ওড়না: দ্য কভার—একটি সাহসী পরিবেশনা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘সিজন অব বাংলা ড্রামা’ নামক প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে নভেম্বর মাসজুড়ে লন্ডনে চলছে ফ্রিডম অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্স থিয়েটার। এ আয়োজনের অংশ হিসেবে ১৩ নভেম্বর টাওয়ার হ্যামলেটসের ব্র্যাডি আর্টস সেন্টারে পরিবেশিত হলো ম্যানচেস্টারের ‘আয়না আর্টস’ নামক থিয়েটার দলের মঞ্চনাটক ‘ওড়না—The Cover.’

ওড়না, একটুকরা কাপড়। পোশাকের একটি অংশ। অন্যান্য পোশাকের মতোই ওড়নার কাজ হচ্ছে মানুষের শরীর ঢেকে রাখা। বিশেষ কিছু উৎসবে ছেলেরাও ওড়না বুকে ঝুলিয়ে রাখে উত্তরীয় হিসেবে, যদিও ওড়না মূলত মেয়েদের পোশাক। এই নাটকে ওড়না ব্যবহৃত হয়েছে একটা প্রতীক হিসেবে। ওড়না এখানে মেয়েদের সম্ভ্রম রক্ষাকারীর প্রতীক। ওড়নার ওপর অর্পিত এই গুরুদায়িত্ব সে ঠিকমতো পালন করতে পারছে কি না, সেটাই এই নাটকের মূল আলোচ্য বিষয়।

নাটকটি শুরু হয় একটি গান দিয়ে, ‘কলিকালের বালিকারা সাইজা গুইজা বাইরে যায়/ প্রেমিকেরা চাইতে গিয়া শুকনা পথে পিছলা খায়।’ বালিকাদের সাজগোজের কারণে সমাজে পুরুষের কী কী বিপত্তি ঘটে যায়, তার কিছু বিবরণ আছে এই গানে। গানটি গাওয়া হয়েছে ফুর্তির ঢঙে কিন্তু মূলত মেয়েদের অপমান করেই বলা হয় এমন সব কথা। গান শেষ হলে স্টেজে ওড়নাদের মধ্যকার কথোপকথন শোনা যায়। একটি ওড়না যদি কথা বলতে পারত, তাহলে সে কী বলত, সেসব কথাই দর্শক শুনতে পায় এখানে। একটি ওড়না ড্রেনে পড়ে গিয়েছে। অন্য ওড়নারা তাকে তুলতে এলে সে প্রতিবাদ করে। ওড়নাটি ড্রেনেই পড়ে থাকতে চায়। দুঃখ করে বলে, একটি মেয়ের বুকের ওপর আবরণ হয়ে থেকেও সে মেয়েটির সম্ভ্রম বাঁচাতে পারেনি, তাই সে আর সমাজে ফিরে যেতে চায় না। তার জন্য নর্দমাই ভালো। তারপর ওড়নাটি কাহিনি বলতে শুরু করে, কীভাবে সে এই নর্দমায় এল।

নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইলা মুহাইমিন। সদ্য যুবতী হয়ে ওঠা মেয়েটি একটি ওড়না উপহার হিসেবে পেয়েছিল তার স্নেহবান বাবার কাছ থেকে, যে বাবা মনে করতেন, শুধু পর্দা করলেই মেয়েরা নির্যাতন–নিপীড়ন থেকে বেঁচে থাকতে পারবে। মেয়েটি রুপালি জরি আর নীল–সাদা সুতায় বোনা ওড়নাটিকে খুব ভালোবেসে ফেলে। ওড়নাটি হয়ে ওঠে তার সব সময়ের সঙ্গী। রিকশায় করে কলেজে যাওয়ার সময় একদিন রিকশার চাকায় ওড়নার প্রান্ত জড়িয়ে মেয়েটির মরণদশা হলো, তবু ওড়নাটা ছাড়ল না সে। উল্টে পড়ে গেল মাটিতে। চারপাশের মানুষের সহানুভূতি পাওয়ার চেয়ে মেয়েটির কপালে জুটল কেবলই অপবাদ—ওড়নাটি ঠিকমতো গায়ে জড়ায়নি কেন? রিকশার হুড নামিয়ে বসার কী দরকার ছিল? সব কাজের পেছনে মেয়েদেরই দোষ খুঁজে বের করার যে মানসিকতা আমাদের সমাজের মানুষের মনে রয়ে গিয়েছে এখনো, সেটাই এখানে ফুটে উঠেছে।

