ইন্টারন্যাশনাল লেফট-হ্যান্ডারস ডে

বাংলাদেশের মতো একটা দেশে বাঁহাতি হওয়া বিরাট হ্যাপা। অনেক ঝক্কি–ঝামেলার মধ্য দিয়ে বড় হতে হয়। বেনিফিট পেতাম শুধু ক্রিকেট খেলার বেলায়। বাঁহাতি বোলার ও ব্যাটসম্যানের কদর একটু বেশিই থাকে। সেই কদরটা ষোলোআনাই উশুল করতাম। অবশ্য ফুটবলে বাঁ পা দিয়ে শট মারলেও কিছু লোকে হাঁ করে চেয়ে থাকত। পুকুরের এপার-ওপার পাথর ছোড়ায় বন্ধুরা যখন ডান হাতের শক্তি দেখাত, আমি দেখাতাম বাঁ হাতের। শক্তিতে কমবেশি তাদের বরাবরই থাকতাম। যদিও যাদের ত্রিসীমানায় কোনো বাঁহাতি মিলত না, তারা সবাই কেমন করে যেন চেয়ে থাকত। এমন একটা ভাব যেন এলিয়েন দেখছে। এরা আবার নজর করে ডান হাতটাও দেখে নেয় একপলক। ডান হাতের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা ঠিক আছে তো, লুলা টুলা না তো! ডান হাত তো ঠিকই আছে, তাহলে ডান হাত থাকতে বাঁ হাত কেন। অনেকে আবার বাঁহাতিদের নিয়ে টিটকারিও করে—কেউ বলে ‘বাউয়া’, কেউ বলে ‘ড্যাবরা’।

অন্যদিকে স্কুলের স্যারদের কথা আর কী বলব। পরীক্ষার হলে তাঁরা ঘুরেফিরে হাঁটি হাঁটি করে ঠিক আমার পেছনে এসে দাঁড়ান। হলরুমে পায়চারি করতে করতে তাঁদের বিশ্রামের জায়গাটা হয় আমার পেছনটা। যেখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায়—আমি কেমন করে বাঁ হাত দিয়ে গুটি গুটি করে লিখে চলেছি। অনেকে তো অন দ্য স্পটেই আবেগ উগরে দেয়—বাহ! বাহ! বাঁ হাত দিয়ে কী সুন্দর লিখছে। আদতে আমার হাতের লেখা অত ভালো ছিল না, যতটা তারা প্রশংসায় ভাসিয়ে দিতে। আসলে তাদের কাছে বাঁ হাত দিয়ে যেনতেন একটা বাক্য লিখতে পারাটাই ছিল বিরাট ব্যাপার। পরীক্ষার হলে আমার পেছনে স্যারদের দাঁড়িয়ে থাকাটা ছিল খুবই বিব্রতকর। প্রাইভেসি থাকত না। আবার ‘সরেন তো’ বলে সরিয়েও তো দিতে পারতাম না। প্রাইভেসি না থাকার কারণ ছিল একটু ভিন্ন। অনেক সময় প্রশ্ন কমন না পড়লে বানিয়ে-ছানিয়ে ভুলভাল মিশিয়ে লেখা শুরু করতাম। অন দ্য স্পটে সেটা আবার কেউ মনিটর করছে, বানিয়ে–ছানিয়ে লেখার জন্য ব্রেনের যেই আউটপুট দেওয়ার কথা ছিল, ওটা ব্রেন অন দ্য স্পটে ডেলিভারি করতে পারত না। কী থুয়ে কী লিখব, স্যার দেখছে—ব্রেন তখন লজ্জায় হ্যাং হয়ে যেত।

বাঁহাতিদের বেলায় আমজনতার মধ্যে যেটা খুব বেশি আগ্রহ দেখা যায়, সেটা হলো তাদের ধারণা, বাঁহাতিরা অনেকটা পিচট টাইপের। কারণ, এরা খাবার খায় এবং শৌচ করে একই হাত দিয়ে। বিষয়টি আসলেই বিব্রতকর। ছোটবেলা থেকেই বড় হওয়া অবধি বিব্রতকর একটা টপিক ছিল। অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশে মানসম্মান চলে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। হয়তো কোথাও বেড়াতে গেছি। কেউ একজন নোটিশ করল আমি বাঁহাতি। অনেক লোকের মধ্যেই—‘আল্লাহ! তুমি তো বাঁ হাত দিয়ে লেখো। খাও–ও কি বাঁ হাত দিয়ে, আর ওটা?’ প্রশ্নের বাকি অংশটা আর না বলি। যদিও অনেকে প্রশ্নের বেলায় একটু ঘোমটা টানে অনেকে আবার রাখঢাক না রেখেই উগরে দেয়।
যেহেতু জন্ম থেকেই বলতে গেলে বাঁহাতি, তাই ডান হাতের ব্যবহার অনেকটা ডানহাতিদের বাঁ হাতের ব্যবহারের মতো ব্যবহার করতাম। সব কাজেই ডান হাত পিছে পড়ে থাকত। কিছু ধরতে গেলেই বাঁ হাত এগিয়ে আসে। লিখতে গেলে বাঁ হাতে কলম খামচে ধরি। খাইতে গেলে বাঁ হাত খাবারে গুঁজে দিই। চায়ের কাপের হ্যান্ডেল ধরি বাঁ হাত দিয়ে। বল ছুড়তে গেলে বাঁ হাত দিয়ে ছুড়ে দিই। আতকা কিছু ছুটে এলে বাঁ হাত পেতে দিই। আতকা লাথিটাও মারি বাঁ পা দিয়ে। হেটার্সদের পশ্চাৎ দেশে না, ফুটবলে লাথি মারার কথা বলছি।

