একটু ভালোবাসা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘বাহিরে শ্রাবণ ধারা বইছে। বইছে মোর হিয়াতেও। তবু দূরে রাখি যাতনা, মনে রাখি উল্লাস।’ বৃষ্টি নিয়ে তো অনেক কবিতা আছে। গান আছে। ‘আজি ঝরো ঝরো বাদরদিনে....’ কিংবা ‘বৃষ্টি–নেশা–ভরা সন্ধ্যাবেলা/ কোন্‌ বলরামের আমি চেলা...’। বৃষ্টি নিয়ে শুধু গান মনে পড়ছে। কিন্তু কবিতা মনে পড়ছে না। আচ্ছা, বৃষ্টি নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেললে কেমন হয়!
গগন পাতাল আলিঙ্গনে
ভেসে যাব এই প্লাবনে...
লাইনটা মাথায় আসতেই সরলার ডাক আসে।
জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছি। সরলা আমার জীবনসঙ্গিনী। শহরের বুকে এক বস্তিতে আমাদের প্রাণধারণ। কয়েক মাস ধরে বড্ড রোগে ভুগছি। সরলা একটা রেস্তোরাঁয় কাজ করে সংসার চালায়। আমাকে সকালের নাশতা করিয়ে সরলা চলে যায় রেস্তোরাঁয়। দুপুরে ফিরে এসে গোসল ও খাওয়াদাওয়ার কাজ শেষ করে আবার রেস্তোরাঁয় ছোটে। রাত নয়টার সময় বাসায় চলে আসে। এসেই এই অধম আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সারাটা দিন বাসাতে একা একা থাকতে হয়। একা থাকা অনেক কষ্টের। সেটা সরলা বোঝে।
সরলা সকালের নাশতা নিয়ে আসে।
‘এবার বৃষ্টি দেখা শেষ করে নাশতা খাও। আমার বেরোতে হবে।’
সরলার কথামতো নাশতা খেয়ে নিই। মায়াভরা মুখে সরলা জানতে চায়, আজ কেমন বোধ করছি?
একগাল হেসে বলি, ‘আগের চেয়ে অনেকটা ভালো।’
আমার মুখে হাসি দেখে সরলার বেশ ভালো লাগে। কত দিন আমার হাসিমাখা মুখটা সরলা দেখে না। সেই কবে হেসে কথা বলেছি, সেটা মনে করার চেষ্টা করছে । অনেক দিন পর হাসি দেখে সরলা আজ মহাখুশি। সেটা আমি বুঝতে পারছি। আজ তাই কাজে যেতে ইচ্ছা করছে না। আনন্দে তার চোখের কোণে পানি চলে আসে। সরলাকে কাছে টেনে নিয়ে কপালে একটা চুমু এঁটে দিলাম। সরলা খুব খুশি হয়। ওর খুশিমুখটা দেখে আমারও খুব ভালো লাগছে। অনেক দিন পর আদর পেয়ে সরলা বিস্মিত।
বলে, ‘আজ সারা দিন তোমার সঙ্গে থাকব। আর তোমার আদর নেব।’
‘আমার জন্য তুমি কত কষ্ট করে চলেছ। রেস্তোরাঁয় কাজ করছ। তুমি চাইলে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারতে!’
সরলার আমার মুখে চেপে ধরে। এসব সে শুনতে চায় না। সরলা জানে সে কোন পথের যাত্রী ছিল। তার মতো মেয়েকে আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছি। এটা সরলার জন্য পরম পাওয়া। এমনটা সরলা নিরন্তর ভাবে।

দুই.
