একজন আইয়ুব বাচ্চু এবং আমাদের শৈশব-কৈশোর

আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসান, পার্থ বড়ুয়া, সাফিন আহমেদ

‘তোমার মাঝেই স্বপ্নের শুরু,
তোমার মাঝেই শেষ
জানি ভালো লাগা আর ভালোবাসার তুমি
আমার বাংলাদেশ...’

এমন করে গাওয়ার মতো আইয়ুব বাচ্চু ছাড়া এই বাংলাদেশে কেউ কি আছে?
না, আমি কোনো অভিযোগ তুলছি না, যাচ্ছি না আলোচনা অথবা কোনো সমালোচনায়। একজন শ্রোতার অধিকার থেকে নিজের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিচারণা করছি বলা চলে। সেই কিশোরবেলায় এলাকায় বড় ভাইয়েরা গান শুনতেন আর সেই গানের কথা-সুর তাঁদের আচরণে এবং চলাফেরায় এক অন্য ধরনের ভাব দিত। গলির মোড়ে দেয়ালের ওপর বসে থাকার সেই ভাব থেকে উৎসাহ নিয়ে আমারও গান শোনার শুরু। কোনো এক ঈদে আমার ছোট মামা আমাকে একটা মিক্সড অ্যালবাম গিফট করেন ‘ওরা এগারো জন’ নামে। সেই প্রথম মিক্সড অ্যালবাম শুনি, তারও আগে ঠিক খেয়াল নেই, বোধ হয় কোনো আত্মীয়ের বাসায় অথবা অন্য কোথাও আমি ওয়ারফেইজের বিচ্ছিন্ন আবেগসহ প্রথম অ্যালবামের কয়েকটি গান শুনে ওয়ারফেইজ এবং বিশেষ করে সঞ্জয়ের ভোকালের প্রেমে পড়ে যাই।

ওই সময় তো বেসিক্যালি আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসান, পার্থ বড়ুয়া, মাকসুদ, টুলু, বিপ্লব, শাফিন আহমেদ, ফজল, নকিব খান, জুয়েল, চন্দন, খালিদ আর আমার অনেক প্রিয় সঞ্জয়রা জনপ্রিয় শিল্পী। আর ব্যান্ড বলতে এলআরবি, সোলস, ফিলিংস, মাইলস, উইনিং, প্রমিথিউস, আর্ক, নোভা, অবসকিওর, রেনেসাঁ, চাইম এবং আমার অনেক বেশি প্রিয় এবং ভালো লাগার ওয়ারফেইজসহ আরও অনেক।

আশি আর নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের সংগীত অঙ্গনে আমার মনে হয় এক অন্য রকম উন্মাদনা ছিল, ছিল সুর-কথা আর গানের এক অন্য ছন্দ। ওই সময়ের এমন আরও অনেক ব্যান্ড এবং শিল্পীর অনেক সৃষ্টি ছিল, যা এক কথায় অসাধারণ। নিলয় দাস, শেখ ইশতিয়াক, জুয়েল, হ্যাপী আখন্দ, কামাল আহমেদ (ডিজিটাল), নয়ন মুন্সী, ডিফারেন্ট টাচ, তপন দা, কুমার বিশ্বজিৎ, সিম্ফোনি, আদনান বাবু এমন আরও অনেকে ছিল এবং আরও অনেক ব্যান্ডও ছিল (সবাইকে মনে পড়ছে না)। নতুনত্ব কিছু সৃষ্টির উন্মাদনা ছিল, ছিল গান বান্ধার খেলা। গানের সুর ও কথা অন্তর ছুঁয়ে যেত।

