস মিলিয়ে দেড় ঘণ্টার ভ্রমণ। আবার ফেরার সময়ও দেড় ঘণ্টা লাগে। সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অফিস। কখনো শেষ করতে আবার দেরি হয়ে যায়, বিশেষ করে মাসের শেষে। আমাকে তাই বাসা থেকে বের হতে হয় ভোর সাড়ে ছয়টার সময় আবার পাঁচটায় কাজ শেষ করে বাসায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বেজে যায়। গিন্নির কাজের জায়গা বাসার কাছে হওয়ায় সকাল–বিকেল বাচ্চাদের কেয়ারে সে–ই নামায়–ওঠায়। কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তারদের থাকে রোস্টার ডিউটি। মাসের একটা সময় বাধ্যতামূলক নাইট ডিউটি করতে হয়। তখন সে রাত আটটা সাড়ে আটটার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যায়, আসে পরের দিন সকাল নয়টার দিকে। তারপর সারা দিন চেষ্টা করে ঘুমানোর। জানি না আদতেও ঘুমাতে পারে কি না? কারণ, হঠাৎ এই অভ্যাস তৈরি করা আসলেই অনেক কঠিন। এ সময়টায় আমার দায়িত্বে পড়ে বাচ্চা দুটিকে ভোরবেলা তুলে তৈরি করে কেয়ারে নামানোর।

গরমকালে ভোরবেলা ওদের ঘুম থেকে তুলতে তেমন একটা বেগ পেতে হয় না। কিন্তু শীতকালে ওদেরকে ঘুম থেকে তোলা মোটামুটি অসম্ভব একটা কাজ। আমি মুঠোফোনের ঘড়িতে ভোর পাঁচটার অ্যালার্ম দিয়ে রাখি। কারণ, তাহলে দেড় ঘণ্টা সময় হাতে পাওয়া যাবে ওদেরকে তৈরি করতে এবং কেয়ারে নামিয়ে দিতে। ওদেরকে নামিয়ে দিয়ে আমাকে সকাল ৬টা ৪৯–এর ট্রেনে ধরতে হবে মিন্টো স্টেশন থেকে। ইচ্ছা করেই মুঠোফোনটা অন্য ঘরে চার্জে রেখে আসি। যাতে অ্যালার্ম অফ করতে হলেও যেন আমাকে উঠতেই হয়। নাহলে দেখা যাবে, হাতের কাছে মুঠোফোনটা থাকলে অ্যালার্ম অফ করে আবার ঘুমিয়ে পড়েছি। এরপর নিজে হালকা ফ্রেশ হয়ে বাচ্চা দুটিকে তাড়া দেওয়া শুরু করি। মেয়েটা যেহেতু বড় হয়ে গেছে, দু–একবার ডাকার পরই সে নিজে থেকে উঠে পড়ে। আমাকে সাহায্য করতে শুরু করে। ইতিমধ্যে ছেলেটাও উঠে পড়ে, কিন্তু আবার সে শুয়ে ঘুমাতে চায়। তাই তাকে আমরা আপাতত সোফার মধ্যে শুইয়ে দিই। এদিকে আমি গিন্নির জন্য নাশতা তৈরি করতে থাকি, যাতে সারা রাতের হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে এসে নাশতাটা অন্ততপক্ষে শান্তভাবে করতে পারে। আর মেয়েটা শুরু করে টিফিন তৈরির কাজ। দুই রকমের ফল কেটে দুজনের টিফিন বাক্সে ভরা, দুজনের পানির বোতল ভরে ব্যাগের সাইড পকেটে রাখা। আর পাউরুটির মধ্যে ডিমভাজি আর টমেটো সস দিয়ে বার্গার তৈরি করা। ডিমটা আমিই ভেজে দিই, বাকি কাজটা সে করে।
এরপর দ্বিতীয় দফায় শুরু হয় ছেলেটাকে জাগানোর প্রক্রিয়া। মেয়েটা চলে যায় তৈরি হতে। ছেলেটা আর উঠতে চায় না। তখন ওকে একরকম জোর করে কোলে নিয়ে বাথরুমে যেয়ে দাঁত ব্রাশ করিয়ে এনে শুরু হয় স্কুলের পোশাক পরানোর কাজ। স্কুলের পোশাকটা পরিয়ে দিলে সে মোটামুটি ধাতস্ত হয়। অবশ্য অনেকদিন কোনোভাবেই তার কান্না থামানো যায় না। মাঝরাত্রে ঘুম থেকে উঠে সারা বাড়ি সে তার মাকে খুঁজে বেড়ায় আর মুখে এত দরদ দিয়ে ‘মাম্মি’ উচ্চারণ করে যে আমার নিজেরই চোখে জল চলে আসে। প্রথম দুদিন এভাবেই কেটেছে। আমি ঘুম থেকে উঠে তাকে বলেছি যে মা হাসপাতালে গেছে। সে বুঝে, কিন্তু কান্না আর থামায় না। এরপর অবশ্য আর ঝামেলা করেনি। ওকে তৈরি রেখে এইবার আমি তৈরি হতে শুরু করি। এরপর তিনজন একসঙ্গে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি। বাসার দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে হিমশীতল বাতাসের ঝাপটা এসে গায়ে লাগে। বাইরে তখনো গাঢ় অন্ধকার। তেমন কিছুই দেখা যায় না। তাই বারান্দার আলো জ্বালিয়ে আমরা জুতা পরে নিই। এরপর যখন বাইরে এসে দাঁড়াই, তখন বাসার বাইরে লাগানো সিকিউরিটি বাল্বের আলোটা জ্বলে ওঠে। সেই আলোতে আমরা প্রতিদিন একটা করে সেলফি তুলি, কারণ সেলফি তোলার অজুহাতে হলেও রায়ান একটু যাতে খুশি হয়।

