‘এনোলা হোমস’ কেন প্রাসঙ্গিক

মা অশ্রুসিক্ত চোখে জড়িয়ে ধরে আছে মেয়েকে, বলছে, ‘আমি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বদলে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে পথ বিপৎসংকুল, তাই তোমাকে সঙ্গে নিতে পারিনি, কিন্তু তুমিই বদলে দিয়েছ পৃথিবী।’ পরবর্তী সময়ে দেখা যায় অনিন্দ্যসুন্দরী কিশোরী দৃপ্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে আর তার কথা বলে যাচ্ছে, ‘আমাদের হাতেই ভবিষ্যৎ’, হ্যাঁ, এই শিক্ষাই তার মা তাকে দিয়েছিল।

সেই ভিক্টোরীয় যুগ থেকে আজও মায়েরা চেয়েছেন সন্তানদের জন্য ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে সুন্দর করে যেতে। বিশেষ করে মেয়েসন্তানদের জন্য মায়েদের এই আকুতি বোধহয় তীব্র। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসেও কতটুকু পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে! তবুও চেষ্টা তো থেমে নেই। তাই আজকের দিনেও তখনকার প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই সিনেমার গুরুত্ব অপরিসীম। যেন আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া, আবার হাল ধরতে শেখানো, সাহস জোগানো।

‘Enola Holmes’ মুভিটার কথা বলছিলাম, প্রথম অংশটুকু দেখে মনে হয়েছিল শার্লক হোমসের বোনের জীবনকাহিনি। হ্যাঁ, জীবনকাহিনিই বটে, তবে তা তার জীবনকে ছাপিয়ে আপামর মেয়েদের জন্য দিচ্ছে বিশেষ বার্তা। প্রচণ্ড মেধাবী, দারুণ পর্যবেক্ষণক্ষমতা, সূক্ষ্ম বিচার–বুদ্ধিসম্পন্ন এক কিশোরীকে দেখানো হয়েছে এই ছবিতে। ছবির শুরু হয়েছে তার ১৬তম জন্মদিনের এক সকাল থেকে, যখন এনোলা ঘুম ভেঙে দেখে তার মা তার জন্য জন্মদিনের কিছু উপহার রেখে দিয়ে কোথায় যেন চলে গেছেন! মাকে খুঁজে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে এনোলা। এরপর পুরো মুভিতে নানা ঘটনার ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় কীভাবে এনোলার মা তাকে বড় করে তুলেছেন, যা ছিল তখনকার স্বাভাবিকতার বিপরীত। এনোলা তার মাকে খুঁজে পেতে সাহায্য চায় তার বড় দুই ভাইয়ের, যাদের সঙ্গে দীর্ঘ বিরতির কারণে ওর কোনো যোগাযোগই ছিল না। শার্লক হোমস ওর বোনের বুদ্ধিমত্তা দেখে মুগ্ধ হয়, অন্যদিকে সবার বড় ভাই মাইক্রফট হন বিরক্ত! এনোলার মায়ের অনুপস্থিতিতে মাইক্রফট ওর অভিভাবকের দায়িত্ব পায় এবং ডিসিশন নেয়, ওকে ‘ফিনিশিং স্কুল’–এ ভর্তি করে দেবে।

ফিনিশিং স্কুল হচ্ছে তখনকার প্রচলিত একধরনের স্কুল, যেখানে মূলত অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল পরিবারের মেয়েরা তৈরি হয় সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য আচার–আচরণ শিখে ভালো হাজবেন্ড পাওয়ার জন্য। এককথায় বলা যায়, ভালো বিয়ের জন্য প্রস্তুত করা হয় সেসব স্কুলে। কিন্তু এনোলার তীব্র আপত্তি সেই স্কুলে যাওয়ার।

এরপর শুরু হয় এনোলার অভিযান, ছেলে সেজে বাড়ি থেকে পালায় সে, ট্রেনে দেখা হয় ইংল্যান্ডের সম্ভ্রান্ত, গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা এক যুবকের সঙ্গে, সে–ও পালাচ্ছে। ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেওয়ার দৃশ্য দেখে মনে হবে, এই বুঝি শুরু হলো রোমান্টিক প্রেমের কাহিনি! কিন্তু না, এনোলা তার সংকল্পে দৃঢ় থাকে, বিদায় নেয় ওই যুবকের কাছ থেকে।