সব সময় মায়ের হাতে খাইতাম বলে খাবারের কাজে বাঁ হাত ব্যবহার করার সুযোগ তখনো হয়ে ওঠেনি। তখনো ফুল ফর্ম শতভাগ বাঁহাতি। অন্যদিকে আমজনতার মতোই সহজাত ছিল বাঁ হাতের শৌচকার্য। যদিও বাঁ হাত দিয়ে দু–একবার ভাত মুখে তুললেও আব্বার বকাঝকায় ডান হাত দিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করেছিলাম। করতে করতে একদিন অভ্যস্তও হয়ে গিয়েছিলাম। এখন ডানহাতিদের মতোই ডান হাত দিয়ে ভাত মেখে খেতে কোনো ডিস্টার্ব হয় না। মুরব্বি গোছের কেউ হাতে কিছু ধরিয়ে দিলে এখন ডান হাতটাই পেতে দিই, যদিও ছোটবেলায় বাঁ হাতই পেতে দিতাম। আব্বার শাসনে এটাও লাইনে আসছিল।

যদিও চামচের ব্যবহার এখনো ডান হাত দিয়ে করতে পারি না। অনেক চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছি। চামচ দিয়ে খাবার তুলে সেটা মুখ পর্যন্ত বয়ে নিয়ে গলাধঃকরণ কিন্তু এত সোজা না। এটা একটা জটিল প্রক্রিয়া। ইঞ্জিনিয়ারিং টাইপের ব্যাপারস্যাপার। যারা কোনো দিন চামচ ব্যবহার করেনি, তারা ভালো বলতে পারবে। আপনি নিজেও বাঁ হাত দিয়ে প্র্যাকটিস করে দেখতে পারেন। ব্যাপারটা এত সোজা হয় না। যেমন অনেকটা কলম ধরার টেকনিক দিয়ে চাকু ধরা যায় না। চামচ দিয়ে খাদ্যদ্রব্য মুখ পর্যন্ত টেনে নিয়ে আসার টেকনিকটা ডান হাত দিয়ে আজও রপ্ত করতে পারিনি। চামচ এমনভাবে ধরি যেন চাকু ধরেছি। যাহোক, চামচের বেলায় বাঁ হাত দিয়ে খেতে গিয়েও বেকায়দায় পড়েছিলাম। জার্মানিতে একবার ইফতারের সময় মসজিদে খেতে গিয়ে বাঁ হাত দিয়ে চামচ ধরে যেই না মুখে খাবার গুঁজেছি, সামনের এক আফ্রিকান হুজুর গেল খেপে।

যেন কাঁটাচামচ দিয়ে তার কলিজা ফালাফালা করে দিছি আর লোকটা বুক চিনচিন করছে হায় বলে উঠছে। দাঁত–মুখ খিচিয়ে—এভাবে শয়তান খায়। অগত্যা ডান হাত দিয়ে চাকু ধরার মতো করে কয়েকবার মুখে ঢোকানোর চেষ্টা করলাম দেখি যে ঝোল দিয়ে জামাকাপড় মাখিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। শেষে মানে মানে সরে পড়লাম।
বিয়ের বেশ কয়েক দিন পেরিয়ে গেছে। একদিন বউকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি যে লেফট–হ্যান্ডেড, তুমি কি সেটা জানো?’ সে চমকে গিয়ে বলল, ‘না তো, জানতাম না।’ জানবে কী করে, তার সামনে আমি শুধু মুঠোফোন আর ল্যাপটপের কি–বোর্ডই টিপেছি, কি–বোর্ড টিপি তো দুই হাতে তালে-তালে। খাতা–কলম নিয়ে তো আর পড়তে বসা হয়নি। যাহোক, অবাকই হলাম। মনে হলো বিষয়টি জানা থাকা দরকার ছিল।

বিশেষ একটা পারসোনালিটিসম্পন্ন মানুষ বলে কথা। সারা বিশ্বে ঘটা করে এদের আলাদা করা হয়। সেই আলাদা কাতারের মানুষ আমরা। এত লেকচার দিলাম তা–ও বউ বাঁহাতি বিষয়ে তেমন একটা গুরুত্ব দিল বলে মনে হলো না। গুরুত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করলাম। ‘তোমার কি মনে হয় না, লেফট–হ্যান্ডেড হওয়াটা একটা বিরাট ব্যাপার, তা–ও যদি জন্ম থেকেই হয়।’ তা–ও সে এটা–সেটা নিয়ে গল্প বলায় ব্যস্ত। খুব একটা আগ্রহ দেখাল বলে মনে হলো না। গুরুত্ব বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে গেলাম, ‘তোমার বর যে একজন স্পেশাল পারসন, তোমার বরকে নিয়ে একটা দিবস আছে তুমি কি সেটা জানো?—না তো? কী দিবস? বাউয়া দিবস?’ ‘আরে ধুর কী সব বাউয়া কাউয়া বলো!’
* লেখক: মাহবুব মানিক, হালে, জার্মানি