উচ্চাভিলাষিনীর ভালোবাসা

ফা্ইল ছবি

স্বপ্ন মানুষকে তাড়িত করে, স্বপ্ন মানুষকে বিতাড়িত করে। প্রত্যেকেরই স্বপ্ন থাকে। কোনোটি ছোট, কোনোটি বা বড়। সেটি যেমনই হোক, পরস্পর বিপরীতধর্মী দুটি রূপ আছে বৈকি। ভালোবেসে কাছে রাখা ও স্বার্থপরের মতো প্রয়োজন শেষ হলে দূরে ঠেলে দেওয়া। স্থান, কাল ও পাত্রই বলে দেয়, কার জন্য কোনটি অপেক্ষমাণ।

কায়সার (ছন্দনাম)ও তার ব্যতিক্রম নন। সদ্য কলেজ পাস করা কায়সার তখন নিজের জীবনকে সুন্দরভাবে গোছানোর জন্য, উন্নত জীবনযাপনের জন্য বিদেশে পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন। মা-বাবা ছাড়া কোনো পিছুটান নেই। স্বপ্নের দেখা মিলল অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র ও পরে কানাডায় এসে স্থায়ী বসবাসের কথা চিন্তা করেন।

কায়সারের একাগ্রতা ও মেধার কমতি নেই। ভর্তি হন কানাডার সামনের সারির বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েট প্রোগাম কম্পিউটার সায়েন্সে। অনেক ভালো সাবজেক্ট, চাকরির সমস্যা হয় না। পাস করলেই চাকরি। ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল। দেশে মা–বাবাও গর্ব বোধ করেন, ছেলে ভালো কিছু করবে। আর কয়েকটা বছর কষ্ট করলেই পরিবারে শান্তি চলে আসবে, তাঁদের সুনাম হবে। ছেলের সুবাদে তাঁরাও কানাডায় যেতে পারবেন।

দুই দিন পর হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট আসে ‘আমার জন্য অনেক করেছ তুমি, আমি অবশ্যই সেটা মনে রাখব। জীবনে কখনো সুযোগ পেলে শোধ করে দেব। আমার ওপর কোনো রাগ বা কষ্ট রেখো না। পারলে দোয়া কোরো আমার জন্য। সর্বদাই বিশ্বাস করি, আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। আবারও বলছি, এত দিন আমার জন্য যা করেছ, তার জন্য ধন্যবাদ দিয়ে তোমাকে ছোট করব না। তুমি পাশে না থাকলে এত দিন এভাবে বেঁচে থাকতে পারতাম না। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। সব সময় ভালো থেকো।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ফেসবুকে পরিচয় হয় তাঁরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক মেয়ের সঙ্গে, নাম রিশা (ছন্দনাম)। তিনি দেশেই থাকেন। দেখতে সুন্দরী, মডেলদের মতো। কথা বলার লোভ সংবরণ করা কঠিন হয়ে যায় কায়সারের। একটু একটু থেকে বেশি কথা বলা, বন্ধুত্ব থেকে ভালোলাগা। সেখান থেকে ভালোবাসায় রূপান্তর ঘটে। কানাডায় পড়াশোনা, সুন্দরী মেয়ে, পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা, কোনো কিছুতেই কমতি নেই কায়সারের। ১৮-১৯ বছরের তরুণ কায়সার, উড়ু উড়ু ভাব। যতই সময় যায়, রিশাকে ঘিরে তাঁর স্বপ্নের ডানা মেলতে থাকে।

কায়সার বছর বছর দেশে যান। রিশার সঙ্গে দেখা হয়। তাঁরা একসঙ্গে ঘোরাঘুরি করেন। রিশার স্বপ্নও বড় হয়। রিশা বরাবরই বড় স্বপ্ন দেখেন। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক সচেতন তিনি। কানাডায় আসতে চান, পড়াশোনা করতে চান, বড় কিছু হতে চান। কায়সারেরও চাওয়া, রিশা আসুক। কানাডায়ই তাঁরা একসঙ্গে থাকবেন। তিনি রিশাকে গাইড করেন। প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করেন। আইইএলটিএস, ইউনিভার্সিটি সিলেকশন, এখানকার জীবন-জীবিকা ও নানান বিষয়ে সম্যক ধারণা দেন।

সম্পর্কের তৃতীয় বছরে কায়সার স্নাতক হন। পরপরই ভালো একটা চাকরি পেয়ে যান। সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়। বিয়ে করার স্বপ্নও দেখতে থাকেন তাঁরা। অন্যদিকে রিশাও একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি শেষ করে। রিশার কানাডায় আসার স্বপ্ন আরও জোরদার হয়। তাঁরা দুজন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। কানাডায় আসার এক বছর পর আবার দেশে গিয়ে ধুমধাম করে বিয়ে করবেন।