এরপর আবার ছদ্মবেশ, নানা অভিযান! পরবর্তী দৃশ্যগুলোতে টান টান উত্তেজনা আর কাহিনির জট খোলা ধীরে ধীরে। এনোলার আবার দেখা হয়, ট্যুইকসবারি নামের সেই যুবকের সঙ্গে। এনোলা সিদ্ধান্ত নেয়, মায়ের উদ্ধার অভিজান স্থগিত করে ওই বোকা যুবকটিকে সাহায্য করার। তবে কি প্রেমে পরে এনোলা তার লক্ষ্য থেকে দূরে সরে এল! এ ছাড়া শার্লক হোমসও তার মাকে খুঁজছে।

ছবিতে ভিক্টোরীয় যুগের নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনকে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা সেই সময় একজাতীয় আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। রয়েছে রিফর্ম বিল নিয়ে চমকপ্রদ কাহিনি। যা দর্শককে নারীদের ভোটাধিকারের ইতিহাস জানতে আগ্রহী করে তুলবে। প্রশ্ন জাগবে, ট্যুইকসবারি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ! কেনইবা তার বাবাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল, তার প্রাণও বিপন্ন! কে সেই হত্যাকারী! অত্যন্ত বেদনাদায়ক হচ্ছে, আদি ধ্যানধারণায় নিমজ্জিত প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়াশীল এক চরিত্রে দেখা যাবে একজন নারীকে এই মুভিতে।

এই চিরাচরিত নেগেটিভ দৃশ্যের পাশাপাশিই দেখানো হয়েছে কী করে সত্যিকারের পরিবর্তন সম্ভব। এনোলার মায়ের তাকে বড় করে তোলার নানা দৃশ্যে প্রকাশিত সেগুলো। এত সব কিছুর মধ্যে এনোলা কি খুঁজে পাবে ওর মায়ের হারিয়ে যাওয়ার রহস্য! যাদের বিভিন্ন বোর্ড গেম বা কোডিংয়ে আগ্রহ আছে, তারা মজা পাবে এনোলার মায়ের কাছ থেকে শেখা বোর্ড গেম আর কোডিংয়ের দৃশ্যগুলো দেখে। সংবাদপত্রে সে খুঁজে ফেরে তার মা তাকে কোনো কোড মেসেজ পাঠিয়েছে কি না, সেই সঙ্গে এনোলা তাকে মেসেজ পাঠাতে থাকে।

এত ভালোবেসে বড় করে তোলা এনোলাকে কেন কিছু না বলে চলে গেল তার মা, এই প্রশ্ন ঘুরতে থাকে ছবিজুড়ে। একপর্যায়ে এনোলার মা এসে অভিনন্দন জানায় এনোলাকে, বলে সত্যিকারের স্বাধীনতা সে পেয়েছে। দেখা যায়, শুরুতে বলা, মা মেয়ের সেই অপরূপ মিলন দৃশ্য। এরপর শুরু হয় এনোলার স্বাধীন জীবনের নতুন যাত্রা।

কিন্তু এনোলার মায়ের অন্তর্ধান রহস্য কী! কেন তার চরিত্র এত রহস্যময়! কীভাবে তিনি এনোলাকে বড় করে তুলেছিলেন, কেনই বা তখনকার চিরাচরিত মেয়েবেলা থেকে তার বেড়ে ওঠা আলাদা! কে সেই প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র! ট্যুইকসবারির সঙ্গে এনোলার সম্পর্কের গতি কোন দিকে যাচ্ছে! শেষ পর্যন্ত এর পরিণতি কী হবে! কীভাবে এই যুগে এসেও এই মুভি প্রাসঙ্গিক! এ রকম নানা প্রশ্নের উত্তর পেতে আর এনোলার দারুণ সব রোমাঞ্চকর অভিযান দেখতে শেষ পর্যন্ত অপলক তাকিয়ে থাকতে হবে ছবিতে।

এনোলা চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন মাত্র ১৬ বছর বয়সের মিলি ববি ব্রাউন নামের মেয়েটি, সেই শিশু বয়স থেকেই অভিনয় জগতে যার দীপ্ত পদচারণা। সে এই ছবির প্রযোজকও। ন্যানসি স্প্রিংগারের ‘দ্য এনোলা হোমস মিসটেরিস’ বই থেকে এই গল্পের অনুপ্রেরণা। হ্যারি ব্র্যাডবিয়ারের পরিচালনায় ২০২০ সালের চমৎকার এক ছবি ‘এনোলা হোমস’।