এক শিশু আমাকে বাঁচিয়েছিল

শীতকালে এভাবে বরফে ঢেকে যায় কানাডার রাস্তাঘাট
শীতকালে এভাবে বরফে ঢেকে যায় কানাডার রাস্তাঘাট

চার ঋতুর (শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম ও শরৎ) দেশ কানাডা । ডিসেম্বর, জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি, এই তিন মাস হলো শীতকাল। শীতকালে কানাডাজুড়েই হয় প্রচণ্ড তুষারপাত। এ সময় তাপমাত্রা থাকে খুবই কম। কোনো কোনো প্রদেশে চলে যায় হিমাংকের ২০ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড নিচে। এত ঠান্ডায় কী কী বিপদ হতে পারে, তা আমার জানা ছিল না। আর তাই এক প্রচণ্ড শীতের সকালে মহা বিপদে পড়েছিলাম। সেই সময় মাত্র ৬ বছরের কানাডিয়ান শিশু লিয়াম আমাকে বিরাট বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিল।
ঘটনাটি ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। আমি তখন কুইবেক প্রদেশের মনট্রিয়েল শহরে থাকি। আয়তনের দিক দিয়ে কুইবেক হলো কানাডার সবচেয়ে বড় প্রদেশ। কুইবেকের রাজধানীর নাম কুইবেক সিটি। আর মনট্রিয়েল হলো কুইবেক প্রদেশের সবচেয়ে বড় শহর। মনট্রিয়েল কানাডার অন্যতম সুন্দর শহর। পুরো শীতকালে সাদা বরফে আচ্ছন্ন থাকে। যেন এক সুন্দরী সাদা শাড়ি পরেছে তার প্রিয়তমর জন্য।
আমার বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে হেঁটে যেতে সময় লাগত ৩০ মিনিটের মতো। আমি তখন ইউনিভার্সিটি অব কুইবেকে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণারত। আমি হেঁটেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম। আমার গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক (সুপারভাইজার) জানতেন যে আমি বাংলাদেশি। তাই তিনি আমাকে শীতের আগেই ভালো একটা দোকান থেকে ভালো জ্যাকেট, হাত-পায়ের মোজা, বুটজুতা, আর মাথার ক্যাপ কিনে দিয়েছিলেন। আমার সুপারভাইজার আমাকে বলেছিলেন, ওই পোশাক পরলে তাপমাত্রা যদি হিমাংকের ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচেও নেমে যায়, তা–ও কোনো অসুবিধা হবে না। সত্যিই আমার তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু অন্য ঝামেলা যে হতে পারে, সেটা আমার চিন্তায়ও আসেনি।

বাড়ির সামনে জমা বরফ
বাড়ির সামনে জমা বরফ

শীতকালে কানাডার জনসাধারণ প্রতিদিন কয়েকবার করে আবহাওয়ার সংবাদ দেখে ইন্টারনেট থেকে। আমিও দেখি কিন্তু তেমন পাত্তা দিতাম না। একদিন দেখলাম, প্রচণ্ড শীতের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তাপমাত্রা হিমাংকের ৩০ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড নিচে নেমে যেতে পারে। জনগণকে বাইরে বেশিক্ষণ থাকতে মানা করা হয়েছিল। আমি বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দিইনি।
পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়েই সেদিন সকাল সাতটার সময় বাসা থেকে বের হয়েছি। প্রচণ্ড শীতে কান ঢেকে রাখা খুবই জরুরি, অন্যথায় কানের পাতা বাঁকা হয়ে যেতে পারে। তাই ভালোমতো কাপড়চোপড় পরিধান করেই নিয়েছিলাম। বেশি শীতে আমার আবার আরেক সমস্যা হয়। সেটা হলো আমার গলা শুকিয়ে যায়। আর তাই এক বোতল খাবার পানি হাতে নিয়েই রওনা হয়েছিলাম বাসা থেকে। ৫ মিনিট হাঁটার পরই বুঝতে পারলাম, কেন আবহাওয়া দপ্তর সর্তকতা জারি করেছিল। তুষারে আবৃত পিচ্ছিল পথে আমার হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। সেই সঙ্গে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছিলাম না ভালোভাবে। বরফের মধ্যে আস্তে আস্তেই হাঁটছিলাম। বুঝতে পারলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে যেখানে আমার ৩০ মিনিট সময় লাগে, সেদিন আমার প্রায় এক ঘণ্টা সময় লেগে যেতে পারে।
প্রায় ৩০ মিনিট হাঁটার পর আমার অবস্থা একেবারে কাহিল। আমার গলা একেবারে শুকিয়ে গেছে। ঢোক গিলতে পারছিলাম না। তাই, পানির বোতলটা মুখে লাগিয়ে একটু গলা ভেজানোর চেষ্টা করলাম। একি! পানি বের হচ্ছে না। প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে খেয়াল করলাম, বোতলের পানি বরফে পরিণত হয়েছে। ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লাম, এখন কী করব আমি?
খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না। কোথায় এখন পানি পাব? চারিদিকে তাকালাম, কোথাও পানির কল খুঁজে পেলাম না। আশপাশে কোনো দোকানও দেখলাম না। এমন সময় দেখি দুটি ছেলেমেয়ে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাচ্ছে। ওদের দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তখন তাপমাত্রা এত নিচে। ছেলেটার বয়স আনুমানিক ছয় আর মেয়েটার বয়স হতে পারে ১০ বছর। দুজনই স্কুলের পোশাক পরা। বুঝলাম ওরা স্কুলে যাচ্ছে। ছোট ছেলেটার পুরো শরীরই সাদা হয়ে রয়েছে তুষার লেগে। মনে হলো, ছেলেটা তুলার বালিশ নিয়ে ছোড়াছুড়ি করেছে সারা পথ। আসলে তুষার দেখতে অনেকটা তুলার মতোই।