যখনই কোনো নতুন অ্যালবাম বের হতো, শুধু চেষ্টা থাকত কীভাবে টাকা জোগাড় করে সেই অ্যালবামটা কিনব আর কখন শুনব। শোনার জন্য একটা আলাদা অস্থিরতা কাজ করত। একটা অ্যালবামের সব গান তো আর নিজের মনমতো হয় না, আর কখনো কখনো একটা অ্যালবাম কেনার পুরো টাকাও থাকত না। স্কুলের সামনে সেই তখন থেকেই একটা ক্যাসেটের দোকান ছিল ‘জিপসি’ নামে। জিপসি কুমিল্লা শহরের অনেক তরুণ, কৈশোরের স্মৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। অনেকের মতো আমারও স্মৃতির অনেকটা জায়গা দখল করে আছে এই ‘জিপসি’, যা কিনা এখনো আছে। এই জিপসি আসলে আমাদের সংগীত শোনার সূত্রপাত। আমি সবে মাত্র ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছি। একদিন ক্লাস চলছে, হঠাৎ শুনি স্পিকারে বাজছে (জিপসির বাইরে অনেক বড় একটা সাউন্ড বক্স ছিল) আর্ক-এর একাকী। সেই সে হাসান। তো মাঝেমধ্যে গিয়ে ভাইয়াকে বলতাম বাছাই করে গান রেকর্ডিং করে দিতে, এখনো মনে পড়ে বাছাই করে গান রেকর্ড করলে ১২ টাকা লাগত, আর পুরো অ্যালবাম করলে লাগত ১০ টাকা। বাংলা ব্যান্ডের ক্যাসেটের দাম ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা।

আমার নিজের একটা ব্যক্তিগত উন্মাদনা ছিল ব্যান্ডের পোস্টারের প্রতি। যখনই কোনো দোকানে কোনো ব্যান্ডের পোস্টার দেখতাম, তাকিয়ে থাকতাম খুব মনোযোগ দিয়ে এক বিস্ময় নিয়ে। মাঝেমধ্যে পোস্টার কিনতাম, যদিও খুব বেশি পাওয়া যেত না, আর বাসায় লাগানোর অনুমতিও ছিল না। অ্যালবামের পোস্টারগুলোর মধ্যেও কেমন যেন এক উন্মাদনা ছিল, যা কিনা আমাদের কৈশোরকে নাড়া দিয়ে যেত।

এরপর অপেক্ষা, কবে কখন পরবর্তী অ্যালবামটা আসবে। তবে সেই সময়ের গানগুলোর মধ্য একটা সৃষ্টি ছিল। আজও এখনো সেই সময়ের এখনকার প্রজন্মের মানুষের মুখে ‘চলো বদলে যাই, দুঃখিনী দুঃখ করো না, কেন এই নিঃসঙ্গ’র মতো অনেক গান মুখে মুখে ভেসে বেড়ায়। আমরা এখনো সন্ধ্যা রাতে আইয়ুব বাচ্চুর সেই ‘তারা ভরা রাতে’ শুনলে কেমন যেন আনমনা হয়ে যাই। যেমন ছিল গানের কথা, তেমনি সুর, সবই যেন মনে দাগ রেখে যাওয়া। এখনো আমার মনে পড়ে যখন জেমসের ‘দুঃখিনী দুঃখ করোনা’ বের হলো, অ্যালবামের গায়ের সেই প্রচ্ছদ কালো চাদর গায়ে দেওয়া, এরপর আমাদের সবার মধ্যে একটাই স্টাইল জিনস প্যান্টের সঙ্গে সাদা পাঞ্জাবি আর তার ওপর গায়ে কালো চাদর।

গানের কথা, সুর, কণ্ঠ শুনলে মনের ভেতর এমন নাড়া দিত, আসলে এখনো এসব গান শুনলে অদ্ভুতুড়ে অনুভূতি হয়। এটাই হলো সৃষ্টি, এঁদের বলে শিল্পী। এঁরা খ্যাতির জন্য নয়; মনের টানে, প্রাণের টানে গান করতেন। যেমন ছিল বাচনভঙ্গি, তেমন উচ্চারণ। এখনকার মতো এত রিসোর্স ছিল না তখন।