এরপর ওদের সিটে বসিয়ে আমি গাড়ির গায়ের এবং লুকিং গ্লাসে জমা শিশির মুছতে শুরু করি। এই পানি এতই ঠান্ডা যে হাতের আঙুলগুলো মোটামুটি অবশ হয়ে যায়। এরপর প্রথমে মেয়েটাকে তার কেয়ারে নামাই, তারপর ছেলেটাকে। অনেক সময় ছেলেটা আর কোনোমতেই কেয়ারের ভেতরে যেতে চায় না। এমন কান্না শুরু করে, তখন ক্ষণিকের জন্য হলেও মনে হয়, কাজকর্ম সব বাদ দিয়ে ওদের সঙ্গে সময় কাটাই। ওদেরকে নামিয়ে দিয়ে আমি স্টেশনের দিকে যাওয়া শুরু করি। স্টেশনের কারপার্কে যখন গাড়ি পার্ক করি, তখন সবে পুব আকাশ লাল হতে শুরু করেছে, কিন্তু সূয্যি মামার তখনো দেখা নেই। পুব আকাশের এই লালিমা মনটাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও দ্রবীভূত করে। আমি কয়েকটা ছবি তুলে নিই। এরপর ট্রেনে গিয়ে বসে দিন শুরু করি। পরের দিন আবার একই রুটিন শুরু করার প্রত্যয় ব্যক্ত করি। বিদেশের এই যে কষ্টের জীবন, এর থেকে আসলে কারোরই রেহাই নেয়। আমাদের জন্য ব্যাপারটা আরও বেশি কষ্টের কারণ, আমাদেরকে সাহায্য করতে পারেন, এমন কোনো গুরুজন আমাদের সঙ্গে নেই।

ছবি: সংগৃহীত

বিদেশের জীবন মানেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার জীবন। প্রবাসীদের সম্পর্কে এমন একটা ধারণা দেশের মানুষ সব সময়ই পোষণ করত। জানি না সেই ধারণার আদৌ কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না। কিন্তু আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, বিদেশের জীবন কতখানি কষ্টের, কতখানি সহ্যের আর কতখানি ত্যাগের। প্রবাসীদের এ কষ্ট আসলে বাইরে থেকে কোনোভাবেই টের পাওয়া যাবে না। প্রবাসীরা কখনোই তাঁদের কষ্টের বিষয়গুলো ফেসবুকে পোস্ট করেন না। কারণ, তাহলে দেশে ফেলে আসা আত্মীয়স্বজন তাঁদের জন্য দুশ্চিন্তা করবেন। তাই তাঁরা শুধু আনন্দের বিষয়গুলোই শেয়ার করেন, কিন্তু এই আনন্দের বিষয়গুলোর বাইরে জীবনের যে কঠোর বাস্তবতার তাঁরা প্রতিদিন মুখোমুখি হন, সেটা চেপেই রাখেন আর হয়তোবা আড়ালে চোখের পানি ফেলেন। এরপর হয়তোবা একটা সময় জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আসে, কিন্তু কষ্টের সময়টা ঠিকই তাঁদের মনের গভীরে গেঁথে থাকে। দেশে ফেলে আসা আত্মীয়–পরিজনের ভালোবাসা আর প্রবাসজীবনের এই কষ্টের জীবনের সমন্বয়ে আসলে তাঁরা কী পেলেন, দিন শেষে মনের মধ্যে চলে এসব হিসাব। অবশ্য সেই হিসাবের কোনো কূলকিনারা হওয়ার আগের আরও একটা দিন শুরু করতে হয় যন্ত্রের মতো। এভাবে চলতে চলতে কোনো এক ক্লান্ত প্রহরে মনের কোণে একটা প্রশ্নই শুধু উঁকি দিয়ে যায়। আসলেই কি বিদেশ ভালো?

*মো. ইয়াকুব আলী, মিন্টো, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া