এনজাইম

১১ ডিসেম্বর, ২০১৯। কোভিড-১৯, এর উপস্থিতি তখনো বিশ্বকে ভাবাতে শুরু করেনি। ওয়াশিংটন ডিসির কনভেনশন সেন্টার, রুম নম্বর ৪৩৫৪ সাউথে ক্যানসার বায়োলজির (Cancer Biology) বিশেষ সেশন চলছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে গবেষক এবং বিজ্ঞানীরা একত্র হয়েছেন।

ড. মৌমিতা আফসানা আফটারনুন–এর টি ব্রেকের পরে ওই কক্ষে একটু ঢুঁ মারল। যদিও আজকে তার কোনো প্রেজেন্টেশন নেই। ঢুকেই অবাক! পুরোপুরি ভরা, বসার কোনো জায়গা নেই! একদম পেছনের সারির ঠিক আগের বাঁ দিকের কর্নারে ওই তো একটা জায়গা খালি দেখা যাচ্ছে।

ইতিমধ্যে কানে বাজল প্রথম প্রেজেন্টারের নাম। ড. সামিন মাহমুদ, ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার, বলবেন ‘Cancer Cells and Enzymes’ এই বিষয়ে। মৌমিতা তার জায়গাটিতে বসে সামনে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। দুচোখ আটকে আছে প্রেজেন্টারের দিকে। উনি কি সেই ‘সামিন মাহমুদ’? যিনি নিজেই একজন জলজ্যান্ত এনজাইম। ড. মৌমিতা আফসানার জীবনের একজন অন্যতম প্রভাবক!

মাথার মধ্যে কে যেন বলে যাচ্ছে, ‘এনজাইম (enzyme) একধরনের প্রোটিন, যা সেলের জন্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করে, যে তার নিজস্ব রূপ পরিবর্তন করে না, শুধু সুনির্দিষ্ট সিগন্যাল গ্রহণ করে রাসায়নিক বিক্রিয়া কাজে সাহায্য করে। আর যদি এনজাইম তার কাজের নিমন্ত্রণ হারায় তবে তা নরমাল সেলের জন্য ক্ষতিকর; বিভিন্ন ধরনের এনজাইমের কার্যকারিতা ব্যবহার করে ক্যানসার সেলকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়’।

মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘আমরা মানুষেরা কি একই রূপে এনজাইম না? আমাদের ভালো কাজ দিয়ে অন্যকে প্রভাবিত করি আবার যখন নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তখন কী করি? আজ এই মুহূর্তে কেন এসব ভাবনা তাকে বিচলিত করছে?

অধ্যাপক সামিন মাহমুদ বলে যাচ্ছেন, ‘how we can use systematic enzymes for cancer treatment…।’ মৌমিতা যতই মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করতে থাকুক তার দুচোখ প্রেজেন্টেশনের স্লাইড পেরিয়ে কখন কোথায় যে নির্গমন করে গেছে, তা রুমভর্তি মানুষের বোধগম্য হওয়ার কথা নয়। অধ্যাপক সামিন মাহমুদের রিসার্চ জানার চেয়ে ব্যক্তি সামিন কীভাবে তার জীবনে এনজাইম হয়ে এসেছিল, তা চিন্তা করতে করতে মৌমিতা কোথায় যেন হারিয়ে গেল!

১৯ বছর আগে, সময়টা নভেম্বরের মাঝামাঝি। মাস্টার্সের রিসার্চ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত! সকালে যেতে হয় বারডেমে, সেখানে কাজ শেষে যেতে হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (CMH)। কাজের মাধ্যমেই একদিন পরিচয় হয় খুবই চুপচাপ স্বভাবের একজন মানুষের সঙ্গে। কম কথা বললেও এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপারে সব রকম সাহায্য করত। বয়সে ৩-৪ বছরের বড় বিধায় মৌমিতা সামিন ভাই বলে ডাকত, যার কাছেই তার ফ্লোরোসেন্স মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করার প্রথম হাতেখড়ি।
বিশেষ দিন! বারডেমে কাজ শেষ করে ক্যান্টনমেন্ট আসতে প্রায় দুপুর শেষ হয়ে গেল। সামিন ভাইকে এত দেরি হওয়ার পরেও দেখতে পেয়ে মৌমিতা মহা খুশি! ‘ও আপনি এখনো আছেন? আমার কিছু নতুন স্লাইড দেখতে হবে। আপনার সাহায্য ছাড়া এগুলো দেখা সম্ভব না।’ সেদিন আগে চলে যাওয়ার কথা থাকলেও কী কারণে যেন তিনি থেকে গেলেন। মৌমিতা প্রয়োজন ছাড়া কারও চোখের দিকে অকারণে সরাসরি তাকায় না। কিন্তু সেদিন সে তাকিয়ে খুব সহজে যেন স্পষ্ট পড়তে পেরেছিল সামিন ভাইয়ের চোখের ভাষা, ‘তোমার অপেক্ষায় ছিলাম, মৌমিতা!’

