এবারও মুগ্ধ হয়ে টেনিস উপভোগ করেছি

নাদাল
ছবি: রয়টার্স

হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল মোমেন্ট, হোয়াট আ লাভলি এক্সাইটমেন্ট অ্যান্ড হোয়াট আ বিউটিফুল ফিলিং। খেলাধুলার জগত বেশ ভিন্ন যদি রাজনীতির সঙ্গে তুলনা করি। কেউই এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করবেন না, এ কারণেই যে দুটো ভিন্নধর্মী কর্মকাণ্ড। ভিন্ন হলেও একটি জায়গায় রয়েছে এই দুই ভিন্ন কর্মকাণ্ডের মিল, সেটা হলো প্রতিযোগিতা। আমি এই প্রতিযোগিতার ওপর আলোচনা করব। তার আগে খেলাধুলা, বিশেষ করে টেনিসের ওপর কিছু বর্ণনা দিই।

আমার ছেলে ও মেয়ে টেনিস খেলে। তাদের খেলার শুরুতে ছিল আনন্দ, পরে আনন্দ থেকে রান, মানে সেটা হয়ে ওঠে প্রতিযোগিতামূলক। এখন সেটা হয়েছে এলিট স্পোর্টস, বিশেষ করে জোনাথনের ক্ষেত্রে। জেসিকা আপাতত এলিট টেনিস ছেড়ে কলেজ শেষ করছে। একই সঙ্গে নিয়মিতভাবে কিছুটা চর্চাও করছে।

অস্ট্রেলিয়ার ওপেন গ্র্যান্ড স্লামের ফাইনাল খেলা শেষ হয়েছে কয়েক দিন আগে। মেয়েদের ফাইনালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাডিকে হারিয়ে তিন সেটের এই খেলায় প্রথম দুই সেট জিতেই ট্রফি নিশ্চিত করেন জাপানি তরুণী নাওমি ওসাকা। অন্যদিকে ছেলেদের ফাইনালে দানিল মেদভেদেভকে মাত্র ১ ঘণ্টা ৫৩ মিনিটে ৭-৫, ৬-২, ৬-২ গেমে বিধ্বস্ত করেছেন জোকোভিচ। বিশ্বের এক নম্বর ওয়ান নোভাক জোকোভিচ রাশান মেদভেদেভকে পরাজিত করে মেলবোর্ন টেনিস পার্ক থেকে এ পর্যন্ত ৯ বার এই ট্রফি জিতলেন। অন্যান্য খেলার মতো এখানেও রয়েছে সিনিয়র এবং জুনিয়রের সমন্বয়, রয়েছে পুশ অ্যান্ড পুল কনসেপ্ট। সে আবার কী? জুনিয়ররা পুশ করছেন ভালো খেলার মাধ্যমে সিনিয়রদের পরাজিত করতে অথবা নিজেরাই পরাজিত হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। ফলে সবাই সারাক্ষণ গুড টু বেটার হওয়ার চেষ্টায় লেগে আছেন খেলার জগতে টিকে থাকার তাগিদে। এখানে প্রতিযোগিতা এত বেশি যে সামান্যতম ভুল, ভয় বা মনোযোগের ঘাটতি দেখা দিলেই প্রতিপক্ষ জয়ের জায়গাটি নিজের দখলে নিয়ে যান। এ যাত্রায় দ্বৈরথে বন্ধু ফেদেরারকে টপকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল নাদালের।

রজার ফেদেরার ও রাফায়েল নাদাল—টেনিসের দুই কিংবদন্তি
ছবি: টেনিসহেড টুইটার

এই সুইস কিংবদন্তির রেকর্ড ২০টি গ্র্যান্ড স্লামে ভাগ তো গত ফ্রেঞ্চ ওপেনেই বসিয়েছেন নাদাল, এবার অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে সুযোগ ছিল ফেদেরারকে ছাপিয়ে উন্মুক্ত যুগে ছেলেদের এককে সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্লাম জয়ের রেকর্ড গড়ার।
সেই চাপেই কি ভেঙে পড়লেন নাদাল? ক্যারিয়ারে এর আগে তেতো স্বাদ মাত্র দুবার পেয়েছিলেন, সেটিই আজ আবার পেলেন স্প্যানিশ টেনিস কিংবদন্তি। দুই সেটে এগিয়ে গিয়েও গ্রিসের স্তেফানোস সিৎসিপাসের কাছে নাদাল হেরে গেছেন ৬-৩, ৬-২, ৬-৭ (৪/৭), ৪-৬, ৫-৭ গেমে। নাদালের যে আশা ছিল, এবারের ট্রফি জিতে রজার ফেদেরারকে ছাড়িয়ে নতুন বিশ্ব রেকর্ড করবেন, তা কিন্তু হলো না। কোয়ার্টার ফাইনালেই শেষ হয়ে গেল নাদালের ২০২১ অস্ট্রেলিয়ান ওপেন অভিযান।অন্যদিকে গ্রিসের স্তেফানোস সিৎসিপাস সেমিফাইনালের জায়গাটি দখল করে নিলেন।

