ইয়েলোস্টোনের পথে পথে-৩

ছবি: লেখক
এমন দৃশ্য ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়
ছবি: লেখক

সকাল সকাল নাশতা করেই বলে চলো ঘুরে আসি। বাচ্চারা এখনো টায়ার্ড। তারা থেকে যাবে হোটেলে, ঘুমাচ্ছে এখনো। আমরা ফিরলে যাবে আমাদের সঙ্গে যদি চায়।
ইয়েলোস্টোনের মেইন গেটের পাশেই হোটেল। ঘণ্টাখানেক ড্রাইভ করে প্রথমেই থামলাম এক জলাভূমিতে! পাহাড়ের কোলে নদী বয়ে যাচ্ছে, তার পাশে লম্বা ঘাসের মিলনমেলা। অনেকেই সেখানে মাছ ধরছে, একটু ওপরের দিকে সবাই সাঁতার কাটে। নদীর মাঝখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বড়শি হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে কোমরপানিতে। ফ্লাই ফিশিং বলে। আমেরিকায় ইচ্ছা হলেই বড়শি নিয়ে নদীতে মাছ ধরা যায় না! মাছ ধরার জন্য লাইসেন্স করাতে হয়। আমি এদের ধৈর্যের তারিফ করি।

ছবি: লেখক

এরপর থামলাম পাইনের জঙ্গল চিরে যাওয়া পাহাড়ি ঝরনা দেখতে। কয়েক ঘণ্টা তাতেই চলে গেল। এর পরে যেখানে যাব, তাকে বলে নরিস বেসিন। কয়েকবার রাস্তার পাশে ইচ্ছেমতো থেমে থেমে যেখানে থামলাম, সেটা মেইন রাস্তায়, কারণ পার্কিং লট পূর্ণ। সবার পিছু পিছু আরও আধা ঘণ্টার হাইকে গিয়ে পৌঁছালাম নরিস বেসিনে।

ইয়েলোস্টোন পার্ক আসলে বিশ্বের বড় বড় আগ্নেয়গিরির একটি। পাহাড় আর পাহাড়! অনেক জায়গাতেই ফুটন্ত পানির প্রস্রবণ। সব শেষ আগ্নেয়পাত হয়েছে ৬ লাখ ৪০ হাজার বছর আগে।

এই গরম বেসিনে, ফুটন্ত পানিতে পড়ে, প্রতিবছরই পুড়ে মারা যায় অনেকে। তাই অতি উৎসাহী হলেও নিজেদের নিবৃত্ত রাখা উচিত হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে। আর প্রতিটি পাবলিক প্লেসেই কারও এই আগ্নেয়গিরির গরম মাটির ওপর হাঁটা নিষেধ। মাটির ফুট দুই ওপরে কাঠের পাটাতন বিছিয়ে দেওয়া হাঁটার জন্য। কোথাও কোথাও রেলিং দেওয়া। ফুটন্ত পানি আর সালফিউরিক অ্যাসিড থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখা নিজেদেরই কর্তব্য।

ছবি: লেখক

এই নরিস বেসিনে ১ দশমিক ৫ মাইল হাইকে প্রচুর ছোট–বড় উষ্ণ প্রস্রবণ। পুরোটাই মোটামুটি কাঠের পাটাতন দিয়ে ঘেরা ট্যুরিস্টদের জন্য। কোনো প্রাণী চোখে পড়েনি আমাদের, মানুষ ছাড়া। প্রতিটি প্রস্রবণের ভিন্ন ভিন্ন নাম। অনেকগুলো একটানা গরম পানি ছুড়ে যাচ্ছে আকাশে, কোনোটা শুধুই দৃষ্টিনন্দন ছোট ছোট পানির পুকুর সেখানে সালফারের ধোঁয়া উঠছে। কোথাও কোথাও কিছু শেওলার মতো জমে আছে। এই গরম মাটিতেও কিছু কিছু লতাপাতা, ঘাস আর ফুলের বাহার দেখে মনে হলো প্রকৃতি কত সর্বংসহা আর রেজিলিয়েন্ট।

