করোনাকালে বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতা

টোকিওর রাস্তার পাশের রেস্তোরাঁর ফুড স্যাম্পল, দেখতে একদম আসল খাবারের মতো
ছবি: লেখক

আমাদের স্মার্টফোনগুলো আসলেই অনেক স্মার্ট। কোনো নতুন জায়গায় গেলে সে বুঝতে পারে এবং সেখানকার স্থানীয় সময় ও মানচিত্র দেখাতে শুরু করে। জিনিসের দরদামও দেখায় স্থানীয় মুদ্রায়। ২০২০ সালের শেষ দিকের এক সকালে আমার এন্ড্রয়েড স্মার্টফোনের একটা নোটিফিকেশনে চোখ আটকে গেল। সেখানে লেখা, এই বছর আপনি ২২ হাজার ১১৫ কিলোমিটার ভ্রমণ করেছেন, যা সারা বিশ্বের প্রায় অর্ধেক ভ্রমণের সমান! অবাক হয়ে ভাবলাম আমি তো এই বছর খুব বেশি জায়গায় যাইনি। তাহলে গুগল কেন এ কথা বলছে? পরে ভেবে দেখলাম করোনাকালে যখন সারা পৃথিবী থমকে আছে, বিমান চলাচল প্রায় বন্ধ, অনেক দেশের সীমান্ত দেশি-বিদেশি সবার জন্য বন্ধ ছিল বছরের বেশির ভাগ সময়, সে রকম একটা সময়ে ২২ হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ একটা খবর বইকি। তাই সেই বিষয়ে লিখতে বসেছি। পাঠকদের বলে রাখি এই লেখার দিন-তারিখ, সংখ্যা-পরিমাণ স্মৃতি থেকে লেখা, ক্যালেন্ডার-ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই পুরোনো সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ তাই এখানেও প্রযোজ্য—‘যাদের রসবোধের চেয়ে কৌতূহলবোধ বেশি, তাদের ঠকতে হবে।’

ঘটনার শুরু ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে, যখন অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি শেষ করে সপরিবার সিডনি থেকে ঢাকা ফিরছিলাম। হংকংয়ে আমাদের ট্রানজিট ছিল মাত্র দেড় ঘণ্টা। প্রায় ১০ ঘণ্টা বিমানভ্রমণের ক্লান্তি আর কাঁধে বড় ব্যাগ নিয়ে বিশাল হংকং বিমানবন্দরের এক গেট থেকে আরেক গেটে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছিলাম তখন এক জায়গায় বিমানবন্দর কর্মীদের একজন আমার স্ত্রীর আর ওর কোলে থাকা তিন বছরের বাচ্চার কপালে সাদা রঙের পিস্তলের মতো কিছু একটা ধরল। আমাদের হাঁটা থামাতে হয়নি কারণ মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময়ের মধ্যে ঘটল ঘটনাটা। এখন আপনারা সবাই যানেন যে ওখানে ইনফ্রারেড থার্মোমিটারে ওদের শরীরের তাপমাত্রা মাপা হয়েছিল। কিন্তু ওই সময় যেহেতু করোনা শব্দটা আর ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের সঙ্গে বিশ্ববাসীর ও রকম পরিচয় ছিল না, তাই দেশে পৌঁছেও আমি কয়েকবার ভেবেছি ব্যাপারটা নিয়ে—কী করেছিল ওই লোকটা সেদিন?

টোকিওর রাস্তাঘাট এমনই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন
ছবি: লেখক

২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে মোটামুটি সবাই জেনে গেল যে বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এক অদৃশ্য শত্রু—করোনা বা কোভিড-১৯ যার নাম। তারপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেটাকে মহামারি এবং আরও পরে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করল। বাংলাদেশ অবশ্য অনেক দিন পর্যন্ত গাছাড়া ভাবে ছিল, কারণ অনেকেই ভেবেছিলেন এসব রোগ শুধু তাদেরই হয় যারা টয়লেট করে পানি ব্যবহার করে না। এ রকম নানাবিধ খবর-গুজবের মধ্য দিয়ে জানুয়ারি মাস চলে গেল। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে আমার আবার সিডনি ফেরার কথা। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানে ওঠার সময় একটু খটকা লাগল। ভিড়ভাট্টা খানিকটা কম। এবারও যখন আমি হংকংয়ে ট্রানজিট নিচ্ছিলাম, ওই সাদা পিস্তলসদৃশ বস্তু দিয়ে কয়েকবার তাপমাত্রা মাপা হলো। এয়ারপোর্টে কর্মরত অনেকেরই মুখেই মাস্ক ছিল। আর হাতে গ্লাভস তাঁরা আগে থেকেই ব্যবহার করতেন।

