ইয়েলোস্টোনের পথে পথে-২

ছবি: লেখক

সকালের নাশতা করে সবাই বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়ঘেরা উটাহ থেকে ইয়েলোস্টোনের পথে। আমরা রাতটা কাটাব আরেকটি ন্যাশনাল পার্কের ছোট্ট একটি পর্যটন শহর জ্যাকসনে। উটাহ থেকে পাঁচ ঘণ্টার পথ শেষে যাত্রাবিরতি পড়বে সেখানে। ততক্ষণ প্রকৃতি দেখি।

ছেলে গাড়ি চালাবে ঠিক হলো। আমরা তাকে নসিহত করে বেড়াচ্ছি। মাঝেমধ্যে মেয়ের প্রতি তীর্যক বাক্যবাণও থেমে থাকছে না। আমরা এমনই, একজন আরেকজনের পেছনে লেগে থাকি। আর একজন আরেকজনের ভুল ধরতে পছন্দ করি। বেশির ভাগ সময়ই দুষ্টুমির ছলে।

রাস্তার দুই পাশে, সামনে পাহাড় আর পাহাড়; তবে এগুলো কিছুটা সবুজ! উপত্যকায় গবাদিপশু, ঘোড়া, ফসলের খেত আর সল্ট লেকের কিছুটাও চোখে পড়ে। ঘণ্টা দুই পরই নতুন স্টেট আইডাহোতে! সেখানে লাঞ্চ পিক করে আবার চলছি তো চলছিই, রাস্তার ল্যান্ডস্কেপ খুব পছন্দ আমার। এখানে পরিবেশ অনুযায়ী ল্যান্ডস্কেপ বদলায়। এতক্ষণ রাস্তার পাশে কোনো গাছপালা দেখা যায়নি। যেতে যেতে রাস্তার পাশে ক্রিক, ছোট ছোট পানির ধারা বয়ে যেতে দেখি। তারপর শুরু হয় পাইন কোণের পাহাড়, সাড়ে ছয় হাজার ফুট উঁচুতে গিয়ে বোঝা গেল, আমরা আরেকটি ন্যাশনাল ফরেস্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। পাহাড় থেকে নামতেই সুন্দর সুন্দর উপত্যকা আর তাতে আলো–আঁধারির খেলা। আমেরিকার যে জিনিস পছন্দ আমার, কেউ কাউকে অহেতুক বিরক্ত করে না। জানি না তাদের আমাদের লোকজনের মতো ঔৎসুক্য কম, না নিজেরা নিজেদের মতো থাকাটাই বেশি পছন্দ করে! তবে দরকারে লাগলে এরা সাহায্য করতে পিছপা হয় না। প্রতিদানের আশাও করে না। শিক্ষাটাই তেমন, যা আমরা মুসলিম হয়েও শিখিনি। পরের ব্যাপারে নাক গলানো আর নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ আমাদের মতো কেউ আর করে কি না, জানা নেই। ইভেন এক ইন্ডিয়ান তার ফেলো ইন্ডিয়ানের জন্য সামর্থ্যমতো সাহায্য করে। দেশপ্রেম আর স্বজাতিপ্রেম আমি ইন্ডিয়ানদের মতো কমই দেখি। আমার দেশের লোকদের সুমতি হোক, সে কামনায়ই এ মন্তব্য।

আইডাহো পার হয়ে, ওয়াওমিংয়ের পাহাড়, উপত্যকা পেরিয়ে ছোট জ্যাকসন শহরে যখন পৌঁছালাম, তখন বিকেল পেরিয়ে গেছে। হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বাচ্চারা ঠিক করল, ওরা হোটেলে থেকে যাবে। হয়তো ইচ্ছা হলে হোটেলের পাশে কাছের ছোট জ্যাকসন ট্যুরিস্ট শহরটা ঘুরে দেখবে আর প্রয়োজন হলে কাছের খাবারের দোকান থেকে সবার জন্য খাবার তুলে নেবে। আমরা দুজন ওয়াইওমিংয়ের টেটন ন্যাশনাল পার্কে ততক্ষণ ঢুঁ মেরে আসব।

রাস্তার পাশে পাহাড়ের সারি আর তার মাঝের উপত্যকা আমরা দেখতে দেখতে কখন দুই ঘণ্টা পার করে দিয়েছি, বুঝতেও পারিনি।

মেয়ে জানাল, খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। জানালাম, আমরা ফেরার পথে তুলে নেব। দেরি হবে বলে হোটেলে ফিরে মেয়ে আর আমি হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে খাবার নিয়ে এলাম। বিশ্বস্ত থাই খাবার! এক্সট্রা স্পাইসি ছেলের জন্য।