যে ল্যাবে তাঁরা দুজনে কাজ করতেন, সেটা ছিল একটা অদ্ভুত জায়গায়। ঢাকা সিএমএইচের প্যাথলজি বিভাগের মেইন অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন। প্রধান ল্যাবের অংশ ছাড়িয়ে একটু ভেতরে একটা ছোট রুম। কোনো দরজা–জানালা নেই। ওই জায়গায় কাজ করলে বোঝার কোনো উপায় নেই যে বাইরের জগতে কী ঘটছে। ওখান থেকে বের হওয়ার জায়গা শুধু একটিই। ল্যাবের ছোট রুম দিয়ে বের হয়ে আরেকটা বড় রুম, তারপর আরেকটি রুমের পরে মেইন গেট দিয়ে বাইরে যাওয়ার পথ। খুবই নীরব! ভুতুড়ে পরিবেশ। অনুমতি ছাড়া ঢোকা নিষেধ। ফ্লোরোসেন্স মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করতে হয় বিধায় রুমটিকে সব সময় অন্ধকার রাখতে হয়। ভয় না পাওয়ার কোনো কারণই নেই সেখানে!

সামিন ভাইয়ের সাহায্য ছাড়া কাজ করা সম্ভব নয়, কারণ তখনো একা একা মাইক্রোস্কোপ ব্যবহারের অনুমতি মৌমিতা পায়নি। কাজ করতে গিয়ে কখন যে সেদিন সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত এল, খেয়ালই ছিল না! যখন খেয়াল হলো তখন দেখে সবাই চলে গেছে, বাইরে থেকে দরজা বন্ধ।

যোগ হলো আরেক সমস্যা! সে সময়ের পরিস্থিতি ছিল অন্য রকম; গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য আন্দোলন! ধর্মঘট, গাড়ি পোড়ানো প্রায় প্রতিদিনই লেগেই আছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির এক ছাত্র গুলি খেয়েছে, ইউনিভার্সিটি এলাকা পুলিশ দিয়ে ঘেরাও। কারফিউ শুরু হয়ে গেছে, কোনো উপায় নেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে হাতিরপুল পর্যন্ত যাওয়ার। সেল ফোনের ব্যবহার তখনো মানুষ শুরু করেনি। ল্যান্ড লাইনে ফোন করে বাসায় যোগাযোগ করার উপায় নেই। মেইন অফিস বন্ধ।

এই রাতের পরিণতি কী হতে পারে? মা-বাবা কী চিন্তায় অস্থির হচ্ছে? আজ রাত কি তাহলে এই অন্ধকারের ভুতুড়ে পরিবেশে সামিন নামের এই বাক্যহীন মানুষটির সঙ্গে থাকতে হবে? অস্থিরতা কেবল বাড়তেই লাগল নিজের অবস্থার কথা ভেবে। ‘কী করে সামাল দেব আজ রাতটা। পিরিয়ড যে চলছে। পিরিয়ডেরও সেকেন্ড ডে, অনেক বেশি ফ্লো হচ্ছে। সঙ্গে আছে শুধু একটি প্যাড। ওইটা দিয়ে কি রাত পার করা যাবে? দরজা বন্ধ, বাথরুমে যাওয়ার কী উপায় হবে? আজ কেমন করে নিজেকে রক্ষা করবে সে?’
মনে পড়ে যায় ১২ বছর বয়সের সেই দিনের কথা। যখন প্রথম পিরিয়ড হয়েছিল, সে তেমন কিছু বুঝত না। বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিল কিন্তু সে ছিল না। খালি বাসায় তার আপন চাচা আদর করে ভেতরে নিয়ে বসায়। এর পরের ঘটনা আর মনে করতে চায় না...যে কথা সে এখন পর্যন্তও কাউকে বলতে পারিনি। সে চাচাও তো চুপচাপ ধরনের ভদ্রলোক ছিলেন। আজ কি আবার সে রকম কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে?
অনার্স প্রথম বর্ষ থেকে হিজাব পরে মৌমিতা। নিজেকে খুব সংযত আর পরিশীলিতভাবে রেখে চলার চেষ্টা করে। ছেলেদের সঙ্গে প্রয়োজন ব্যতীত তেমন কথা বলা হয় না। মা-বাবা জানে যে কোনো ছেলের সঙ্গে মৌমিতার সখ্য গড়ে ওঠেনি, তাই পরিবারের পক্ষ থেকে তার জন্য বিয়ের পাত্র দেখা হচ্ছে। আগামী সপ্তাহে ছেলেপক্ষ তাকে দেখতে আসার কথা। মনে সংশয়, ‘আজকের রাত কি তার পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করবে?’