ভালোয় ভালোয় সিডনি পৌঁছে গেলাম। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ম্যাকোয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা। আমি সেখানে আন্তর্জাতিক আইনের ওপর সপ্তাহে দুই দিন তিনটা করে এক সেমিস্টার ক্লাস নেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ ছিলাম। আমি ক্লাসের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। প্রতিটি ক্লাসের আগেই প্রচুর পড়তে হয়, প্রেজেন্টেশন আর কেস স্টাডি তৈরি করতে হয়। ক্লাসে গিয়ে গল্প করে সময় পার করার কোনো উপায় নেই। যথারীতি ক্লাস শুরু হলো। প্রথম দুই সপ্তাহ ভালোভাবেই চলল। তৃতীয় সপ্তাহের শুরু থেকে ক্লাসে ছাত্রসংখ্যা কমতে শুরু করল। আর চারদিকে করোনাকালে নানা রকম প্রস্তুতির কথা শুনতে শুরু করলাম। অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ আর আমেরিকার কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তত দিনে ফেস টু ফেস ক্লাস বন্ধ করে দিয়েছে। এভাবে ১৫ মার্চ চলে এল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তখনো অফিশিয়ালি কিছু জানায়নি। ১৭ মার্চ চতুর্থ সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনের ক্লাসের পরেই জানতে পারলাম সব ক্লাসও এখন অনলাইনে হবে।

ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কানাযাওয়া-হাক্কেই ক্যাম্পাসের প্রবেশপথ
ছবি: লেখক

পরদিন (১৮ মার্চ) আমি ভাবতে বসলাম কী করা যায়। মাত্র এক মাসের কিছু বেশি হলো দেশ থেকে এসেছি, এখনই আবার দেশে ফিরে যাব, নাকি এখানেই থেকে যাব ইত্যাদি। এর মধ্যে খবর পেলাম এই মহামারি বাংলাদেশেও পৌঁছে গেছে। যদিও বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো এর গুরুত্ব অনুধাবন করে একে তখনো অতিমারি বলে ডাকা শুরু করেনি, তথাপি বাংলাদেশ সরকার এদিন করোনাজনিত প্রথম মৃত্যুর কথা ঘোষণা করে। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল যেকোনো মুহূর্তে আন্তর্জাতিক রুটে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার এবং সিঙ্গাপুর এরারলাইনসে পরদিন সকালের ফ্লাইটে টিকিট কনফার্ম করলাম। কারণ আমার পরিবার তখন দেশে আর ক্লাস যেহেতু অনলাইনে হবে তাই আমি খুলনার বাসা থেকেই নিতে পারব।

পরদিন সকাল ১০টার ফ্লাইটে সিডনি থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে ঢাকার উদ্দেশে বিমানে চড়লাম। এবার মানুষ অনেক কম। অন্য সময়ের তুলনায় প্রায় অর্ধেক যাত্রী। সবার মুখে মাস্ক, হাতে স্যানিটাইজার। আপনাদের মনে থাকবে মার্চের মাঝামাঝি ইতালিফেরত যাত্রীদের কোয়ারেন্টিন করা নিয়ে কী একটা যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়েছিল। তাই ঢাকায় বিমানবন্দের নামার পর আমাকে নিয়ে কী করা হবে, সেটা ভেবে বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। পরে দেখলাম অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা মেপে হোম কোয়ারেন্টিন দিয়ে ছেড়ে দিল। কারণ, অস্ট্রেলিয়ায় তখনো করোনা রোগীর সংখ্যা খুবই কম ছিল।

সিঙ্গাপুরে ট্রানজিট ৩ ঘণ্টা। চেঙ্গি এয়ারপোর্টের সেই চিরচেনা ব্যস্ততার মধ্যে কোথাও যেন একটা শঙ্কার ছাপ ছিল। আর সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকা ফেরার বিমানে উঠে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলাম। ২৫০ যাত্রী ধারণক্ষমতার বিমানে আমরা সব মিলে ৩৫-৪০ জন ছিলাম। দৃশ্যটা অবিশ্বাস্য লাগল। কিন্তু কে জানত করোনা–উত্তর পৃথিবীতে বিমানভ্রমণ এ রকমই হতে যাচ্ছে!
ঢাকাতে একদিন থেকে পরদিন সকালে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে আমার যশোরে ফেরার টিকিট কাটা ছিল। বিমানবন্দরে কাছে একটা হোটেলে রাত কাটিয়ে সকালে উঠে শুলনাম অস্ট্রেলিয়ার সরকার সীমান্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। সুতরাং অস্ট্রেলিয়ায় সাধারণ বাণিজ্যিক বিমান আর ঢুকতে পারবে না। আর ঢুকতে না পারলে বের হবে কীভাবে?