খাওয়ার পর মনে হলো সামনের পার্কে হেঁটে আসি। বাচ্চারা বিকেলে সেখানে হেঁটে এসেছে, সুযোগমতো আইসক্রিমও খেয়ে এসেছে। হাঁটতে হাঁটতে সুভ্যেনুর দোকানের পাশে আইসক্রিমের দোকান থেকে আমিও আইসক্রিম নিয়ে খেতে খেতে হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে ফিরেছি।

এবার ঘুম।

কাল সকালে আবার যেতে হবে। গন্তব্য মন্টানার ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক! যদিও পার্কের বেশির ভাগই পড়েছে ওয়াইওমিংয়ের মধ্যে। দূরত্ব বেশি নয়, তবে ড্রাইভ যেহেতু পার্কের মধ্যে দিয়ে আর এর আগে টেটন ন্যাশনাল পার্কটাও ঘুরে দেখব, সময় লাগবে। মিনিমাম পাঁচ ঘণ্টা আর যেহেতু রাস্তার বাঁকে বাঁকে থামব, আরও বেশি।
ভাগ্যিস সবাই ড্রাইভ করে আর এ যাত্রায় বাচ্চারাই ড্রাইভ করতে আগ্রহী। প্রথমবারের মতো আমরা পেছনের সিটের যাত্রী।

টেটনের প্রধান আকর্ষণ ক্যাথেড্রাল মাউন্টেন, দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ের সারি।

সিনিক রোড ড্রাইভ। লোকজনের বাইক চালানো দেখে মন হলো, বাইক রেন্ট করি। পরক্ষণেই মনে হলো, আমি সাইকেল চালাতে পারি না। বাকিরা সবাই প্রো। আমাকে এরা কোনো কিছুতেই গণনায় নেয় না। তাই সে চিন্তা বাদ!

এখানে আরও আছে লেক জেনি, লেক জ্যাকসন; ইচ্ছে হলেই বোটরাইড নেওয়া যায়। ইচ্ছা হলেই সপ্তাহখানেক এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে দেখেই কাটানো যায়।
আমরা এখানকার সিনিক রাউট ধরে ইয়েলোস্টোনের দিকে রওনা হলাম।

দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চলছি আমরা, মাইলের পর মাইল জনবসতি নেই। মাঝে কিছু কিছু বার্ন চোখে পড়ে। গরু, ঘোড়া ঘাস খেয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের থামতেই হলো এক জায়গায়, গরুদের সঙ্গে কথা বলতে! সিরিয়াসলি!

ছবি: লেখক

আমরা গরুর জন্য থামলাম। আমরা তাদের দেখব কী, তারাই অবাক হয়ে আমাদের দেখে! সেখান থেকে আরও এক ন্যাশনাল পার্কের ভেতর দিয়ে চলে এসেছি! পাহাড় বেয়ে ছয় হাজার ফুটের ওপর থেকে যখন নিচের উপত্যকা দেখি, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। থামতেও হয় সে সৌন্দর্য উপভোগ করতে। যেতে যেতে ইয়েলোস্টোন নদীর পাড় আর পাহাড়ের ওপর দিয়ে ইয়েলোস্টোনে প্রবেশ করি, এদিকটা ওয়াইওমিংয়ের মধ্যে।
আরও ঘণ্টা দুই পরে প্রথম স্টপ। ওল্ড ফেইথফুল গাইজার! বাচ্চারা বলছে গিজার! কারও মুখে এখানে মাস্ক নেই। আশা করি সবাই এখানে ভ্যাকসিনেটেড!
লোকজনের পিছু পিছু আমরা পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত স্পটে। পুরো পার্কে ওল্ড ফেইথফুলের চারপাশে কাঠের তক্তার হাঁটার পথ, যাতে কেউ আগ্নেয়গিরির ওপরের মাটিতে পা না দেয়। বেঞ্চ পাতা সারি সারি বৃত্তাকারে।

ছবি: লেখক

ভাগ্যগুণে একদম প্রথম সারির সিট পেয়ে গেলাম, একদম মেইন গাইজারের সামনে। বাচ্চারা ক্ষুধার্ত আর ভাগ্যিস এখানে খাবারের দোকান আছে। ওরা দেখি ভ্যানিশ হয়ে গেল! যখন ফিরল, হাতে পারসোনাল পিৎজার প্যাকেট। নাহ্‌, আমার কথা ভুলেনি বলে মনে মনে শান্তি পেলাম। লাঞ্চ করলাম মেয়ের সঙ্গে ওল্ড ফেইথফুলের সামনে বসে। অনুভূতিই ভিন্ন! এখানে ফরেস্টের মধ্যে ইন্টারনেট ড্রপ করে, মানে আমরা বেশির ভাগ সময়ই পৃথিবীর সবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকব পুরো সপ্তাহ।

