ইউটার জাতীয় উদ্যানের পথে পথে

ডেলিকেট আর্চ। আর্চেস জাতীয় উদ্যান
ছবি: সংগৃহীত

মানুষ প্রকৃতির কাছেই বারবার ফিরে যায়। কৃত্রিমতার আবহে স্বাচ্ছন্দ্য আর আরাম খুজলেও হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে অবসর-বিনোদনে ছুটে যায় প্রকৃতির সান্নিধ্যে। কে জানে, হয়তো খোঁজে ফিরে আদিম অস্তিত্ব, উৎস মূল। প্রকৃতির মাঝেই তো প্রাণের প্রথম স্পন্দন শুরু হয়। তারপর গুহাজীবন ছেড়ে মানুষ উঠে এসেছে আধুনিক এই উৎকীর্ণ সভ্যতায়। সময়ে-অসময়ে, যুদ্ধে-শান্তিতে, গৃহ-শিল্পায়নে ধ্বংস করেছে প্রাণ-প্রকৃতি। তবু কি ছেড়ে থাকতে পেরেছে প্রকৃতি? ফিরে যায় বারবার-আবার। কিছু সময়ের জন্য আমরাও প্রকৃতিতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সঙ্গী সাকুর, রাজেস, নূপুর, মাকসুদ, অভ্র, ইব্রাহিম, তাসনিম। গন্তব্য ইউটার জাইয়ন জাতীয় উদ্যান।

ডাবল আর্চ। আর্চেস জাতীয় উদ্যান
ছবি: মাকসুদুর রহমান

ওয়াইওমিং থেকে সড়কপথে দূরত্ব ৬৭০ মাইল। প্রকৃতিতেই যেহেতু ফিরে যাব, তাই সিদ্ধান্ত হলো কোনো পান্থশালা কিংবা কুঠুরিতে নয়। রাত্রি যাপন হবে খোলা আকাশের নিচে তাঁবু খাটিয়ে, খাবার তালিকায় থাকবে মুরগির পোড়া মাংস। বাক্সপেটরা গুছিয়ে গাড়িতে চেপে শুরু হলো যাত্রা। প্রায় ১০ ঘণ্টার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।

ব্রাইস ক্যানিয়ন
ছবি: সাকুর মাহমুদ

দীর্ঘ ভ্রমণক্লান্তি নিয়ে যখন আমরা ইউটা পৌঁছালাম, তখন রাত বেশ গভীর হয়েছে। গ্রীষ্মের আকাশে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ। চরাচর ভাসিয়ে দিচ্ছে রুপালি আলোয়। কে জানে এমন রূপবতী চাঁদ কত প্রেমিক কপোত-কপোতীর ঘুম কেড়ে নিয়েছে কিংবা কত বিরহীর বিরহের প্রহর দীর্ঘ করেছে! কত বিরহী চাঁদের দিকে চেয়ে জ্যোৎস্নার সঙ্গে তার হৃদয়ের বাষ্পও মিশিয়ে দিয়েছে। চাঁদ কি তার খবর রাখে? হয়তো রাখে না। কিংবা রাখে বলেই নিজের গায়ে সেই কলঙ্কের দাগ বসিয়ে নিয়েছে।

অ্যাঞ্জেলস ল্যান্ডিংয়ের চূড়ায় লেখক
ছবি: সংগৃহীত

গাড়ি থেকে নামতেই গরমের হলকা অনুভূত হলো। অনেকটা বাংলাদেশের আবহাওয়ার মতো। বাতাসে আর্দ্রতা খানিকটা বেশি থাকায় ঘাম হচ্ছিল। পথেই রাতের খাবার সেরে এসেছি। এবার ক্লান্তি দূর করে পরের দিনের জন্য তৈরি হতে তাঁবু খাটিয়ে ঘুমের আয়োজন চলল। একটা উপত্যকায় আমাদের রাতের তাঁবু খাটানো হয়েছে। চারদিকে পাহাড় আমাদের নিরাপত্তা বলয় হয়ে ঘিরে রেখেছে।
ভ্রমণক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছি, ঠিক মনে নেই। ঘুম ভাঙল পাহাড়ের আড়াল থেকে জেগে ওঠা সূর্যের আহ্বানে। চোখ মেলে তাঁবুর বাইরে আসতেই দেখা মিলল একটা কোমল ফুরফুরে সকাল সহাস্যে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যস্ততা আর আলসেমিতে দীর্ঘদিন যার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠেনি। হইহই করে সবাই বেরিয়ে পড়ো তৈরি হতে। ইউটা বেশ উত্তপ্ত জায়গা। তা ছাড়া দাবদাহের সংকেত দিয়ে রাখা হয়েছে। তাই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে হাইকিং করতে চাইলে।

অ্যাঞ্জেলস ল্যান্ডিংয়ের ট্রেইলের সরু অংশ
ছবি: সাকুর মাহমুদ

সকালের খাবার সেরে তৈরি হয়ে যতক্ষণে বেরোলাম, ততক্ষণে সূর্য বেশ ওপরে উঠে এসেছে। বেরোতে গিয়ে বেচারা মাকসুদের মনটাই খারাপ, কোথায় যেন তার রোদচশমাটা হারিয়ে ফেলেছে। ভুভু যান্ত্রিক শব্দ তুলে আমাদের গাড়ি ছুটছে প্রথম গন্তব্য ‘অ্যাঞ্জেলস ল্যান্ডিং ট্রেইল’–এর দিকে।

অ্যাঞ্জেলস ল্যান্ডিংয়ের ট্রেইল
ছবি: সাকুর মাহমুদ

সকালে খাবারের পর পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা পান করার তৃষ্ণাটা পেয়ে বসল। যদিও বাংলাদেশের মতো এখানে মোড়ে মোড়ে খোলা কোনো চায়ের দোকান নেই। অগত্যা কফির দোকান থেকে কফি নিয়ে আবার গাড়িতে ছুটে চলা। পাহাড়ি জনপদ বুক পেতে দিয়েছে আগন্তুকদের। সেই বুকজুড়েই কংক্রিটের রাস্তা। চারদিকে পাহাড়ের সারি দাঁড়িয়ে আছে নির্ঘুম প্রহরায়। নিজেদের যেন জনপদের কোনো প্রতাপশালী জমিদার মনে হতে লাগল।