কোনো কোনো প্রস্রবণ কিছুক্ষণ গরম পানি ছুড়ে একদম মিলিয়ে যায়, কোনো নিশানা না রেখেই যে কিছুক্ষণ আগেই এর বুকে বিশাল প্রস্রবণ ছিল। কোনো কোনটার পেট চিরে শুধু ধোঁয়া বের হয়ে যাচ্ছে। কোনোটার পাশ দিয়ে গেলে মনে হয়, তার ভেতরে যুদ্ধ চলছে, বিস্ফোরণের অপেক্ষায় আছে। যে কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটবে।
কোনো কোনো ছোট ছোট পুকুরের মধ্যে শুধুই বুদ্‌বুদ, কোনো কোনটা শীতল ভয়ংকর সুন্দর চোখ দিয়ে যেন আপনাকেই দেখছে!

সালফারের গন্ধ কোথাও বেশি, কোথাও কম। পাহাড়ঘেরা চারপাশ। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে গেল আমাদের এই দেড় মাইল হাইক শেষ করতে। সৌন্দর্য উপভোগের।
গরমে পানি না নিয়ে গেলে ভীষণ কষ্টে পড়বেন। আর হাইকটাও কষ্টকর। মনে মনে ভাবছি, ভালোই হয়েছে বাচ্চাদের সঙ্গে না এনে—এক্সজস্টেড হয়ে যেত।

লেখক
ছবি: সংগৃহীত

হাইক শেষ করেও আমরা আরও কিছুক্ষণ পাহাড়ের ওপরে বসে এই বিস্তীর্ণ নরিস বেসিনের সৌন্দর্য আকণ্ঠ গিলছি। রোদের তাপে ঝলসেও যাচ্ছি।

আবার আধা ঘণ্টা হাইক করে গাড়িতে ফিরে, লাঞ্চ করে নিয়ে নেক্সট স্টপ ম্যামথ হট স্প্রি টেরেসে। যাত্রা এবার পাহাড়ি ঢাল বেয়ে ভীষণ সুন্দর রাস্তা ধরে। রাস্তার পাশে পাশে হট স্প্রিং। নামলেই সালফারের ধোঁয়া বোঝা যায়।

পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী আর পাহাড়ের বুক চিরে পাথর কেটে রাস্তা। সবার মতো আমরাও প্রতিটি স্টপিং কর্নারে থেমে যাই। ফোনের চার্জ শেষ। ভাগ্যিস গাড়িগুলো ইদানীং সুপার স্মার্ট। কর্ডলেস চার্জ করার ব্যবস্থাও আছে, তবে তা ভীষণ ধীরগতির।আরও এক দৃষ্টিনন্দন ঝরনার পাশে কতক্ষণ তার সৌন্দর্য দেখে গিয়ে যে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়ালাম, সেখানে দেখি এক বয়স্ক দম্পতি ছবি তুলছেন। আমাদের জানালেন নিচের পাহাড়গুলোর ওপরে অনেক এল্ক ঘাস খাচ্ছে! ক্যামেরার জুমে খুঁজে পেলাম তাদের। এ দম্পতি আগামী এক বছর গাড়িতে কাটিয়ে পুরো আমেরিকার ন্যাশনাল পার্কগুলো দেখে বেড়াবেন। আমার ক্যামেরা নইভনেস দেখে নিজেরাই অনেক তথ্য দিলেন। কীভাবে কীভাবে যেন আমাদের ট্রাভেলগুলোয় খুব ভালো কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায়। অযাচিত সাহায্য পাই আমরা তাদের কাছ থেকে। বন্ধুত্বও হয়ে যায়। নিজে থেকেই আমার ক্যামেরা সেট করে দিলেন তাঁরা। তাঁদের এই বছরখানেকের আমেরিকা চষে বেড়ানোর অসাধারণ উদ্যোগের জন্য সাধুবাদ দিয়ে আমরা গাড়ি ছোটালাম ম্যামথের পথে। পাহাড়ের বুক চিরে।

ছবি: লেখক

ফোনের চার্জ ছাড়া অসহায় আমি। দেখি মাত্র ২০ শতাংশ চার্জ হয়েছে এতক্ষণে। বেগারস কেন্ট বি চুজার্স! তাই সই। ক্যামেরাই সম্বল।

ম্যামথ টেরেস যেন পাহাড়ের বুকে উষ্ণ প্রস্রবণের অসাধারণ ভাস্কর্য।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। আপাতত এই হাইকে কিছু পুরোনো, ইনঅ্যাকটিভ, আর দুটো নতুন, একটি স্থাপনার দেখা পাওয়া যাবে! হাইক? মাত্র সাড়ে ছয় হাজার ফুট উচ্চতায়। আশপাশের পাহাড়গুলো সাড়ে আট হাজার ফুট উচ্চতায়। ভ্যালিতে ম্যামথ টাউন। বাচ্চারা নেই, কে আটকায় আমাদের?

আমরা পার্ক করেছি একদম নিচে। লাইমস্টোন গরম পানিতে গলে গিয়ে যে বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করছে, তার বর্ণনা কীভাবে দিই?

চেষ্টা করি, যেন রংবেরঙের মার্বেলের উঁচু সিঁড়ি, ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতার, রঙের! তার ওপর দিয়ে কোথাও ধোঁয়া ওঠা পানির ফোয়ারা, কোথাও স্বচ্ছ পানির ধারা বয়ে চলেছে। ম্যাজিক্যাল! এই টেরেসগুলোরও ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে। মেইন টেরেস, মিনার্ভা, ক্লিওপেট্রা, ওভারলুক, হাইমেন টেরেস, ক্যানারি স্প্রিং ইত্যাদি।

বিসমিল্লাহ বলে শুরু করলাম হাইকিং, কাঠের পাটাতন আর সিঁড়ির পর সিঁড়ি ভেঙে প্রথমেই যার সামনে দাঁড়ালাম, সেটা মিনার্ভা—যাত্রার শুরুতেই ক্লান্তি ভুলে গেলাম! অপরিসীম মুগ্ধতায় আমার চোখ আটকে গেছে। চোখ আর নিজেকে সরানো সেখান থেকে কষ্টকর হয়ে যায়। তারপরও যেতে হবে ওপরে! ভাগ্যিস পানির বোতল ছিল। এ যাত্রা আমায় নেপালি পাহাড়ের ওপরের মন্দির যাত্রার কথা মনে করিয়ে দেয়। সিঁড়ির পর সিঁড়ি বেয়ে আমরা ওপরে উঠতে থাকি। ছোট–বড় সুইমিং পুলের মতো অনেক বেসিন পেরিয়ে ওভারলুকে ফাইনালি পৌঁছে গেলাম। তবে মজার কথা হচ্ছে, এসব স্থাপনার একেকটি অংশ আপনি একেকটি জায়গা থেকে দেখতে পাবেন, পুরোটা কোনোভাবেই নয়। তাই সবার পিছু পিছু হাটতেই থাকলাম। ভাগ্যিস, গিয়েছিলাম শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। নয়তো নয়নাভিরাম শেষ প্রান্তের ক্যানারি স্প্রিং মিস করতাম। এটিও আরেকটি দৃষ্টিনন্দন রঙিন লাইমস্টোনের সিঁড়ির সারি, তবে আরও জীবন্ত! পানির ধারা এর ওপর আরও বেশি বয়ে চলেছে।