যুবতী মেয়েটি একদিন পার্কে গিয়েছিল প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে। তখনো তার গায়ে প্রিয় ওড়নাটি জড়ানো ছিল। কিছু দুশ্চরিত্র লোক মেয়েটিকে জোর করে ধর্ষণ করলে তার প্রেমিকও তাকে একলা ফেলে পালিয়ে যায়। এখানেও দেখা যায়, ওড়না মেয়েটিকে ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচাতে পারে না। মেয়েটির প্রেমিককেও ধরে রাখতে পারে না ওড়না। মেয়েদের সতীত্বকে প্রেমের চেয়ে বড় করে দেখে তাদের প্রেমিক পুরুষেরা। ধর্ষিতা মেয়েটি তবুও স্বাভাবিক জীবনে পা বাড়াতে চায়। যে অন্যায়ে তার কোনো দোষ ছিল না, তা মুছে ফেলে আবার বাঁচতে চায়। কিন্তু পারে কি? সমাজের সংস্কার, সম্মান, আচার, ধর্মীয় নীতি সবকিছু এসে মেয়েটিকে শেকলের মতো বেঁধে ফেলে। মেয়েটির দুই হাত, দুই পা, দুই চোখ, নাক-কান-গলা সবকিছু ধিক্কারের প্রবল জ্বালায় পিষে ফেলে মেয়েটিকে। সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য একদিন গায়ে তুলে নিয়েছিল যে ওড়না, আজ সেই ওড়নাই আবার সঙ্গী হয় তার। মেয়েটি ফাঁস নেয় প্রিয় ওড়না গলায় পেঁচিয়ে। যে বাবা একদিন ভাবতেন, শরীর ঠিকমতো ঢেকে রাখে না বলেই মেয়েরা ধর্ষিত হয়, সেই বাবার গগনবিদারী আহাজারিতে দর্শকের চোখে পানি আসে। বাবার চোখে জ্বলে ওঠে প্রতিবাদের আগুন। তিনি মেয়ের মৃত শরীর থেকে ওড়নাটা টেনে নিয়ে ড্রেনে ছুড়ে ফেলে দেন।

নাটকের শেষ দৃশ্যে মৃত মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে জোর গলায় বলে, ‘নো’। এই ‘না’-এর বিভিন্ন রকম অর্থ হতে পারে। ‘না’ মানে হচ্ছে, যেকোনো পরিস্থিতিতে যৌন মিলনকে না বলার অধিকার রাখে একজন নারী। ‘না’ মানে হচ্ছে, এমন পরিণতি চলতে দেওয়া যেতে পারে না। এরপর নাটকের সব অভিনেতা ও অভিনেত্রীর সম্মিলিত কণ্ঠে দর্শকের উদ্দেশে কয়েকটি জোরালো স্লোগান দিয়ে নাটকটি শেষ হয়: ‘Let’s cage your tigers and your bears/ Your ferocious lions and wolves/ But please do not try to cage me./ Because this time round I want to and I will/ Roam free. I will be free.’

নাটকটিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সংলাপের ব্যবহার ছিল খুব সাধারণ। প্রতিদিনের জীবনযাপনে আমরা যেভাবে কথা বলি, এ নাটকের অভিনেতা এবং অভিনেত্রীরা সেভাবেই কথা বলেছেন। মঞ্চে তাঁদের হাঁটাচলা খুব স্বাভাবিক ছিল। সাবলীল অভিনয় দর্শকদের সহজে টেনে নিয়ে গিয়েছে গল্পের ভেতর। মনে হয়েছে, আরে এই দৃশ্য তো আমি জীবনে বহুবার দেখেছি। এমন নোংরা কদর্য উক্তি কত হাজারবার ভেসে এসেছে আমার কানে। আর এভাবে একাত্ম হয়ে মিশে যেতে পারার কারণেই, নাটকের শেষে ধর্ষিতা মেয়েটির শেষ পরিণতিতে চোখে জল এসে গিয়েছে দর্শকের। এমন ঘটনা তো ঘটছেই। কিন্তু ঘটছে বলেই তাকে রুখতে হবে। মেয়েদের গায়ে পরতের পর পরত ওড়নার আচ্ছাদন না জড়িয়ে আমাদের ছেলেদের শেখাতে হবে সংযত হতে। তাদের দৃষ্টি এবং চিন্তার পরিবর্তন করতে হবে। নাটকটির মূল কথা হচ্ছে, ‘পুরুষের লালসাকে বন্দী করো, নারীকে নয়।’