মৌমিতা চিন্তিত! ‘যদিওবা খুব কম কথা বলে, তবুও যদি ভুল না হয়, সামিন মাহমুদের চোখে যা, সে তা দেখেছে তা খুবই স্বচ্ছ। নিশ্চয়ই এমন কিছু ঘটবে না যা হবে অসম্মানজনক।’ তারপরও মনে দ্বিধা, সংশয়? ১২ বছর বয়সে তাকে জীবনের যে পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছিল, আজও কি সৃষ্টিকর্তা তাকে এমন কিছু দেখাবেন?
সামিন মাহমুদ নিজেও বিচলিত ছিলেন, হঠাৎ বললেন, ‘তুমি মনে হয় খুব ভয় পাচ্ছ। ভয়ের কিছু নেই, একটা ব্যবস্থা হবে, ইনশা আল্লাহ।’ এই পরিস্থিতিতে পিরিয়ডের কথা বলতে বাধ্য হলাম। তিনি বললেন, ‘চিন্তা কোরো না, দেখি কী করা যায়।’

হাঁ, সেদিন একটি ব্যবস্থা হয়েছিল। ওড়না আর সামিন মাহমুদের জ্যাকেট মিলিয়ে শরীরে ঢেকে রাখার জন্য মৌমিতা প্রটেকশন পেয়েছিল, যাতে সে পুরোপুরি রক্তে ভিজে না যায়। সে রাতে প্রকৃতি কোনো এক পরিস্থিতিতে দুটি মানব-মানবীকে একসঙ্গে করেছিল। দুজনের প্রতি দুজনের আস্থা তাদের হৃদয়কে ছুঁয়েছিল কিন্তু কোনোরূপ অসম্মান তাদের স্পর্শ করেনি।

সামিন মাহমুদ একজন এনজাইম ছাড়া আর কী? এনজাইম যেমন সময়মতো সিগন্যাল গ্রহণ করে সেলের জন্য যথার্থ কাজটি করে থাকে, ঠিক তেমনি তিনি তাই করেছিলেন। কোনো কোনো মানুষের কাজ তো এনজাইময়ের মতোই। যে পরিস্থিতিতে যেমনই থাকুক না কেন, রূপ বদলায় না, কাজ করে যায় মানুষের জন্য। আর মানুষ যখন এনজাইমের মতো হতে পারে না, তখনই সে তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তাই যেখানে জন্ম হয় লোভ।

মৌমিতা একদিন দেখেছিল মানুষের চোখের লোভ আর সে রাতে অন্ধকার একটি ঘরের ভেতর দেখতে পারল লোভের বিপরীত কিছু থাকে, যা মানুষ ধারণ করতে পারে। এ ধরনের মানুষ আছে বলেই হয়তো অনেক কদর্যের মাঝেও পৃথিবীতে বেঁচে থাকে কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা। বেঁচে থাকে মানুষের বিশ্বাস, আস্থা আর চিরন্তন প্রেম!

নিজস্ব অনুভূতির কথা কোনো দিন সামিন মাহমুদকে বলার সুযোগ হয়নি। জানা নেই তিনি আর কখনো ওই ল্যাবে মৌমিতার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন কি না। মৌমিতার বিয়ে হয়ে যায় মুবিন হাসান নামে অচেনা একজনের সঙ্গে। শোনা যায় কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে সামিন মাহমুদ চলে যায় যুক্তরাজ্যে, আর মৌমিতা স্বামীর সঙ্গে চলে আসে যুক্তরাষ্ট্রে।

অনেকটা সময় সময় চলে গেছে, দুজনেই পিএইচডি শেষ করে এখন ক্যানসার রিসার্চের সঙ্গে যুক্ত। মৌমিতার খুব দেখতে ইচ্ছা হয় ১৯ বছর আগে সামিন ভাইয়ের চোখে যে অপেক্ষার ভাষা সে পড়তে পেরেছিল, আজ তাকে দেখলে সেই চোখ কি কথা বলবে?

হঠাৎ যেন ঘোর ভাঙল, দেখে নিল টেক্সট ‘please call me when you are available’. কনফারেন্সে রুম থেকে বের হয়ে ফোন করতেই, ওপাশ থেকে মুবিনের কণ্ঠস্বর ‘সব ঠিক আছে তোমার? বাচ্চারা ভালো আছে, চিন্তা কোরো না। একটু আগেই রওনা হয়ে যাও, না হলে ডিসির ট্রাফিকে আটকে থাকলে রাত ৯টার ফ্লাইট ধরতে পারবে না। তোমার অপেক্ষায় থাকলাম।’

হাতে বেশি সময় নেই, হাইওয়ের যানজট পার হয়ে সময়মতো এয়ারপোর্টে পোঁছাতে হবে। হয়তো হঠাৎ সামিন মাহমুদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়ে যেতে পারে আরেকটি কনফারেন্সে! দেরি না করে মৌমিতা ছুটে চলছে সিয়াটলের ফ্লাইট ধরতে।

*লেখক: ড. ফারহানা রুনা, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র