মা–বাপ মরা মেয়েটাকে কোনো মানুষ এভাবে নির্যাতন করতে পারে? মেয়েটা কত লক্ষ্মী ছিল। কত ভালো ছিল। চাচির অত্যাচার–নির্যাতন নীরবে মেনে নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে। কত স্বপ্ন ছিল মেয়েটার অনার্স করবে। সেই মেয়েকে কিনা রাবেয়ার ভাই জলিল জোর করে...ছি, ছি, এই কথা ভাবতে লজ্জা লাগে।
অসুস্থ মজনু মিয়া বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু সরলার কথা ভাবে। সরলা তার একমাত্র ভাতিজি। তার আপন ভাই–ভাবির মেয়ে। সরলা যখন ছোট, তখন মা মারা যায়। এর কিছুদিন পর বাবাও গত হয়। চাচা মজনু মিয়া সরলাকে মানুষ করে। মজনু মিয়ার স্ত্রী রাবেয়া প্রচণ্ড লোভী। রাবেয়ার ভাই জলিলকে দিয়ে প্রায়ই নির্যাতন করাত সরলাকে। একটা সময় জোর করে সরলার নামের জমিজমা সবকিছু রাবেয়ার নামে লিখে নেয়। এতেও থামেনি রাবেয়া। সরলাকে জলিলের মাধ্যমে কোনো এক খারাপ লোকের কাছে বিক্রি করে দেয়।
মজনু মিয়া চাচা হয়ে কিছু করতে পারেনি। একদিন শোনে, জলিল ও কয়েকজন মিলে সরলাকে তুলে নিয়ে গেছে। সেই থেকে সরলাকে আর দেখে না মজনু মিয়া। বিছানায় শুয়ে শুধু সরলার কথা ভাবে। সরলা কি বেঁচে আছে? যদি বেঁচে থাকে, তাহলে কোথায় আছে সে? মরার পূর্বে মজনু মিয়া শুধু সরলাকে একবার দেখতে চায়। এটা তার একমাত্র প্রত্যাশা। এই প্রত্যাশাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে মজনু মিয়া। তার বিশ্বাস, একদিন সরলা ফিরে আসবে।

তিন.
দুই দিন হলো সরলা হোটেলে কাজ করতে যায় না। হোটেলমালিক আতাহার সাহেব আসেন সরলার খোঁজে। সরলা বলে, ‘আপনি যান, আমি কাল থেকে আসব।’ আতাহার সাহেব চলে যান।
আমি সম্পূর্ণ সুস্থতা বোধ করছি। সরলার ইচ্ছা, আমি তাকে নিয়ে শহর ঘুরে বেড়াব। আজই যাব। সরলা অনেক খুশি। আমার সঙ্গে সে আজ সারা দিন হাঁটবে। এটা তার ইচ্ছা। চলার পথে হাতে হাত রেখে একটু ন্যাকামি করে বলবে, আমি আইসক্রিম খাব। আমি বলব, আচ্ছা, চলো তোমাকে আইসক্রিম কিনে দিই। আবার বলবে, আমাকে ফুলের মালা কিনে দাও। আমি ফুলের মালা কিনে দেব। আরেকটু পর বলবে, আমার হাঁটতে ভালো লাগছে না। সে সময় আমি বলব, আচ্ছা, চলো রিকশায় উঠি। অনেক দিন পর সরলার মনে হচ্ছে, সে এই পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ। সত্যি সরলার মতো এত সুন্দরী ও লক্ষ্মী মেয়ে হয় না।
দুজনে ঘুরতে বের হলাম। কিছুটা পথ একসঙ্গে হেঁটেছি। হঠাৎ করে কেন জানি মাথাটা ঘুরছে। সরলাকে না বলে পারছি না। তাই বললাম, শরীরটা আমার অসুস্থ হয়ে গেল। দেরি না করে আমাকে নিয়ে বাসায় চলে আসে সরলা।
শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। চোখটা লাল হয়ে গেছে। মাথাব্যথায় অস্থির লাগছে। এমন অবস্থায় সরলা কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। সরলা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
অনেক কষ্টে একটু হেসে বলি, ‘আমার যত রোগ, যত অসুখ, সবই তুচ্ছ হয়ে যায় তোমার ছোঁয়া পেলে।’
এক সাগর পানি সরলার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে। মেয়েটা এতটা ভালোবাসে আমাকে! ওর চোখ মুছে বললাম, ‘প্লিজ লক্ষ্মীটি, আর কেঁদো না। আমি ঠিক আছি তো।’
‘আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। এই সময়ে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া ঠিক হয়নি। মাত্র তুমি সুস্থ হলে।’
‘এত ভেবো না তো। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘তা–ই যেন হয়।’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

চার.