বাসার টপফ্লোর থেকে দেখা মাউন্ট ফুজি
ছবি: লেখক

পরদিন আমি যশোর হয়ে নির্বিঘ্নে খুলনা পৌঁছে যাই। বাসায় আলাদা একটা কক্ষে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন করি। খুলনায় পৌঁছানোর পরদিন সকালে জানতে পারলাম বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সব অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। আমার মনে হলো এই প্রথম বেবিচক তার সুবিবেচনার পরিচয় দিল। আর আমি আল্লাহর রহমতে দু–দুবার আটকা পড়ার হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেলাম।

খুলনায় বসে অনলাইনে আমার ক্লাসগুলো নিচ্ছিলাম আর পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলাম। বাইরে যাওয়া প্রায় বন্ধ। দেখতে দেখতে দুই মাস চলে গেল। ড. সেব্রিনা ফ্লোরা তত দিনে তারকাখ্যাতি পেয়ে গেছেন। আমার কোর্সের ক্লাসও প্রায় শেষ হয়ে এল। রোজা আর ঈদ উদ্‌যাপন করলাম একরকম ঘরে বসেই। হঠাৎ একদিন শুনলাম ঢাকার অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশন বাংলাদেশে আটকে পড়া অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক আর স্থায়ী ভিসাধারীদের সে দেশে ফেরাতে বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করেছে। ইতিমধ্যে দুটি বিমানে পাঁচ শর মতো যাত্রী সেখানে ফিরতে পেরেছেন আর ৩ নম্বর বিমানটা যাবে জুনের মাঝামাঝি। আমরা তখন অস্ট্রেলিয়া ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আর ওই বিশেষ বিমানে ভ্রমণের জন্য রেজিস্ট্রেশন করলাম। পরে জানানো হলো শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনসের বিমানটি আমাদের ঢাকা থেকে কলম্বো হয়ে মেলবোর্ন নিয়ে যাবে, যেখানে একটি হোটেলে আমাদের কোয়ারেন্টিন করতে হবে। আমরা নির্ধারিত দিনে বিমান ছাড়ার ৫ ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। এ রকমই জানানো হয়েছিল আমাদের। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তত দিনে একটা ভিন্ন চেহারা নিয়ে নিয়েছে। ওই দিন ওই সময় অস্ট্রেলিয়া ছাড়া মাত্র আরেকটি গন্তব্যের উদ্দেশে বিমান ছেড়ে যাচ্ছিল। সেটাও ছিল একটা বিশেষ বিমান। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনের কর্মকর্তারা কাগজপত্র দেখেশুনে আমাদের বিমানে ওঠার অনুমতি দিল।

কলোম্বোয় ট্রানজিট ছিল মাত্র ১ ঘণ্টা। এখানে আমরা একটা বিমান থেকে নেমে আরেকটা বিমানে উঠলাম। এর মাঝে আমাদের সবার দুহাতে, জুতায় এবং হাতব্যাগে জীবাণুনাশক ছিটিয়ে দেওয়া হলো। কলম্বো থেকে মেলবোর্ন ১০ ঘণ্টার ফ্লাইট। শুধু খাওয়ার সময় ছাড়া বাকি সময় সবাই মাস্ক পরে ছিল। আর সবার মনের মধ্যে ছিল এক অজানা আশঙ্কা। তখনো বিমানভ্রমণে করোনা নেগেটিভ সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়নি। মেলবোর্নে নামার পর কয়েকজনের ছোট ছোট দলে ভাগ করে বিশেষ বাসে উঠিয়ে হোটেলে নিয়ে আসা হলো। হোটেলে আমাদের একটা কাগজে সই করতে বলা হলো যেখানে লেখা ছিল আগামী ১৪ দিন আমরা স্বেচ্ছায় এখানে আটক থাকতে সম্মত আছি। পাঁচ তারকা সেই হোটেলে আমাদের তিন বেলা হালাল খাবার সরবরাহ করা হতো। আর সপ্তাহে একদিন ২০ মিনিটের ফ্রেস এয়ার ব্রেক ছিল, যা নিতে চাইলে আগে থেকে জানাতে হতো, আর তিনজন নিরাপত্তারক্ষী আমাদের তিনজনকে ২০ মিনিটের জন্য হোটেলের নিচের খোলা জায়গায় নিয়ে ছেড়ে দিত। আমরা ওখানে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আবার রুমে ফিরে আসতাম। তবে সবচেয়ে স্বস্তির ব্যাপার ছিল এই যে ওই ১৪ দিনের থাকাখাওয়ার সব খরচ অস্ট্রেলিয়া সরকার বহন করেছিল।

