উচ্চাভিলাষিণীর ভালোবাসা-৪

প্রতীকী ছবি
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘আমার দেশে যাওয়া দরকার, কী করা যায় বলো তো?’ জুলিয়ানা কায়সারকে বললেন। ‘গেলে এখানকার প্রপার্টির কী হবে, কে দেখভাল করবে?’ কায়সারের সঙ্গে তাঁর অনেক দিনের পরিচয়। তিন বছর হয়ে গেল জুলিয়ানা নিজের দেশে যান না, এমন সময় বৃদ্ধ মায়ের পাশে থাকা দরকার। কায়সার অভয় দেন, ‘কোনো চিন্তা কোরো না, আমার ওপর ভরসা করলে আমি দেখতে পারব।’

কায়সারকে ভরসা না করার কোনো কারণ নেই। শুধু জুলিয়ানা নন, যাঁরা কায়সারকে চেনেন, তাঁরা সবাই করেন। জুলিয়ানা আশ্বস্ত হন, ‘তাহলে দেশ থেকে কিছুদিনের জন্য ঘুরে আসি।’

জুলিয়ানার দেশ দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণ করে না, তাই তাঁকে নিজ দেশের পাসপোর্ট সারেন্ডার করতে হয়েছে। এখন তিনি পুরো কানাডিয়ান। জুলিয়ানা ভিসার জন্য আবেদন করলেন। কায়সারকে বললেন, ‘আজ একটু হালকা লাগছে, দেশের ভিসার জন্য আবেদন করলাম। যদি তোমার কাজ না থাকে, চলো কোথাও থেকে ঘুরে আসি?’
যদিও জুলিয়ানা তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা দেশের এখন আর নাগরিক নন, তবুও তিনি দেশ বলতে ওটাকেই বোঝাতে চান। যেমনটি হয়, সারা জীবন ঢাকা শহরে  থাকলেও দেশ বলতে আমরা গ্রামকেই বুঝে থাকি; যেখানকার আলো-বাতাস আমাদের শৈশবের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গিয়েছিল।

ছবি: লেখক
আরও পড়ুন

কায়সারেরও একঘেয়েমি থেকে বেড়িয়ে এলে মন্দ হয় না। কায়সার বললেন, ‘চলো! কাছে, কিন্তু নির্জন কোথাও যাই, ক্যাম্পিং আর বনফায়ার করি।” দেরি না করে সেদিনই তাঁরা তাঁবু, চারকোলসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে শহরের অদূরেই এক নদীর ধারে বড় একটা খোলা মাঠে ক্যাম্প গড়েন।

শুভ্র তুষারে ঢাকা চতুর্দিক। চারদিকের বনাঞ্চলগুলোও যেন সাদা কাপড় পরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। জন্তু–জানোয়ারেরও ভয় নেই। এই শীতে তারাও যেন ঘর থেকে বের হতে ভয় পায়। যেখানে সবার চলাচল সীমিত, সেখানে এরা দুজন শুধু নিজেদের বেদনাগুলো উগরে দিতে এমন নির্জন জায়গা বেছে নিয়েছেন।

এমন হিম ঠান্ডায় কাঠ, কয়লায় আগুন জ্বালানো সহজ কথা নয়। অনেক কসরত করে আগুন জ্বালানোর পর মসলামাখা মুরগি ও রুটি গরম করতে করতে নিজস্ব ধ্যানধারণা, সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলেন দুজন। জুলিয়ানা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। একসময় তাঁর দেশের মার্কসবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর ধর্মীয় মূল্যবোধ আছে, প্রতি সপ্তাহে একবার করে প্রার্থনার জন্য চার্চে যান।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কায়সারের ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই ভালোমতো অবগত জুলিয়ানা। রোজার সময় মসজিদে ইফতার থেকে শুরু করে নানা সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাপনায় কায়সারের সম্পৃক্ততার কারণে অনেকবারই আমন্ত্রিত ছিলেন তিনি। ইসলাম ধর্মের প্রতি জুলিয়ানার বিরূপ কোনো ভাব কখনো পরিলক্ষিত হয়নি। আবার কায়সারও অনেক সময় জুলিয়ানাকে চার্চে রাইড দিয়েছেন।
রাত গভীর হলে দুজনই তাঁবুর নিচে স্লিপিং প্যাড বিছিয়ে, স্লিপিং ব্যাগে নিজেকে আবৃত করে ঘুমাতে যান। কায়সারের কৌতূহল হয়, জানতে ইচ্ছা করে, জুলিয়ানা কেন এই মধ্য বয়সেও বিয়ে করলেন না! জুলিয়ানা জার্মানিতে পিএইচডি করেছেন, দেশে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন, তারপর এ দেশে এসেছেন। অনেক বিলাসী জীবন তাঁর।

আরও পড়ুন

—জুলিয়ানা, তোমার একাকী জীবন কেমন যাচ্ছে? তুমি এখনো বিয়ে করছ না কেন? বিয়ে নিয়ে কী চিন্তা তোমার?
—চিন্তা করি, অনেকবারই চেষ্টা করেছি। কিন্তু ভাগ্য বরাবরই খারাপ। সবাই প্রতারণা করেছেন।
—কানাডায় আসার পর কাউকে খোঁজার চেষ্টা করেছ?
—হ্যাঁ, করেছি।
—কে সে? কী হয়েছিল সম্পর্কটার? চাইলে আমার সঙ্গে শেয়ার করতে পার।
শহরটা বেশি বড় নয়, কায়সার অনেককেই চেনেন। বিশেষ করে অভিবাসীদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ আছে কায়সারের।