নিঝুম রাত। বস্তিবাসী ঘুমিয়ে পড়েছে। চারপাশ নীরব–নিথর। ঢাকার শহরে এমন নীরবতা খুব কমই হয়। এটাও ভাবছে সরলা। মুহিব ঘুমে মগ্ন। কত সুন্দর দেখাচ্ছে মুহিবকে। যেন একটা নিষ্পাপ শিশু ঘুমাচ্ছে। যে দৃশ্য দেখে সারা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। পুরুষ এতটা সুন্দরও হয়? ইচ্ছা করছে মুহিবকে ডেকে তোলে, জানালার পাশে নিয়ে আসতে। দুজনে মিলেমিশে নীরব ঢাকা শহরের চিত্র দেখবে বলে।
মধ্যরাত্রিতে জানালার একটি পাল্লা খুলে বাইরে দৃষ্টি মেলে সরলা। আজ তার অনেক কিছু ভাবতে ইচ্ছা হচ্ছে। শিশুকালে যে মেয়ের বাবা ইহকাল ত্যাগ করেছে। মজনু চাচার ঘরে মানুষ হলাম। চাচা কত না ভালোবাসত। অথচ চাচির ক্ষেত্রে ছিল পুরোটা উল্টো। চাচির অত্যাচার! জলিল মামার নির্যাতন! আচ্ছা, মানুষ এত নীচু হয় কীভাবে? মামা হয়েও মেয়ের বয়সী ভাগনির দিকে কুদৃষ্টিতে তাকানো। সময়–সুযোগে শরীরে হাত দেওয়া। ছি, ছি...।
জলিল রাবেয়া খাতুনের ছোট ভাই হয়। সেই সূত্রে সরলার মামা হয়। একদিন সরলাকে কিছু লোকের হাতে তুলে দেয় জলিল। বিনিময়ে অনেকগুলো টাকা পায় জলিল ও রাবেয়া। সরলা ঢাকায় চলে আসে। রাত ১১টার সময় শহরের রাস্তায় চারজন গাড়ি দিয়ে যাচ্ছে। সরলা ও সঙ্গে তিনজন অপরিচিত পুরুষ। জীবনের প্রথম ঢাকা শহরে আসে সরলা। তিনজন পুরুষের মধ্যে সরলা বড়ই অসহায়। এর মধ্যে একজন বলছে, ‘মেয়েটি কত সুন্দরী, দেখেছ ওস্তাদ?’
তিনজনের একজন ছিল ওস্তাদ। নাম জমির উদ্দিন। সে বলে, ‘শুধু সুন্দর না পাগলা, ঝাক্কাস মাল।’
সরলা ঘুমের ভান ধরে আছে। আর শুনছে ওদের কথাবার্তা। সরলা বুঝতে পারছে, তাকে ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। সে মনে মনে ফন্দি আঁটে। যেভাবে হোক এদের হাত থেকে পালাতে হবে। তা না হলে তাকে ওরা নির্যাতন করবে। ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। চুপচাপ ওদের কথা শুনছে সরলা। তিনজনের একজন বলছে, ‘ঝাক্কাস মাল না হলে কি তুমি একে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে কিইন্যা আনতা!’
সরলা বিস্মিত। ৫০ পঞ্চাশ হাজার টাকার লোভে তার চাচি সরলাকে বিক্রি করে দিয়েছে। এরই মধ্যে জমির উদ্দিনের ফোন বেজে ওঠে। ফোন রিসিভ করে বলে, ‘নূরজাহান বেগম, পাখি রেডি। এখন আমরা যাত্রাবাড়ীর কাছাকাছি আছি। পাখি ঘুমাচ্ছে। আরও আধা ঘণ্টা লাগবে।’
সরলা বুঝতে পারছে, যা করতে হবে আধা ঘণ্টার মধ্যেই করতে হবে। এরই মধ্যে জ্যামে আটকা পড়েছে। সরলা আস্তে করে বলে, পানি খাবে সে। কিন্তু গাড়িতে পানি নেই। জমির উদ্দিন চিন্তিত হয়ে বলে, ‘হায় আল্লাহ, এখন যদি মেয়েটা চিল্লাচিল্লি করে, তাহলে তো বিপদ!’