ওল্ড ফেইথফুল প্রতি ঘণ্টায় একবার করে গরম পানির ধারা ছুড়ে দেয় আকাশে। আমরা যখন পৌঁছালাম, তখন আধা ঘণ্টা বাকি নেক্সট শোর। খাবার শেষ করতে করতেই দেখি আশপাশে আর তিলধারণের জায়গা নেই। আর গাইজারও পানি ছোড়া শুরু করেছে! মিনিটখানেকের এই গাইজারের মহাশূন্যে পানি ছুড়ে দেওয়া দেখে বিস্ময়ে হতবাক হতেই হয়।

দৃষ্টিনন্দন পানির প্রস্রবণ দেখে আবার রাস্তায়। ছোট ছোট হাজারো কোনা থেকে ধোঁয়া আর পানির খেলা দেখতে দেখতে দেখি, কয়েক জায়গায় অনেক লোকের জটলা। আজ আর থামব না। গন্তব্য ইয়েলোস্টোনের শেষ প্রান্তের গেট—মন্টানা। সেখানেই আমাদের নেক্সট হোটেল। আর যাত্রা?

ছবি: সংগৃহীত

অসাধারণ!

পাইন কোণের বাঁকে বাঁকে আমার মন হারিয়ে যায়! সঙ্গে পাহাড়, নদী; মার্শল্যান্ডের কথা না হয় না–ই বললাম!

আরও ঘণ্টা দুই এই সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম মন্টানার ছবির মতো সুন্দর ছোট ট্যুরিস্ট টাউন ম্যাডিসনে। একদম ইয়েলোস্টোনের এদিকের এন্ট্রান্স ছুঁয়ে আমাদের হোটেল।

চেকইন করে বাবা–মেয়ে গেল শহর রেকি করতে। আমরা মা–ছেলে বিশ্রামে। ঘুম ভাঙল ডিনারে কী খাব, তা জানাতে! ট্যুরিস্ট টাউন, খাবারের কমতি নেই। অর্ডার দিয়ে পাশ ফিরতেই দেখি তারা খাবার নিয়ে চলে এসেছে। যার যে খাবার মনে হয়েছে, অর্ডার করেছে। ভাগ্যিস ভেতো বাঙালিদের জন্য চায়নিজ, থাই এখানেও আছে। আমেরিকান খাবারও। খেয়েদেয়ে আমরা ঠিক করেছি, গাড়ি নিয়ে কাছাকাছি ঘুরতে যাব। আর কোথায়? ইয়েলোস্টোনে!

লেখক
ছবি: সংগৃহীত

কিছুক্ষণ যাওয়ার পর থামলাম, ম্যাডিসন নদীর পাড়ে। সেদিন সন্ধ্যার আকাশে যে কী ছিল, সে জায়গাতে আমাদের প্রতি সন্ধ্যায় যেতেই হতো। নদীর পাড়ে বসার জায়গা, হাঁটার কাঠের রাস্তা, অগভীর স্বচ্ছ নদীর পানি, ইচ্ছা হলেই পা ডুবিয়ে রাখা যায়! জংলি গোলাপ, ল্যাভেন্ডারের গোছা। হারিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমার মতো নেচারপ্রিয় মানুষের এর বেশি আর কিছুই লাগে না। অবশ্যই সঙ্গে কিছু প্রিয় মানুষ। তবে যদি ভালুকও আক্রমণ করে, বাঁচানোর জন্যও তো কাউকে লাগে। ছেলে আমাকে লেসন দিয়েছে, মা, ভালুক অ্যাটাক করলে মারা যাওয়ার ভান করতে হবে! আমি যে আসলেই মরে যেতে পারি আতঙ্কে, সেটা তার না জানাই থাক।

ছবি: সংগৃহীত

সন্ধ্যার আলো থাকতেই বললাম, চলো আরও কিছুক্ষণ ড্রাইভ করি, যদি পশুপাখির দেখা পাই।

বলতে না বলতেই নেক্সট বাঁকের খোলা চত্বরে দেখি হরিণের পাল।

তাদের দেখেই মন ভরে গেল সে সন্ধ্যায়। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে, দেখি রাত ১০টা বাজে।

ঘরে, মানে হোটেলে ফিরতে হবে!

কাল সারা দিন আছে ইয়েলোস্টোন ঘুরে দেখার। আজকের মতো বিরতি এখানেই। চলবে...

*লেখক: শারমীন বানু আনাম, চিকিৎসক

আরও পড়ুন