এখন অনেক শিল্পী সকালে ভাবে শিল্পী হওয়ার, দুপুরের মধ্যে কথা-সুর রেডি, বিকেলে ইউটিউবে আপলোড, তারপর খ্যাতি অতঃপর বাকিটা ইতিহাস। সবই শুধু খ্যাতি বাড়ানোর জন্যই, লাইক, শেয়ার, কমেন্টসের মধ্যই আটকে রয় স্রষ্টার সৃষ্টি। প্রিন্স মাহমুদ, মারজুক রাসেল, দেহলভী, লতিফুল ইসলাম শিবলী, শওকত, আসিফ ইকবাল, তরুণ—এঁদের গানের লিরিক লেখার সঙ্গে তুলনা করব কাকে? এঁরা কেউই খ্যাতি চাননি, এঁরা শুধুই সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা ওঁনাদের প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছি। এখনো দেখি এই শিল্পীদের যাঁরা মাঝেমধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যান, তারা অবশ্যি ওনাদের সিনিয়রদের সম্মান প্রদান করেন, তাঁদের ধন্যবাদ দেন।

কিন্তু বিধি বাম, এখনকার শিল্পীরা তো আসলে এক দিনের শিল্পী, তাঁরা জানেনই না আসলে সংগীত কী, আর সম্মান তাঁদের নিকট অপরিচিত এক শব্দ। এখন অনেক টিভি চ্যানেলে মিউজিক নিয়ে অনেক অনুষ্ঠান হয়, অবাক করার বিষয় হলো, যাঁরা উপস্থাপনা করেন, তাঁদের বেশির ভাগই বাংলা ব্যান্ডের মিউজিক সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা রাখেন না বলেই আমার মনে হয়। এর কারণে তাঁরা শিল্পীদের গানের পেছনের সেই সময়ের ইতিহাস নিয়ে কোনো কিছু জানতেও চান না। মূল কথা, তাঁরা গানের সৃষ্টির ভেতরেই যেতে পারেন না, গানের অনুভূতিটাকেই ধরতে পারে না। এসব অনুষ্ঠানের প্রযোজকদের উচিত উপস্থাপক হিসেবে এমন কাউকে দেওয়া, যাঁরা গানের অনুভূতি এবং সেই আশি-নব্বইয়ের দশকের সংগীতের ওপর আগ্রহ, অনুভূতি প্রেম আছে।

আমাদের সুর-সংগীতকে যাঁরা শূন্য থেকে নিয়ে এসেছিলেন আজকের অবস্থানে, তাঁদের সেই প্রাপ্য মর্যাদা পরিপূর্ণভাবে আমরা কখনোই দিতে পারিনি। আজ এই সময়ে এসে হয়তো প্রযুক্তির কল্যাণে অনেকেই এঁদের কথা জানতে পেরেছি, তবুও দেখা যায় এঁরা এই খ্যাতির সামনে এসে কেমন যেন সংকোচ বোধ করেন। কারণ ওঁনারা কখনোই খ্যাতির জন্য কিছু করেননি, করেছেন ভালো লাগা আর ভালোবাসা থেকে।
জেমস বা আইয়ুব বাচ্চু অথবা নকিব খান, ফুয়াদ নাসের বাবু এঁদের কাউকে কখনোই এঁদের সৃষ্টি নিয়ে, কর্ম নিয়ে বা বর্তমান অবস্থা নিয়ে নিজেদের পাণ্ডিত্য জাহির করতে দেখা যায় না। পুরোনো দু-একজন বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানে এলেও জেমস এবং প্রিন্স মাহমুদের মতো মানুষ ক্যামেরার পেছনেই থাকতে ভালোবাসেন। এখন তো নিত্যদিনের বিনোদন অর্থাৎ মিউজিক অঙ্গনের খবর খুললেই জানা যায় কাদা-ছোড়াছুড়ি আর ভাঙনের গল্প। অনেকেই চলে গেছেন ওপারে, রেখে গেছেন তার সৃষ্টি। আমার মনে হয়, শিল্পী চলে গেলে আমরা তাঁকে নিয়ে যেই ট্রিবিউট আর যেভাবে তাকে নিয়ে স্মৃতির দুয়ার খুলে বসি, ভালো হয় যদি জীবিত থাকতে শিল্পীকে আমরা সেই মর্যাদাটুকু দিই।