একজন বলে, ‘এই যা, পানি নিয়ে আয়।’
সরলা তাকায়। জমির বলে, ‘কোনো কথা বলবে না।’
‘আমি পানি খাব।’
‘ঠিক আছে পানি আসতেছে।’
‘আমি একটু দাঁড়াতে চাই।’
জমির উদ্দিন চোখ বড় বড় করে বলে, ‘চুপচাপ বসে থাক কইতাছি।’
‘আমি তো চুপই আছি। আমি কোনো কথা বলব না। আমারে খালি একটু দাঁড়ানোর সুযোগ দাও। গাড়ি থেকে নেমে একটু দাঁড়িয়ে আবার গাড়ির ভেতরে চলে আসব।’
জমির উদ্দিনের ভয়ে কান লাল হয়ে গেছে। সে আবারও ধমকের স্বরে বলে, ‘চুপ কর মাগি।’
সরলা সাহস করে বলে, ‘এই বেটা, এখনো তো মাগি হই নাই। আগে আমার সঙ্গে কোনো পুরুষ রাত কাটাক, তারপর মাগি ডাকবে।’
জ্যাম লেগেই আছে। গাড়ি চলছে না। জমির উদ্দিন সরলার তেজ দেখে অবাক হচ্ছে। সরলা বলে, ‘জমির ভাই, প্লিজ আমারে একটু দাঁড়ানোর সুযোগ দাও। দেখো, অনেকক্ষণ গাড়িতে বসে আছি। কোমরের ব্যাথায় আর সহ্য করতে পারছি না। নামতে দিবা, নাকি চিল্লাচিল্লি করব?’
সঙ্গের একজন বলে, ‘ওস্তাদ, ওরে দাঁড়ায়বার সুযোগ দাও।’
সরলার ভেতরে–ভেতরে প্রচণ্ড ভয় করছে। তারপরও এই জমির উদ্দিনের উদ্দেশে বলে, ‘জমির ভাই, তোমরা আমারে এত কষ্ট করে আনলা, তারপর নূরজাহান বেগমের হাতে তুলে দিবা! আমার এত সুন্দর শরীরটার দিকে একবার চাইয়া দেখো, জ্বইলা যাবা!’
জমির উদ্দিনের মাথা ঘুরে যায়। সরলার কথা শুনে ভালোভাবে সরলার দিকে তাকায়। আর এমন সময় সরলা দাঁতে ঠোঁট কাটে। চোখটা বাঁকা করে জমির উদ্দিনের দিকে তাকায়। যেন সে পেশাদার একজন দেহ ব্যবসায়ী। এতক্ষণ জমির উদ্দিন সরলার পাশেই বসা ছিল। একবারও সরলতার দিকে লালসার দৃষ্টিতে তাকায়নি। ঠিক সরলার কথা শোনার পর, সরলার গালে হাত রাখে জমির উদ্দিন। এমন সময় সরলার পুরো শরীরে বিদ্যুতের শক লাগে। নিজেকে বাঁচাতে বলে ওঠে, ‘এত তাড়া কিসের? সারা রাত তো বাকিই আছে।’
জমির উদ্দিনের ভেতরে আনন্দের ঢেউ খেলে। সরলাকে গাড়ি থেকে নামতে দেয়। সরলা নেমে বলে, ‘আহ্‌ কী শান্তি!’
জমির উদ্দিন ও সরলা দুজনে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক এমন সময় জ্যাম ছাড়ল। সরলা বলে, ‘জমির ভাই।’
জমির উদ্দিন বলে, ‘এই মেয়ে, ওঠ ওঠ, গাড়িতে ওঠ।’
‘না, এখন উঠব না। একটু পরে উঠব। একটু এদিকে আসো তো।’
‘বল।’
‘এখানে বাথরুম করা যাবে কি?’
