কবিগুরুর জন্মদিনে মা আপনাকে বলছি

কবিগুরুর জন্মদিনে খুব ইচ্ছে করছিল ঘুরে আসি শান্তিনিকেতনে আমার বেড়ে ওঠা কিছু প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের সঙ্গে। আর অবশ্যই প্রকৃতি প্রেম এসেছে কবিগুরুর সৃষ্টি থেকে তাঁদের। একটু ব্যাখ্যা করছি। একটা মেঘলা সকালে ঘুম ভাঙত, ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে/ জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না’ গানের শব্দে।

আম্মি কাজ করছেন কলেজে যাওয়ার আগে আর গাইছেন। স্কুলে যেতে হবে, রেডি হতে হবে কিন্তু আমার মন বলছে, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়।’

অতি দ্রুত নাশতার টেবিলে বসার তাড়া দিতে দিতে মা আমাদের নাশতা রেডি করে কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছেন। কীভাবে সম্ভব সেটা জানি না। নিজেকে রেডি করতেই সময় নিয়ে টানাটানি শুরু হতো। যথারীতি বিরক্ত হয়ে স্কুলের পথে যাত্রা আমার, মনে মনে গজ গজ, এত প্রতিভা নিয়ে জন্মে আয়েশ করে বজরায় বসে বসে এত সুন্দর তাঁর সৃষ্টি আর ‘আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে/ তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে’। স্কুলে পড়াশোনা আর দুষ্টুমি শেষে বাসার পথ ধরলাম আমরা কজন গাইতে গাইতে, ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি, আ হা হা হা, আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি...। বা ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে, ময়ূরের মতো নাচে রে, না...চেরে।

‘হৈমন্তী’ পাঠ্য ছিল আমাদের। মার কাছে হাজারো প্রশ্ন ছিল, ১৭ বছর কীভাবে একটা মেয়ের জন্য অনেক বয়স হয়? কেন মেয়েটিকে বাঁচতে দিলেন না লেখক? মায়ের একটা জবাব, জীবন লড়ে যাওয়ার, সত্য ঘটনা গল্পে উঠে আসবেই, যেটা পড়ে জেনে নিজেকে গড়ে নেবে। জীবন সুখ-দুঃখের মিশ্রণ। সঙ্গে গান, ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন/ আমার ব্যথার পূজা হয় নি সমাপন’।

এখন এ বেলায় এসেও যত উত্থান আর পতনের সব গল্প আমার মাকে বলা তাই। তিনি শোনেন, তারপর বলে দেন, ‘ঠিক আছে, যেটা হয়েছে সেটা নিয়ে না ভেবে তুমি কী করতে পারো জীবনকে সুখী করতে, সেটা ভাবো।’ তিনি তাঁর বাগানের নতুন নতুন ফুল-ফলের গল্প শোনান, কীভাবে বাগান করে ফুল-ফলের রাজ্য তাঁর মনে আনন্দের ঢেউ তোলে সে কথা শোনান, আমি ‘কান পেতে রই’।

ইদানীং প্রকৃতিপ্রেমী হয়েছি। সকালেই ঘুরে এসেছি শান্তিনিকেতন, সাহিত্য সংস্কৃতির মেলবন্ধনের সাক্ষী ভারতের বীরভূম জেলার ছোট্ট এই শহরে। ১৮৮৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম দেন ‘শান্তিনিকেতন’। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন পাঠ ভবন, যেটা ১৯১৩ সালে হয় বিশ্বভারতী মহাবিদ্যালয়। প্রকৃতির মাঝে শিক্ষাগ্রহণ, আছে ছাতিমতলা, মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালারিসহ কত কিছু। ইউটিউবে দেখে পুরোপুরি মন ভরেনি। কোনো এক শীতকালে রবীন্দ্রপ্রেমীদের নিয়ে দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে খুব। আপাতত কন্যার সবুজ পাহাড়ের মধ্যে স্কুল দেখতে যাচ্ছি মা দিবসে। মনে বেজে চলেছে ‘মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ’। ছেলেটা সঙ্গী হলে তো আরও ভালো।

মেয়ের কাছে গিয়ে আজকে মনে মনে গাইব, ‘একটুকু ছোঁওয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি, তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী’। মায়ের জন্য গাইব মনে মনে, ‘এসো আমার ঘরে এসো, আমার ঘরে, বাহির হয়ে এসো, বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে, এসো আমার ঘরে।’

শুভ জন্মদিন কবিগুরু, মা দিবসে পৃথিবীর সব মাকে প্রাণঢালা ভালোবাসা।