কোয়ারেন্টিনের দুই সপ্তাহে আমাদের দুবার কোভিড পরীক্ষা করা হল। প্রতিবার নেগেটিভ হওয়ায় ১৪তম দিনে আমাদের যার যার আসল গন্তব্যে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। আমরা ওই দিন সন্ধ্যায় মেলবোর্ন থেকে সিডনির ট্রেনে চেপে বসলাম আর পরদিন সকালে সিডনি পৌঁছে গেলাম।

সিডনির বিখ্যাত বন্দাই সৈকত
ছবি: লেখক

এখানেই শেষ হতে পারত আমার করোনাকালের বিদেশভ্রমণের গল্প। কিন্তু তা হলো না। সিডনি পৌঁছানোর কয়েক দিন পরেই আমাকে জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় দুই বছরের জন্য সেখানে পোস্টডক্টরাল গবেষণার আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দিল। তার মানে আবার ব্যাগ গুছিয়ে জাপানের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার পালা। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমার যাওয়ার দিন ঠিক হলো। কিন্তু ভিসাসহ নানা জটিলতায় সেটা দেড় মাস পিছিয়ে গেল। এর মধ্যে আমাকে অস্ট্রেলিয়া সরকারের কাছ থেকে বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি নিতে হলো। এবারের ভ্রমণে বুঝতে পারলাম আগামী দিনে বিদেশভ্রমণ কত কঠিন হতে যাচ্ছে।

জাপানের ইমিগ্রেশন বিভাগ থেকে জানানো হলো আমাদের সবার কোভিড নেগেটিভ সনদ লাগবে এবং কোভিড পরীক্ষাটি করতে হবে ফ্লাইট ছাড়ার আগের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে। আর জাপানের বিমানবন্দরে নামার পর আমাদের আবার কোভিড পরীক্ষা করা হবে। যদি সবার করোনা নেগেটিভ হয় তবেই আমাদের হোম কোয়ারেন্টিনের জন্য ছাড়া হবে। আর পজিটিভ হলে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন করতে হবে। ভ্রমণের দিন বিশ্বের ব্যস্ততম বিমানবন্দরগুলোর একটা সিডনি বিমানবন্দরকে ধু ধু মরুভূমি বলে মনে হচ্ছিল। অল নিপ্পন এয়ারলাইনসের বিশাল বিমানে সব মিলে আমরা ৩০-৩৫ জন যাত্রী ছিলাম। শুধু খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া সবার মুখে মাস্ক ছিল।

হানেদা বিমানবন্দরের পরীক্ষায় আমাদের সবার করোনা নেগেটিভ আসল আর আমরা ছাড়া পেয়ে বিশেষ ট্যাক্সিতে করে টোকিওতে ভাড়া করা বাসায় এসে উঠলাম। ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টিনে আমাদের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়া ও রেস্তোরাঁয় খাওয়া নিষেধ ছিল, আর জনসমাগমস্থল এড়িয়ে চলতে বলা হল। কোয়ারেন্টিন শেষ হওয়ার পর আমরা আরও কিছুদিন টোকিওতে ছিলাম। পরে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ইয়োকোহামাতে চলে আসি। ইয়োকোহামা টোকিওর কাছের একটা শহর, ট্রেনে মাত্র ১ ঘণ্টার দূরত্ব। কিন্তু টোকিওর ব্যস্ততা আর কোলাহল থেকে অনেকটাই মুক্ত। এখানে আসার কিছুদিন পরে জানতে পারলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় এক শতাব্দী আগে তার জাপান ভ্রমণকালে এই ইয়োকোহামা শহরে এসে কয়েক মাস ছিলেন। এটা জানার পর থেকে শহরটাকে আগের থেকে বেশি ভালো লাগছে।

আপাতত এখানেই শেষ হলো আমার করোনাকালের বিদেশভ্রণের গল্প। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন এই লেখার শিরোনামটা অনেকখানি অতিরঞ্জিত। ঢাকা-মেলবোর্ন-সিডনি-টোকিও-ইয়োকোহামা ভ্রমণকে বিশ্বভ্রমণ বলা চলে না কিছুতেই। আসলে কোভিডকালীন হোম অফিসের চাপে পিষ্ট অনলাইনে ব্যস্ত পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য এটুকু ছলনা করতেই হলো। আশা করি, বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

  • লেখক: আব্দুল্লাহ আল আরিফ, শিক্ষক ও গবেষক, পোস্টডক্টলার ফেলো, ইয়োকোহামা-সিটি ইউনিভার্সিটি, ইয়োকোহামা, জাপান