‘গাড়িতে ওঠ, একটু সামনে গিয়ে তোকে বাথরুম করাব। এখানে করা যাবে না।’
আসলে সরলা এদিক–সেদিক তাকিয়ে পালানোর রাস্তা খুঁজছে। হঠাৎ তাঁর চোখের সামনে পড়ল পুলিশের গাড়ি। যদিও গাড়িটি অনেকটা দূরে। সরলা দিল এক দৌড়। পেছনে পেছনে জমির উদ্দিনও দৌড় দিল। সরলা দৌড়াচ্ছে। আশপাশের অনেকে তাকিয়ে আছে। এখন আর সরলা কাউকে ভয় পাচ্ছে না। নিজেকে বাঁচাতে হবে। নরকের জীবন সে চায় না। জমির উদ্দিন পুলিশের গাড়ি দেখে আচমকা দাঁড়ায়। সরলা একেবারে পুলিশের গাড়ির কাছাকাছি এসে থেমে যায়। পেছনে জমির উদ্দিনকে দেখা যাচ্ছে না। পুলিশকে কিছু না বলে সরলা অন্য রাস্তায় চলে যায় এবং দেখা পায় মুহিবের।
মুহিব একটি অটোরিকশায় উঠছে, ঠিক সেই সময় কিছু না বলে সরলাও উঠে মুহিবের পাশে বসে। এরপর হয় সরলার নতুন জীবনের সূচনা। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি করে মুহিব। সেই মুহিবের সঙ্গে হয় ভালোবাসা। হয় বিবাহ।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পাঁচ.
সরলার চিঠি এসেছে। মজনু মিয়া সরলার চিঠি পেয়ে খুবই খুশি। আজকে এই পৃথিবীর বুকে জরিপ করলে খুশির তালিকাতে প্রথম নামটা যাঁর থাকবে, তিনি হলেন মজনু মিয়া। ভাতিজির চিঠি পেয়ে তিনি এতটা আনন্দিত।
শ্রদ্ধেয় মজনু কাকা,
আমি তোমার আদরের মেয়ে সরলা বলছি। তুমি কেমন আছ কাকা? তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছা হচ্ছে। ইচ্ছা করে উড়াল দিয়ে তোমার কাছে চলে আসি। আমার কথা চিন্তা কোরো না। আমি ভালো আছি। শহরে আছি। মুহিব নামের একজন ভালো মানুষকে বিয়ে করেছি। সংসারজীবনে অনেক সুখে আছি কাকা। চিন্তা কোরো না, একদিন মুহিবকে নিয়ে তোমাকে দেখতে আসব। আর হ্যাঁ, চাচি কেমন আছে কাকা? চাচিকে বলে দিয়ো, জমির উদ্দিন ও তার দলের লোকেরা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। জমির উদ্দিন আমাকে শহরে নিয়ে এসেছিল বলে ফেরেশতার মতো মানুষ মুহিবের সহধর্মিণী হতে পেরেছি। কখনো কখনো তোমাকে ভেবে একটু কেঁদেও ফেলি। তুমি ভালো থেকো, কাকা।
ইতি
তোমার মেয়ে সরলা মুহিব।
পৃথিবীতে মানুষ এত ভালো হয় কী করে! এত কিছুর পরও চাচি কেমন আছে জানতে চায়।
মজনু মিয়ার শরীরটা অনেকটা সুস্থ লাগছে। তিনি নিজে থেকে সুস্থতা বোধ করছেন। সরলার চিঠিটা নিজের বালিশের নিচে রেখে দেন।

ছয়.
মুহিব এখন পুরোপুরি সুস্থ। তিন দিন ধরে চাকরিও করছে। সরলাকে রেস্তোরাঁয় যেতে বারণ করেছে। সরলাও বলেছে, ‘এই মাসটা শ্যাষ করি। আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন।’
মুহিব সরলাকে বলছে, ‘চলো আজ তোমাকে নিয়ে ঢাকার শহর ঘুরে বেড়াব।’
সরলা মুহিবের কথা শুনে ভীষণ আনন্দিত বটে। কিন্তু প্রকাশ্যে বলল, ‘না, আমি যাব না।’
‘বুঝতে পেরেছি।’
‘কী?’
‘সেদিন ঘুরতে গিয়ে আমার শরীরের অবস্থা খারাপ হয়েছিল বলে আজ তুমি এই সুস্থ মানুষটার সঙ্গে যেতে চাইছ না।’
‘কে বলল?’
‘আমি বলেছি।’
এই বলে মুহিব সরলার আঁচল ধরে টান দেয়। ঠিক তখনই সরলার বুকের ওপর থেকে শাড়ির আঁচল অনেকটা সরে যায়। সরলা বলে ওঠে, ‘এই কী করছ? দুষ্টু কোথাকার!’
মুহিব সরলাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমার বউকে আমি যা ইচ্ছা তাই করব।’
সরলার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। মুহিবের মুখে কত দিন পর এমন কথা শুনল! সেটাই ভাবছে। সরলা বলে, ‘এভাবে বউকে জড়িয়ে ধরে রাখলে ঘুরতে যাবে কখন?’
‘ও তাই তো!’
সরলা ও মুহিব হাঁটছে। সরলা শাড়ি পরেছে আর মুহিবের পরনে আকাশি রঙের পাঞ্জাবি। রাস্তার মাঝে সরলার ইচ্ছা হলো আইসক্রিম খাওয়ার। কিন্তু সে চাইল না। এমন সময় মুহিব বলে, ‘সরলা, আইসক্রিম খাবে?’
সরলা অবাক হয় এবং পাশের দোকান থেকে দুটি আইসক্রিম নিয়ে খেতে খেতে হাঁটতে থাকে দুটি মনের একটি শব্দ—ভালোবাসা।
‘সরলা, ঠিক এই মুহূর্তে তুমি কী চাও?’
‘মানে কী?’
‘তুমি চেয়ে দেখো না।’
‘আমি যা চাই তুমি তা–ই দেবে?’
‘অবশ্যই দেব।’
‘তাহলে একটি নয়, দুটি জিনিস চাইব।’
‘ওকে, মহারানির ইচ্ছা। চাও।’
‘একটা চুমু চাই।’
মুহিব ভুরু কুঁচকে বলে, ‘কী বলছ?’
‘কোনো কথা চলবে না। তুমি বলছ দিবা। এখন দাও..’
‘কী আশ্চর্য! এটা কি কোনো চাওয়ার বিষয় হলো!’
সরলা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে, ‘হুম, প্রথমটাই দিতে পারে না। আবার দ্বিতীয়টা।’
এই বলে একটু সামনে যেতে চাইল। ঠিক তখনই সরলাকে টান দিয়ে কাছে এনে মুহিবের ঠোঁট দুটি সরলার গালে বসিয়ে দেয়।
সরলা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। কেননা মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে এমন কাণ্ড। সরলা নিজেকে সামলে হাসি মুখে বলে, ‘সাহসী ছেলে। ওকে ফাইন। এবার দ্বিতীয়টা চাইব।’
মুহিব বলে, ‘বলো কী চাও?’
‘চলো যায় কিশোরগঞ্জ। মজনু কাকারে অনেক দিন দেখি না। দেখতে খুব মন চাইছে। যাবে?’
‘অবশ্যই যাব। চলো...’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সাত.
মজনু মিয়া মারা গেছেন। দাফনের কাজও শেষ। মুহিব ও সরলা দুজনের কেউ জানে না, মজনু মিয়া আর পৃথিবীর বুকে নেই। অথচ তারা দুজন অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে পথ চলছে। এত আনন্দ কিছুটা সময় পরে ম্লান হয়ে যাবে। অথচ ওরা তা জানে না। এটাই প্রকৃতির খেলা। মুহিব খুশি সরলার খুশিতে। তেমনি সরলাও খুশি মুহিবের খুশিতে। সরলার জীবনে মুহিবের একটু ভালোবাসাই অমূল্য রত্ন।
লেখক: এম হৃদয়, ক্যাশিও গ্রিন, সিঙ্গাপুর