কায়সারের ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। রিশার জন্য তিনি সর্বস্ব দিতে রাজি। বছর দুয়েক হলো, কায়সারের চাকরি হয়েছে। রিশাও চাকরি করেন এক বছর ধরে। কায়সার আবার ভ্রমণপিপাসু। তিনি বিভিন্ন দেশে ঘুরতে যান আর দামি দামি উপহার জমা করে রাখেন রিশার জন্য। রিশার যাতে কোনো ধরনের কষ্ট না হয়, সে জন্য প্রতি মাসে তাঁকে নানাভাবে সহায়তা করতে থাকেন। রিশার পরিবারও খুশিমনে মেনে নেয়।

তাঁদের খুবই স্বাভাবিক, সুন্দর, হাসিখুশি সম্পর্ক চলতে থাকে। সবই ভালো চললেও মাঝেমধ্যে কায়সারের দুশ্চিন্তা হয়। রিশাকে নিয়ে কি তিনি সুখী হতে পারবেন! রিশা যে উচ্চাভিলাষী। তাঁর সঙ্গে কোনো ছলচাতুরি করছেন না তো? কায়সার অনেক দূর ভাবেন। রিশা কানাডায় এসে তাঁকে আগের মতো ভালোবাসবেন তো? দেশ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তাঁর যে মায়াবি চাহনি, হারানোর অজানা ভয়, এসব থাকবে তো?

কায়সার চান এগুলো সবই থাকুক। একবারে মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত। এসব তাঁকে শক্তি জোগায়, কেউ তাঁর সঙ্গে আছেন সব সময়। সারা দিন কাজ করে বাসায় গিয়ে, বিছানায় গা একটু এলিয়ে দিয়ে এসব স্মৃতি দুচোখের সামনে এলেই সব ক্লান্তির যেন আটলান্টিক মহাসাগরে জলাঞ্জলি হয়।

ফাইল ছবি

কিছুদিন ধরে রিশা কায়সারকে বলেন, ‘আজ হোক, কাল হোক, কানাডায় তো আসতেই হবে। ব্যাংক সলভেন্সি দেখাতে হবে। তুমি তো ভালো চাকরি কর। কিছু টাকা দাও, অ্যাকাউন্টে রেখে দিই।’ খুবই ভালো কথা। অ্যাকাউন্টে যেহেতু টাকা আছে, তাই দিতে কোনো কার্পণ্য করেন না কায়সার। অ্যাকাউন্ট সলভেন্সি হওয়ার পর থেকে রিশা একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কায়সারকে আর আগের মতো সময় দিতে পারেন না। কায়সার ভাবেন, পারিবারিক নানা ব্যস্ততা থাকতেই পারে। মনকে সান্ত্বনা দেন তিনি।

ব্যস্ততার মধ্যেও কথা চলে। কায়সার অপেক্ষায় থাকেন। রিশার টেক্সট কখন পাবেন। কখন তিনি একবার কল দেবেন। করোনাকালে হঠাৎ একদিন রিশা বলেন, ‘তোমাদের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো আমাকে কানাডায় যেতে আমন্ত্রণ করেছেন।’ সরলমনা কায়সার ভাবেন, রিশা দুষ্টুমি করছেন। তাঁর অগাধ বিশ্বাস রিশার ওপর। একটু খটকা লাগলেও তিনি গা করেন না।

কানাডায় বাসা কীভাবে খুঁজতে হয়, ভাড়া কেমন হয়, খরচাপাতি কত, এসব নানা বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রিশা জানতে চান কায়সারের কাছে। কায়সার ভাবেন, জানা ভালো। আগে থেকে জানলে বরং তাঁরই সুবিধা হবে। পরে তাঁকে আর বেশি ঘাঁটাবে না রিশা। জীবন তখন সহজ হবে।

রিশার ব্যস্ততা আরও বেড়ে যায়। কায়সারের অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হতে থাকে। কায়সার কল দিলে বলেন, এখন একটু ব্যস্ত, হাসপাতালে তাঁর আন্টি ডাক্তার দেখাতে এসেছেন। আবার কল দিলে বলেন, বন্ধুদের পার্টিতে আছেন, পরে কল দেবেন। কখনো বলেন, সামনের দুই দিন তিনি ভীষণ ব্যস্ত থাকবেন। বাসা শিফট করবেন। আরও কিছু টাকা দিলে ভালো হতো।

ফাইল ছবি

কায়সার মানিগ্রামে টাকা পাঠান। কল দিলে রিশা বলেন, এখন একটু শপিং মলে এসেছেন। পরে কথা হবে। কিন্তু কার শপিং, কিসের শপিং এসব প্রশ্ন কৌশলে এড়িয়ে যান রিশা। কায়সারের মনে তোলপাড় শুরু হয়। ভয় কাজ করে। নিজেকে জিজ্ঞেস করেন, রিশা কেন আর আগের মতো নেই! এটা কি সাময়িক, নাকি নতুন কিছু ঘটতে যাচ্ছে? কোনো হিসাব মেলাতে পারেন না কায়সার। ভাবেন, দুই দিনই তো। বাসা শিফট করলে ব্যস্ততা কমে যাবে। তখন তাঁর রিশা রিশাই থাকবে। তাঁকে তো তিনি ছয় বছর ধরে চেনেন। যদিও এই চেনা একটু নতুন লাগছে কায়সারের কাছে।