এবারের অস্ট্রেলিয়ান ওপেন খেলায় সবাইকে তাক লাগিয়েছেন রাশান তারকা দানিল মেদভেদেভ। কোনোরকম সেট লুজ না করেই ফাইনালে উপনীত হয়েছেন তিনি। পরে ফাইনালে একটি সেটও জিততে পারেননি, তবে খেলার পুরো সময়ই এমনভাবে চাপের ওপর রেখেছেন নোভাককে যে কোনোরকম মনোযোগ হারালেই পরাজয় অনিবার্য। খেলাধুলায় শর্টকাট বা কারচুপি বলে কিছু নেই। খেলাধুলায় দ্য উইনার টেকস ইট অল এবং দ্বিতীয় স্থানটি পরাজিতের জন্যে। এ সত্ত্বেও শত ভাগ প্রতিযোগিতার মধ্যে এর সমাপ্তি ঘটে এবং সেটা ফেয়ার প্লে হয়ে থাকে। শতভাগ উদ্দীপনা ও একাগ্রতা রয়েছে খেলোয়াড়দের পারফরমেন্সে। পুরস্কার নেওয়ার সময় বিশ্ব মঞ্চে দাঁড়িয়ে পরাজিত হয়েও দারুণভাবে বিপক্ষের পারফরমেন্সের প্রশংসা করার মতো মন-মানসিকতা শুধু খেলাধুলার জগতে খেলোয়াড়দের মধ্যে লক্ষণীয়। পরাজয় বরণ করার মতো হিম্মত গড়তে দরকার শত ভাগ অর্জন ও বিসর্জনের মানসিকতা। এটা শুধু সম্ভব তখনই, যখন কেউ শতভাগ উৎসর্গ করেন এবং চেষ্টা করেন। ফলাফল যা–ই হোক না কেন, সব সময় ডু হিজ/হার বেস্ট।

ইউরোস্পোর্টসের ধারাভাষ্যকার বারবারা সেট যখন ম্যাটস উইল্যান্ডারকে জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর সময় কি তাঁরা মঞ্চে একই ধরনের আচরণ দেখিয়েছেন? যেমন বিজর্ন বোর্গ বা স্টেফান এডবার্গ যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে পুরস্কার নিয়েছেন, তখন কি তাঁরাও আজকের মতো সুন্দরভাবে একে অপরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন? উত্তরে ম্যাটস বললেন, না, তাড়াহুড়া করে চেকটা নিয়ে কীভাবে সরতে হবে, সেটাই ছিল তখন মুখ্য। বর্তমান খেলাধুলায় পারফরমেন্সের সঙ্গে পেশাদারত্ব, বাণিজ্য এবং বিনয় যুক্ত হয়েছে। ফলে এলিট স্পোর্টসের তারকারা বিশ্বের সেরা অবস্থানগুলো দখল করে আছেন ব্র্যান্ড নাম হিসেবে।

রাজনীতিও কিন্তু প্রতিযোগিতার মঞ্চ এবং খেলাধুলার মতো সম্মানজনক হওয়ার কথা। দুঃখের বিষয়, সেটা হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টা। প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঠকানো, দুর্নীতি, কারচুপি বা ভোট চুরির মধ্য দিয়ে বা প্রতিদ্বন্দ্বীকে জেলহাজতে ঢুকিয়ে জেতার মনোভাব সভ্য সমাজকে কলুষিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। ফলে বিশ্বের মানুষের নৈতিকতার অবক্ষয় হয়ে চলছে। অথচ খেলাধুলার মতোই কিন্তু রাজনীতিরও জয়-পরাজয় হওয়ার কথা। জনগণের ভালোবাসা একজন সচেতন ও ন্যায়নিষ্ঠ রাজনীতিবিদকে করে তোলে নায়ক। কিন্তু সেটা আমরা খুব কম সময়ই দেখতে পাই আমাদের সমাজে। আমার মনে হয়, বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও খেলাধুলার প্রতি জোর দেওয়া দরকার। তাহলে আর কিছু না হোক; শৃঙ্খলা, ন্যায়নিষ্ঠা এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে জয়লাভের মনোভাব গড়ে উঠবে নাগরিকের মধ্যে। সোনার বাংলা গড়তে খেলাধুলারও দরকার রয়েছে। কারণ, খেলাধুলার মধ্যে জয়-পরাজয়ের ধ্বনি শোনা যায় হৃদয়ের মধ্যে। স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য এবং মানসিক বিকাশে খেলাধুলার গুরুত্ব অপরিসীম।

খেলোয়াড়দের কাছে সারা দেশবাসী পরিবারের একজন হয়ে ওঠে। খেলোয়াড়দের মনে শৃঙ্খলাবোধ জন্মায়। খেলাধুলা করলে একাগ্রতা বৃদ্ধি পায়। যেকোনো কাজে মন বসানো সহজ হয়, অশুভ চিন্তা দূর হয়। খেলাধুলা মনে অনুপ্ররণা ও উদ্দীপনা জোগায়। খেলাধুলা যেমন নির্মল আনন্দ দেয়, তেমনি জীবনকে উপভোগ্য করে তোলে। খেলাধুলা মানুষকে বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে। পারস্পরিক তিক্ততা দূর করে মনে প্রশান্তি এনে দেয়।

লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন