করোনাকালে যমজ সন্তান

নিকিউ তিত, এটা তাঁর আসল নাম নয়। স্ত্রীসহ বাস কেপটাউনে। স্ত্রী প্রথম সন্তানসম্ভবা। মাঝে ম্যাটারনিটি হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন তিনি একসঙ্গে দুটি পুত্রসন্তানের মা হবেন। আট মাস পর হঠাৎ অসুস্থ হলেন তিতের স্ত্রী। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, সঙ্গে কাশি। করোনা বছরে এমন হলে তো করোনা ছাড়া আর কী ভাবা যেতে পারে?

সারা রাত দুজনের বিন্দুমাত্র ঘুম নেই। তা ছাড়া দেখভাল করার মতো আর দ্বিতীয় কেউ নেই। অসহায় চিন্তাতে রাত একটু দীর্ঘই হয়, পাখি ডাকে না, সকাল আসে না।

সকাল হতেই স্ত্রীকে নিজ গাড়িতে করে ম্যাটারনিটি হাসপাতালে নিয়ে গেলেন তিত। সেখানে ডাক্তার পর্যবেক্ষণ করে রোগীকে দ্রুত স্থানান্তর করলেন কেপটাউনের বড় হাসপাতালে। গ্রোথি সোকার, সরকারি হাসপাতাল, পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, লম্বা লম্বা বিল্ডিং, পরিষ্কারকরণে কোনো ঘাটতি নেই, সেকশনের কোনো অন্ত নেই, এককথায় সুন্দর।

রোগীর অবস্থা দেখে যেখানে করোনা ভেবে ডাক্তারদের পিছু হটার কথা, সেখানে উল্টো ঝাঁপিয়ে পড়লেন রোগের চিকিৎসার জন্য। শ্বাসকষ্টের এতটাই সমস্যা হচ্ছিল যে রোগীকে বাঁচানো নিয়ে ডাক্তার সন্দিহান হচ্ছিলেন। পেটে দুটি বাচ্চা। অথচ পেটে ব্যথা নেই, শ্বাসকষ্ট প্রচুর।

বাচ্চাদের ঝুঁকি না নিয়ে দ্রুত সিজারের সিদ্ধান্ত নিলেন ডাক্তার। অন্তত বাচ্চা দুটো বেঁচে থাক, এটাই ছিল চিন্তা। কারণ, এ দেশে গর্ভে থাকা শিশু বাঁচানো অতীব একটি জরুরি বিষয়।

অস্ত্রোপচার হলো, ফুটফুটে দুটি সন্তান দুনিয়ায় এল। মায়ের দুধ পেল না, মায়ের কোল পেল না। তারা এক প্রান্তে, মা অন্য প্রান্তে। বাচ্চাদের একুশ দিন আইসিইউতে রাখা হবে বলে ডাক্তারের সিদ্ধান্ত।

মাকে নিয়ে যাওয়া হলো অন্য আইসিইউতে। কৃত্রিম অক্সিজেন চলছে। নিজের কোনো মানুষ নেই, তিত পর্যন্ত নয়। সেখানে সাধারণত যাওয়া নিষিদ্ধ। অতি প্রয়োজনীয় মনে হলে স্বয়ং ডাক্তার বা নার্স ফোনে যোগাযোগ করছেন তিতের সঙ্গে।

করোনা টেস্টে নেগেটিভ এসেছে। ফুসফুসে, পাকস্থলী ও কিডনিতে সমস্যা। মুখ দিয়ে পাইপ দেওয়া হয়েছে পেট পর্যন্ত। খাবার, নিশ্বাস সবই পাইপ দিয়ে। হাসপাতালের খাবার ছাড়া অন্য কোনো খাবার নয়।

চিকিৎসা করতে কত টাকা লাগবে, কে দেবে এসব নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। রোগী হাসপাতালের বারান্দায় পৌঁছেছে, দায়দায়িত্ব ডাক্তারের, এটাই এখানে আসল কথা। নেই নেতা, নেই দালাল, নেই টেস্ট–বাণিজ্য, নেই ধনী–গরিব, নেই আত্মীয়পরিচয়, নেই কোনো অহংকার, নেই কোনো লোভ–লালসা।

২১ দিন পর তিতের স্ত্রী ভালো হলেন। ঠিক তার সপ্তাহখানেক আগে ঝুঁকিমুক্ত হলে ডাক্তারের সিদ্ধান্তে আইসিইউ থেকে কেবিনে আনা হয়। এত দিনেও হাসপাতালের খাবার চলছে। শেষ পর্যন্ত তা–ই চলবে। বাইরের খাবার নিষিদ্ধ।

কেবিনে পরবর্তী চিকিৎসা চলছে। সঠিক সময়ে নিয়মিত ডাক্তার আসছেন যেমন ঠিক তেমনি নিয়ম করে নার্স আসেন। খাবারের ত্রুটি নেই, নিয়ম মেনে নিয়মিত হাজির। এটা তার নিয়মিত রুটিন হলো, হয়ে গেলেন অভ্যস্ত।

দুই দিন পর হঠাৎ ইংরেজিতে লেখা একটি ফরম এল তাঁর কাছে। ফরমের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, ‘এত দিনে তুমি আমাদের অধীনে চিকিৎসারত ছিলে। তুমি যদি আমাদের চিকিৎসায় সন্তুষ্ট না হও অথবা আমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকে তবে এখানে নির্ভয়ে লেখো। আর যদি সন্তুষ্ট থাকো তাহলে, প্লিজ এখানে সই করে দাও।’

খরচ নিয়ে কোনো কথা হয়নি। মাত্র ৬৫ টাকা খরচ! কারণ, রোগী নিজের কোনো ইনকাম নেই। সুতরাং, সব দায়দায়িত্ব সরকার বহন করে। পাবলিক সার্ভিস কারে কয়? এটাই তো পাবলিক সার্ভিস। জনগণের রাষ্ট্রীয় কর দেওয়ার উপকারিতা তো এখানেই। এখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। দেখে মনে হয়, রোগীরাই তাঁদের বস।

লেখা এখানেই শেষ করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু হয়নি। কারণ, ঘটনা মোড় নিয়েছে। যেদিন তিত তার পরিবার ডাক্তারের ছাড়পত্রের মাধ্যমে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আসবেন ঠিক তার আগের দিন ফোন এল, তাঁর স্ত্রীর আবারও হার্টের সমস্যা দেখা দিয়েছে। সুতরাং আরও এক সপ্তাহ থাকতে হবে। ডাক্তারের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া হলো। এখানে রোগী সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স, ওষুধ, খাবারদাবার কেউই অসুস্থ হয় না।

সুস্থ হওয়ার পর এখন সবাই তিতের নিজস্ব বাসায়। সত্যি সেবার মান, এদের ব্যবহার ও সিস্টেমের প্রশংসা করতেই হয়। কোনো ধরনের লোলুপ মনমানসিকতা এদের মধ্যে দেখা যায় না।

তবে এটা সত্য যে, এই মহামারি করোনাকালে যেকোনো ধরনের রোগীকে একটু বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। যে অভিজ্ঞতা তিত ও তিতের স্ত্রী অর্জন করেছেন। সুখে থাক তাদের টুইন সন্তান।