দুই দিন পর কায়সারের হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট আসে ‘আমার জন্য অনেক করেছ তুমি, আমি অবশ্যই সেটা মনে রাখব। জীবনে কখনো সুযোগ পেলে শোধ করে দেব। আমার ওপর কোনো রাগ বা কষ্ট রেখো না। পারলে দোয়া কোরো আমার জন্য। সর্বদাই বিশ্বাস করি, আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। আবারও বলছি, এত দিন আমার জন্য যা করেছ, তার জন্য ধন্যবাদ দিয়ে তোমাকে ছোট করব না। তুমি পাশে না থাকলে এত দিন এভাবে বেঁচে থাকতে পারতাম না। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। সব সময় ভালো থেকো।’

ফাইল ছবি

কায়সারের মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। শরীরের শক্তি যেন নিমিষেই শেষ হয়ে এল। চেয়ার থেকে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। এ গা এলিয়ে দেওয়া আগের স্বাভাবিক সময়ের মতো নয়। আগে গা এলিয়ে কল্পনার জগতে ভেসে বেড়াতেন। আর এবার; ভেসে বেড়ানোর মতো শক্তি তাঁর অবশিষ্ট নেই এক বিন্দুও। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবারও রিশার টেক্সট।
—আমি চলে যাচ্ছি কায়সার। তুমি অনেক ভালো। ভালো থেকো।
—কোথায় যাচ্ছ তুমি?
—কানাডা।
—ভালো।
—ভালো থেকো। বিদায়।

কায়সার পজিটিভ থাকার চেষ্টা করেন। রিশা হয়তো তাঁর সঙ্গে মজা করছেন। তিনি হয়তো কোনো আত্মীয়স্বজনের বাসায় যাচ্ছেন। কথা বলতে পারবেন না আরও দুই–এক দিন। কায়সার দ্বিধা–দ্বন্দ্বে পড়ে যান। বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। রিশার শপিংয়ের কথা মাথায় ঘুরপাক খায়। ভাবেন, রিশা কি অন্য কাউকে বিয়ে করে চলে যাচ্ছেন? কায়সার নিশ্চিত হতে চান। এখনই হতে চান। মনকে আর সামলে রাখতে পারেন না তিনি।

—কখন ফ্লাইট?
—এখন (সোমবার রাত ১১:৩০)।
কায়সার ধাঁধায় পড়ে যান।
—সত্যি?
—আল্লাহ হাফেজ।
—কিছু বলো না, প্লিজ!
—পারলে দোয়া কোরো। আর কোনো কিছু নিয়ে আমার ওপর রাগ কোরো না, প্লিজ।
—কোন ফ্লাইট?
—তুর্কি।
—কোথায় থাকবে, কী খাবে এই কোভিডের সময়?
—আমার জন্য কোনো চিন্তা কোরো না, সব প্রস্তুত আছে।
—তোমার বোর্ডিং পাসের একটা ছবি দাও, প্লিজ। আমি তোমাকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে থাকব।
—আমি ব্যস্ত, সময় নেই।

প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

এরপর কায়সারের সঙ্গে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেন রিশা। কায়সার আর তাঁকে খুঁজে পান না কোথাও। কায়সার নিশ্চিত হতে চান, রিশা কি সত্যিই কানাডায় আসছেন! রিশা কেন এমন আচরণ করছেন, কিছুই মাথায় আসে না কায়সারের। তুর্কি এয়ারলাইনসের সাইটে গিয়ে খুঁজতে চেষ্টা করেন, সত্যিই কি তুর্কি এয়ারলাইনস রাত ১১:৩০ টায় ঢাকা ছাড়বে? তিনি নিশ্চিত হন, সত্যি সেটা তুর্কি এয়ারলাইনস কি না। কায়সার কানাডায় কোনো এয়ারপোর্টে গিয়ে অপেক্ষা করবেন।

কানাডা তো অনেক বড় দেশ। তাঁর কাছে তো ইটিনারেরি নাই। পাগলের মতো হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন তিনি। রিশার মাকে কল করেন ১০০ বারের মতো। ফোনে রিং হয়। রিংটোন শেষ হয়ে যায়। কেউ কল রিসিভ করে না।

কায়সার অপেক্ষায় থাকেন, হয়তো আবার রিশা তাঁকে টেক্সট করবেন। বলবেন, আমি তোমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিলাম। তুমি আমায় ভুলে যাও কি না। কায়সারের নির্ঘুম রাত কাটে। তিনি ভাবেন, হয়তো কালই রিশার একটা টেক্সট পাবেন। সব কষ্ট ভুলে তাঁরা আগের মতো স্বপ্ন দেখবেন। মনে মনে ভাবেন, ভালোবাসায় যত কষ্ট থাকে, ভালোবাসা ততই মধুর হয়।

পরবর্তী সময়ে কায়সার জানতে পারেন, রিশা সত্যি সত্যি কানাডায় এসেছেন। কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট ঠিকানা কায়সারের জানা নেই।

*লেখক: পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইক, ফ্রেডেরিক্টন, কানাডা। [email protected]