যেদিন বাচ্চু ভাই মারা যান, আমার বন্ধু ফুয়াদ আমাকে মেসেজ পাঠায়, এখানে রাত থাকায় ঘুমে ছিলাম, ঘুম ভেঙে মেসেজটা পড়ে বিশ্বাস করিনি, এরপর নিউজ দেখলাম বিশ্বাস করি না এখনো।

লেখাটা শুরু করেছিলাম যখন তখন বাচ্চু ভাই বেঁচে ছিলেন। আমি দুই বছর ধরে চেষ্টা করে একটা শব্দও লিখতে পারিনি। কথায় আছে মানুষ শোক, কষ্ট কাটিয়ে ওঠে। না, বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে আমার কোনো ব্যক্তিগত পরিচয় নেই, কখনো আমি ওনাকে সামনাসামনি দেখিনি কনসার্ট ছাড়া। খুবই শক্ত মানুষ আমি, আড়ালে একদিন বাচ্চু ভাইয়ের ‘তারাভরা রাতে’ শুনতে গিয়ে যখন মনে পড়ল এই মানুষটা আর নেই, দেখি আমার কেমন যেন শূন্য লাগছে। মনে হচ্ছিল আমার পুরো শৈশব-কৈশোরটাই বুঝি হারিয়ে গেল। এই হলো শিল্পী, এই তাঁর সৃষ্টির সার্থকতা। এই দূর প্রবাসী জীবনে জীবন, সময়, আবেগ-অনুভূতি সবই হয় বদলায়, নয়তো আড়ালে লুকিয়ে যায় যখনই এই গানগুলোই শুনি অথবা বাজতে থাকে, আর আমিও বেঁচে থাকি এবং এগিয়ে যাই এই সুর-কথার ভেতরে।

এভাবেই একে একে একেকজন করে চলে যাচ্ছেন, তাঁরা কি জানেন তাঁদের এই চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মতো ৮০ এবং ৯০-এর দশকের কত-শত মানুষের শৈশব-কৈশোরও হারিয়ে যাচ্ছে। কি এক অদ্ভুত অনুভূতি আইয়ুব বাচ্চু, জেমস—এই নামগুলো নিজের সঙ্গে এমনভাবেই মিশে আছে কখনো মনেই হয় না এরা অভিন্ন কেউ। আসলে যাঁরা শিল্পী, যাঁরা সুর, কথার সৃষ্টিকারী, এদের সৃষ্টি হয় মনের গহিন থেকে, শুধু অর্থের কথা, খ্যাতির কথা মাথায় নিয়ে আর যা-ই হোক না কেন, সৃষ্টি হয় না। ভালো থাকুক আমাদের সংগীতশিল্প।

..তারপর একদিন ভরা জ্যোৎস্নায়, আমিও চলে যাব
একমাত্র অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে-চির নবান্নের দেশে।

জেনে যাব, ‘সবকিছুই বড় দেরিতে আসে, বড় দেরিতে ধরা দেয়, হারিয়ে যায় সেও হঠাৎ করেই।’

...শুধু কষ্টটা থেকে যায়—আসলে কষ্টটা এভাবেই ছিল, এভাবেই থাকে।
অ্যালবাম কষ্ট: আইয়ুব বাচ্চু।

*কলম্বাস, ওহিও, আমেরিকা। [email protected]