নাট্যকার জেসমিন চৌধুরী অসীম সাহসিকতায় দর্শকদের সামনে এক ঘণ্টার জন্য একটি আয়না ধরে ছিলেন। নাটকে বেশ কিছু গান ব্যবহৃত হয়েছে। গানগুলো নাট্যকার নিজে তৈরি করেছেন বিশেষভাবে এই নাটকের জন্য। শুরুতে রংবেরঙের ওড়না পরা অভিনেতাদের কোরিওগ্রাফিটি ছিল দৃষ্টিনন্দন। নাটকের শুরুতে এবং নাটকের মাঝে মাঝে হারমোনিয়াম ও তবলায় তোলা সুরের কাজ অসাধারণ লেগেছে। ১০ জন অভিনয়কর্মীর কালো পোশাক পরে মঞ্চে অবতরণ দেখে মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা কালো জগতে ঢেউ উঠে যায় অলক্ষে। বুঝতে পারি, একটি কালো অধ্যায়ের গল্প শোনাতে এসেছেন তাঁরা। মঞ্চে দৃশ্য পরিবর্তনে অভিনেতা–অভিনেত্রীরা পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। ছোট্ট টপস, রঙিন শার্ট, টুপি, সানগ্লাস ইত্যাদি পরে একই মানুষ বারবার বদলে ফেলেছেন নিজের রূপ।

দর্শক গ্যালারি থেকে দেখা মঞ্চের বেশির ভাগ জায়গা ব্যবহৃত হয়েছে দক্ষতার সঙ্গে। নাটকে ১০ জন মানুষ ১০টি ছোট টেবিল ব্যবহার করেছেন নাটকের দৃশ্যপট বোঝাতে। এসব টেবিল একবার হয়েছে নর্দমার ড্রেন, একবার রিকশা, দোকান থেকে ঘর আবার ঘর থেকে পার্ক, এভাবে ক্ষুদ্র আয়োজনে নাটকের পটবদলের খেলাটি ভালো লেগেছে। দৃশ্যের সঙ্গে আলোর খেলা বা লাইটিংয়ের পরিবর্তন ছিল দর্শকের মনে প্রভাব ফেলার মতো। মেয়েটি যখন পার্কের কোনায় ধর্ষিত হচ্ছিল, তখন সেখানে লাল আলোর ব্যবহার আমাদের মনেও সতর্কতার লাল আলো জ্বালিয়ে দেয় এই বলে, এসব কামুক, লম্পট পুরুষদের নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে।

শোর দুদিন আগেই সব টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। হলের প্রতিটি আসন দর্শকে পূর্ণ ছিল। অবশ্য লক্ষ করেছি, ৮০ ভাগ দর্শকই নারী। এমন নাটক নারীদের চেয়ে পুরুষদের দেখানো বেশি জরুরি, যদিও নারী দর্শকেরা সরব হওয়ার সাহস নিয়ে ফিরে গেছেন, যা কম কথা নয়।

সব মিলিয়ে আয়না আর্টসের একটি সফল পরিবেশনা ছিল নাটক ‘ওড়না—The Cover’. নাটকটি পরিচালনা করেছেন অপু চৌধুরী। রচয়িতা এবং সহকারী পরিচালক জেসমিন চৌধুরী। অভিনেতা এবং অভিনেত্রীরা প্রত্যেকেই সমান প্রশংসার দাবিদার। ব্যক্তিগতভাবে আমি মুগ্ধ হয়েছি আহসান সুজনের অভিনয়ে। তিনি যে পেশাদার অভিনেতা নন, এ কথা জেনে আশ্চর্য হয়েছি। নাটকটির সঙ্গে জড়িত সবাইকে অনেক অভিনন্দন। আয়না আর্টসের কাছ থেকে এমন আরও পরিবেশনা পাওয়ার অপেক্ষায় থাকলাম।

*লেখক: লুনা রাহনুমা, গল্পকার ও অনুবাদক।