লেখক
লেখক

আমি একটু এগিয়ে যেয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁর কাছে একটু পানি হবে কি না। মেয়েটা আমাকে বলল, আপনার পানির কী দরকার? আমি বললাম, আমার গলা শুকিয়ে গেছে, আমি তো শ্বাস নিতে পারছি না। মেয়েটা আমাকে জানাল, তার কাছে কোনো পানি নেই। তখন জানতে চাইলাম, আশপাশে পানি পাওয়া যাবে কি না। মেয়েটা আমাকে বলল, ‘এখানে পানি কোথায় পাবেন, দোকান তো অনেক দূরে।’ খেয়াল করছিলাম, ছোট ছেলেটা খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনছে আর হাসছে।
ছোট ছেলেটার ওপর আমার একটু রাগ হলো। আমি ওকে বললাম, আমি পড়েছি বিপদে আর তুমি হাসছো। আমি ছেলেটাকে ওর নাম জিজ্ঞাসা করলে ও বলল ওর নাম লিয়াম। লিয়াম আমাকে বলল, ‘তুমি তো একটা বোকা।’ আমি বললাম, কেন? আমি আবার বোকামির কী করলাম! লিয়াম জানালো, ‘এত শীতে কি কেউ হাতে পানির বোতল নিয়ে বের হয়!’ আমি বললাম, আসলেই আমি একটা বোকা। লিয়াম বলল, ‘তুমি শুধু বোকা না, “মহা-বোকা”।’ আমার একটু রাগ হলো, আমি লিয়ামকে বললাম, এটা কী বললে তুমি? তুমি কি জানো আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরেট করছি, তুমি তো পিএইচডির মানেই জান না! আর পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা কী, বলতেই পারবে না।
লিয়াম হাসতে হাসতে বলল, ‘এই যে মহাজ্ঞানী, আপনি কি বিশুদ্ধ তুষার দেখতে পাচ্ছেন না? বলেই একদলা তুষার মুখে নিয়ে বলল, খেয়ে দেখো কত মজা! গলা যেন না শুকায় তাই তো প্রকৃতি আমাদের দিয়েছে এই বিশুদ্ধ আইসক্রিম।’ লিয়ামের কথায় অবাক হয়ে গেলাম। সত্যিই তো, আমি এক মহা বোকা। রাস্তা থেকে এক লোকমা তুষার মুখে নিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলাম, আহ কি শান্তি! মহাবিপদ থেকে রক্ষা পেলাম। লিয়াম হাসতে হাসতে দুষ্টুমি করে বলল, ‘এই যে ডক্টরেট সাহেব, কানাডার বিশুদ্ধ আইসক্রিম বিনা মূল্যে না, ভালোয় ভালোয় এক ডলার বের করো দেখি।’
রুহুল খান
ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া
ভ্যানকুভার, কানাডা