ছবি: লেখক

আমি ইমাজিন, মানে ভাবার চেষ্টা করলাম, বৃষ্টিতে এর সৌন্দর্য কেমন হয়? অবশ্য আমাদের ভাগ্য ভালো যে বৃষ্টি হয়নি, তাতে হয়তো আমাদের যাত্রার কাটছাঁট করতে হতো। সেই প্রান্ত থেকেও আমাকে সরায় সাধ্য কার! তারপর যখন মনে পড়ল আমাদের নিচে নামতে হবে, পুরোটা পথ আবার পাড়ি দিত হবে, নিজেকে প্রবোধ দিলাম এই বলে যে যা করতে হবে, করাই উচিত। নিচের দিকে পুরো রাস্তা ঘুরে আবার নামতে শুরু করলাম। এটিও দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার হাইক। মনে মনে স্বামীকে ধন্যবাদ দিয়ে ফেলেছি—এই সুবিশাল যাত্রায় আমার সঙ্গে থাকার জন্য। নিজ উদ্যোগে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ফেরার পথে চোখে পড়ল হরিণের রাস্তা পার হতে দেখে। আমরা আবার আটকে গেলাম সেই পাহাড়ের চূড়ায়, যেখানে আমাদের সঙ্গে সেই পরোপকারী দম্পতির দেখা হয়েছিল। এবার যদিও কারণ ভিন্ন!

বাইসন মনের আনন্দে যেন সেজেগুজে দুলতে দুলতে সান্ধ্যভ্রমণে বেড়িয়েছে। মাইলখানেকজুড়ে রাস্তায় জ্যাম লেগে গেল। সব গাড়ি ধৈর্য ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এই বাইসন রাস্তা ছেড়ে নিজের খেয়ালমতো যখন নামবে, তখনই শুধু আমরা রাস্তায় চলতে পারব।

ছবি: লেখক

সে সুদর্শন বাইসন তার সান্ধ্যকালীন ভ্রমণ কাটছাঁট করতে বিন্দুমাত্র রাজি নয়। ৩০ থেকে ৪০ মিনিট পরে রাস্তায় হেলতে–দুলতে ঠিক যেন রংবাজের মতো রংবাজি করে নেমে গেল রাস্তা পাশের পানির ধারায়। আমরাও চলা শুরু করলাম। কী যে ভীষণ ইচ্ছা হচ্ছিল গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি এই সুদর্শন বাইসনের রূপ দেখি!
এবার হোটেলে ফেরা। বাচ্চাদের লাঞ্চ রেখেই গিয়েছিলাম। তারা হোটেলেই লাঞ্চ করেছে। আমরাও এবার গাড়িতেই আবার লেট লাঞ্চ করে নিলাম। হোটেলে পৌঁছতে পৌঁছতে ডিনার টাইম হয়ে যাবে।

হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে, চাইনিজে ডিনার করে আবারও ইয়েলোস্টোন; মেডিসন নদীর পাড়। ছেলেরা সন্ধ্যায় ফিরে যেতে চায় বলে, মেয়ে আমার সঙ্গে নেচার দেখবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ছেলেগুলোকে আমরা হোটেলে নামিয়ে দিয়ে আবারও ঢুকে পড়ি আগ্নেয়গিরির জঙ্গলে।

ভাগ্যিস হোটেল কাছে ছিল! ঘণ্টাখানেক ড্রাইভ করে আমরা কাঙ্ক্ষিত হরিণের হার্ডের দেখা পাই। এবার বিশাল বহর নিয়ে তারা সান্ধ্যভ্রমণে এসেছে। আমি আর মেয়ে তাদের মনভরে দেখে রাতের রাস্তায় ঘরে ফিরি। আমি কিন্তু ড্রাইভ করিনি!

কাল ভ্রমণে নতুন কিছু হবে। রেস্ট দরকার। তারপরও গাড়ি রেখে আমরা মা–মেয়ে দুজনে মেডিসন শহরে ঘুরে বেড়াই আরও কিছুক্ষণ।

*লেখক: শারমীন বানু আনাম, চিকিৎসক

আরও পড়ুন