তাঁর নাম যুবরান। মুসলিম। ইয়েমেনের নাগরিক। জুলিয়ানা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে চাকরি করেন, যুবরান সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে ব্যাচেলর দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন। কায়সার চেনেন যুবরানকে। একসঙ্গে ফুটবল খেলেন। বেশ লম্বা, স্মার্ট। দেখে বোঝা দায়, যুবরান দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন। কায়সারও আগে জানতেন না।

যুবরানের সঙ্গে জুলিয়ানার সম্পর্ক ছিল চার মাসের মতো। সময়টা কম হলেও বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাঁরা। গ্রীষ্মের সময় হাইকিং, রোড ট্রিপে একসঙ্গে যেতেন। যুবরান খেলতে গেলেও প্রায় সময়ই জুলিয়ানাকে দেখা যেত দর্শক হিসেবে। কমিউনিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও থাকতেন একসঙ্গে। এত ঘনিষ্ঠতা; জুলিয়ানা হয়তো না পাওয়ার হাহাকার থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকার চেষ্টা করতেন।
যখন জুলিয়ানা বিয়ের জন্য বলতে শুরু করলেন, তখনই যুবরান একটু একটু দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। যুবরানের ভিন্নধর্মী মেয়ে বিয়েতে আপত্তি নেই, কিন্তু তাঁর পরিবার নাকি বাসা থেকে নিজ দেশের মেয়ে খুঁজছে। যুবরানের পক্ষে পরিবারের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমিয়ে দেন যুবরান। টেক্সট করলে রিপ্লাই আসে দেরিতে, কলও রিসিভ করেন না অধিকাংশ সময়। যুবরানের ব্যস্ততা বেড়ে যায় অন্যদিকে।

বলতে বলতে জুলিয়ানার কণ্ঠ নিচু হয়ে আসে, হয়তো আরও অনেক স্মৃতি তাঁর চোখে ভাসে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। কষ্টটা সহজেই অনুমেয় কায়সারের।
কায়সার বললেন, ‘এটা তো শুধু চার মাসের সম্পর্ক ছিল, যা হয়েছে ভালোই হয়েছে, দ্রুতই একটা সিদ্ধান্তে এসে গেছ।’ জুলিয়ানা বলেন, ‘সে বিয়ে করবে না আগেই বলতে পারত। সে কেন আমার এত কাছে এসেছিল? আমি তো তাকে ভালোবেসেছিলাম, সে আমার সাথে প্রতারণা করেছে, কেন করল?’
জুলিয়ানা খুব আবেগপ্রবণ হয়ে গেছেন। কায়সার প্রসঙ্গ পাল্টাতে চান, ‘তোমার মা হাসপাতাল থেকে রিলিজ হয়েছেন?’

—হ্যাঁ, এখন বাসায়, কিছুটা ভালো। তবে আগের অনেক কিছুই আর মনে করতে পারছেন না। স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন মানসিক চাপের কারণে। কিছু পড়তে পারেন না, অক্ষরগুলো নতুন করে শেখানো হচ্ছে। ভালো ব্যাপার হলো যে মা দ্রুত শিখে ফেলছেন। কায়সার বলেন, ‘তোমার দ্রুত দেশে গেলে ভালো হয়, এতে উনি মানসিক শক্তি পাবেন। তোমরা পাশে থাকলে কিছুটা হলেও যদি চাপমুক্ত হন।’
—হ্যাঁ যাব, ভিসা হলেই। তুমি খেয়াল রেখো।

আরও পড়ুন

পরের দিন সকালটা বেশ রৌদ্রোজ্জ্বল, ঝকঝকে, পরিষ্কার। আকাশটা নীলাভ, মেঘমুক্ত। কোথাও মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। সূর্যের আলোকরশ্মি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফকণার ওপর পড়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। মনে হয় প্রকৃতি তার সব আবর্জনা, ধুলাবালুকণা বিসর্জন দিয়েছে। নতুন চারার পাতা যেমন সতেজ, সজীব লাগে, তেমনি লাগছে আজকের সকালটা কায়সারের কাছে।

অংলকরণ: মাসুক হেলাল

দুজনই হাঁটতে বের হন নদীর ধারে, নদীর ওপর দিয়ে। নদী জমে বরফ হয়ে গেছে। সেখানে বরফে গর্ত করে নদীর তলদেশ থেকে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করতে দেখা যায় কোনো কোনো শৌখিন মাছশিকারীকে। কায়সার আর জুলিয়ানা চলে যান দূরে, আরও দূরে। খুনসুটি চলে, বাচ্চাদের মতো চলে স্নোবল থ্রোয়িং। কে কাকে ঘায়েল করতে পারে! সব স্বাধীনতা থাকলেও কোথাও যেন আটকে যান কায়সার। জুলিয়ানা মধ্যবয়স্কা হলেও আজ যেন তিনি শিশু। বাধ না মানা উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনা তাঁর, অনেক চনমনে। জুলিয়ানা বলেন, ‘কায়সার, তুমি এত আলসে কেন, দ্রুত এসো। এদিকে এসো, তুমি আমার থেকেও বয়স্ক নাকি?’ কায়সার রহস্য করে চেঁচিয়ে বলেন, ‘জুলিয়ানা, এ দেহে নদী আছে, কিন্তু সে নদীর স্রোত নেই। যা আছে, তা তিন-চার ফুট নিচে। ওপরের তিন-চার ফুট পানি যে জমে বরফ হয়ে গেছে। বাইরে থেকে সেই নদীর ক্ষুরধারা স্রোত বোঝার সাধ্য কার?’
চলবে….

*লেখক: নূর আলম, পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইক, ফ্রেডেরিক্টন, কানাডা।