ইউরোপে জনপ্রিয় ধর্মীয় উৎসব স্যামহেইন ডের ইতিকথা

অক্টোবর মাস এলেই যে শব্দ চারদিকে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়, তা হলো হ্যালোইন। যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকায় প্রতিবছর জাঁকজমকপূর্ণভাবে হ্যালোইন উৎসবের আয়োজন করা হয়। তবে যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স ছাড়া ইউরোপের অন্যান্য দেশে হ্যালোইন এখনো সামগ্রিকভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত তরুণ প্রজন্মের অনেকে নিজেদের উদ্যোগে হ্যালোইন উৎসব উদ্‌যাপন শুরু করেছেন। তবে এ ধরনের উদ্‌যাপন বড় বড় শহরের কিছু নির্দিষ্ট ক্লাব, পানশালা ও পার্টি সেন্টারের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে হ্যালোইন উৎসবের তুলনায় ‘স্যামহেইন ডে’-কে অধিক গুরুত্বের সঙ্গে উদ্‌যাপন করা হয়। স্যামহেইন ডে মূলত একটি ধর্মীয় উৎসব, তবে দিনটিকে ঘিরে সে অর্থে বিশেষ কোনো আয়োজন থাকে না। প্রতিবছর ১ নভেম্বর স্যামহেইন ডে উদ্‌যাপন করা হয়। দিনটিকে ঘিরে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। মূলত, এদিন পরিবারের সদস্যরা তাঁদের মৃত আত্মীয়স্বজনকে স্মরণ করতে স্থানীয় সমাধিক্ষেত্রগুলোয় জড় হন। মৃত স্বজনদের আত্মার প্রশান্তি কামনায় এদিন অনেকে প্রার্থনার উদ্দেশ্যে গির্জা পরিদর্শন করেন।

হ্যালোইন উৎসবের মতো স্যামহেইন ডের ধারণাটিও এসেছে কেল্টিক জাতিসত্তার মানুষের হাত ধরে। কেল্টিকরা মূলত প্যাগানধর্মের অনুসারী ছিলেন। খ্রিষ্টধর্মের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপ থেকে প্যাগানধর্মের বিলুপ্ত ঘটে; যদিও ইউরোপের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এখনো প্যাগানদের ছোঁয়া পাওয়া যায়।

প্রায় দুই হাজার বছর আগে বর্তমান আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের উত্তরাংশে কেল্টিকদের বসবাস ছিল। নভেম্বরের প্রথম দিনটিকে তাঁরা নববর্ষ বা স্যামহেইন উৎসব হিসেবে উদ্‌যাপন করতেন। দিনটিকে গ্রীষ্মের শেষ ও অন্ধকারের বা শীতের শুরু হিসেবে বিবেচনা হতো। কেল্টিকরা মনে করতেন, নতুন বছর শুরুর আগের রাতে পৃথিবী ও মৃত ব্যক্তিদের জগৎ এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয়। তখন মৃত ব্যক্তি ও তাঁদের আত্মা পৃথিবীতে ফিরে আসে। সে সময় ইউরোপের মানুষের জীবনব্যবস্থা ছিল অনেকটা কৃষিনির্ভর। তাই মৃত ব্যক্তির আত্মারা যাতে ফসলের ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্য তাদের সন্তুষ্ট করতে কেল্টিকরা স্যামহেইন উৎসব উদ্‌যাপন করতেন।

মৃত ব্যক্তিদের আত্মার হাত থেকে বাঁচার জন্য বেল্টিক জাতিসত্তার মানুষ বিভিন্ন ধরনের খাদ্য ও ওয়াইন উপঢৌকন হিসেবে দরজার বাইরে রেখে দিতেন। আত্মার খারাপ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য তাঁরা বিভিন্ন রকম মুখোশ, পশুর খুলি ও চামড়া দিয়ে ভুতুড়ে সাজসজ্জায় নিজেদের সজ্জিত করতেন।

খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩ শতকে অধিকাংশ কেল্টিক অঞ্চল রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে। তখন কেল্টিকদের স্যামহেইন উৎসবের সঙ্গে রোমানদের একটি উৎসব যৌথভাবে পালন করা শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য স্যামহেইনদের প্রাধান্য একটু বেশিই ছিল। অক্টোবর মাসে উদ্‌যাপিত হতো কেল্টিকদের স্যামহেইন উৎসব। আর নভেম্বরের প্রথম দিনে উদ্‌যাপিত হতো রোমানদের পামোয়া (Pomona) উৎসব।

অষ্টম শতকে খ্রিষ্টান চার্চগুলো স্যামহেইন উৎসবকে অল সেইন্টস ডে হিসেবে পালন করতে শুরু করে। অল সেইন্টস ডে ‘খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের দিবস’ হিসেবে পরিচিত ছিল। যদিও সেখানে স্যামহেইন উৎসবের বেশ কিছু নিয়মকানুন অনুসরণ করা হতো।

৩১ অক্টোবর। শীতের হালকা হিমেল হাওয়ায় ছেলে-বুড়ো সবাই অধীর অপেক্ষায় আছেন কখন দিনের আলো শেষ হয়, সূর্যমামা কখন তার কাজ শেষে অস্ত যাবে।

একটু অন্ধকার নেমে আসতেই পুরো পৃথিবীতে শুরু হয়ে যায় ভূতের নৃত্য। পৃথিবীতে যত ভূতপ্রেত আছে, সবাই যেন এই রাতেই চলে আসে লোকালয়ে। রংবেরঙের ভুতুড়ে পোশাকে সজ্জিত এসব জ্যান্ত ভূতের ট্রিট দিতে সবাই যেন অস্থির। সাধারণ মানুষের চোখে এ ধরনের একটি দৃশ্যপট হচ্ছে হ্যালোইন উৎসবের প্রতিচ্ছবি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড ও ফ্রান্সের ক্ষেত্রে পুরোপুরিভাবে এ প্রতিচ্ছবি সত্য। তবে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে আমরা যেমনটি দেখি, তা হলো ৩১ অক্টোবর সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা স্থানীয় সমাধিক্ষেত্রগুলোয় একত্র হন।

এরপর তাঁরা রংবেরঙের বিভিন্ন ধরনের বাতি ও আলোকসজ্জার সাহায্যে মৃত আত্মীয়স্বজনের কবরকে সাজিয়ে তোলেন। পাশাপাশি তাঁদের আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। ৩১ অক্টোবর সূর্যাস্তের পর থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী দিন, অর্থাৎ ১ নভেম্বর পর্যন্ত এ আনুষ্ঠানিকতা বজায় থাকে। অবশ্য অর্থোডক্স গির্জায় বিশ্বাসী খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে সেভাবে হ্যালোইন উৎসব কিংবা স্যামহেইন ডে উদ্‌যাপনের রীতি নেই। এ কারণে ১ নভেম্বর স্লোভেনিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, ক্রোয়েশিয়া, পোল্যান্ড, ইতালি, হাঙ্গেরি কিংবা অস্ট্রিয়ার মতো দেশগুলোয় সরকারিভাবে ছুটি থাকলেও উত্তর মেসেডোনিয়া, সার্বিয়া, রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ, গ্রিস কিংবা বুলগেরিয়াতে ১ নভেম্বর একটি সাধারণ কর্মব্যস্ত দিন।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয় আচার পালনে বেশ পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের অনেকে বর্তমানে সেভাবে ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয় না। অনেকের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধর্মীয় বিশ্বাস থাকলেও বাস্তব জীবনে এর খুব একটা প্রতিফলন দেখা যায় না। তা সত্ত্বেও ইউরোপের দেশগুলোয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসবগুলো টিকে আছে ঐতিহ্য ও পারিবারিক মেলবন্ধনের প্রতীক হিসেবে।