করোনার টিকা নিয়ে কিছু কথা, টিকা নেওয়ার পর কী কী হয়

আমি কাজ করি আমেরিকার সান ডিয়েগো শহরের একটা হাসপাতালে। মার্চ মাস থেকেই কোভিড–১৯–এর সঙ্গে যুদ্ধ করছি আমরা। কিন্তু গত দুই মাস সবচেয়ে খারাপ অবস্থা যাচ্ছে আমাদের। অসম্ভব অসুস্থ কোভিড রোগী, প্রায়ই হিমশিম খেতে হচ্ছে জায়গা দিতে তিনটা হাসপাতালে। রোগীর তুলনায় ডাক্তার, নার্স থেকে শুরু করে সব স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কম। অল্প বয়স থেকে শুরু করে বেশি বয়সী রোগীদের মৃত্যুর মিছিল। কিছু আশার আলো হয়ে এসেছে টিকা। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, তবু এসেছে তো। এত মাসের মতো ঢাল–তলোয়ার ছাড়া আর যুদ্ধ করতে হবে না। সভ্যতার নতুন দিগন্তে আমরা।

কোভিড–১৯ হওয়ার পর যাঁদের সিরিয়াস ইনফেকশন হয়েছে, তাঁদের ২১ দিন সিম্পটম শুরু থেকে আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বাকিদের জন্য ১০ দিনে কমিয়ে আনা হয়েছে আইসোলেশন সিডিসির গাইডলাইন অনুযায়ী। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এরপরও ভাইরাস ছড়াতে পারেন তাঁরা তিন মাস পর্যন্ত কিন্তু সে ভাইরাস দিয়ে অন্য মানুষের ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা নেই।

আমি পেয়েছি ফাইজার-বায়োএনটেক কোম্পানির টিকা, যেটা ১৬ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষদের দেওয়া হচ্ছে। ২টি ডোজ, তিন সপ্তাহের ব্যবধানে। প্রথম ডোজের দুই সপ্তাহ পরে শতকরা ৫০-৫৬ ভাগ ইমিউনিটি আর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার ২৮ দিন পর মোটামুটি শতকরা ৯৫ ভাগ ইমিউনিটি পাব আমরা। আমার পুত্র আর কন্যা পেয়েছে মডার্না কোম্পানির টিকা, যেটা ১৮ বা তার বেশি বয়সের মানুষকে দেওয়া হচ্ছে। যে হাসপাতালে আমি কাজ করি, সে হাসপাতালে তারা ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করে বলে এ টিকা পাওয়ার সৌভাগ্য তাদের হয়েছে। টিকার দ্বিতীয় ডোজ পাবে তারা ২৮ দিন পর। শতকরা ৯৪ ভাগ ইমিউনিটি পাবে তারা কোভিড–১৯–এর বিরুদ্ধে।

কোনো টিকাতেই ডিম/জিলাটিন/লেটেক্স/প্রিজারভেটিভ নেই। ১ জন প্রতি ৯০ হাজারে সিভিয়ার অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশনে (এনাফাইলেকটিক রিঅ্যাকশন) অসুস্থ হয়েছেন এ ইনজেকশন নেওয়ার পর। সিডিসি (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের) হিসাবমতে, ডিসেম্বরের ১৪-২১ তারিখের মধ্যে মাত্র ১১.১টা কেস পাওয়া গেছে ১ মিলিয়ন মানুষকে এ টিকা দেওয়ার পর, ৭১ শতাংশ হয়েছে টিকা দেওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যেই। দম বন্ধ হয়ে আসা বা শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, প্রেশার কমে যাওয়া ইত্যাদি হয়েছে। তবে টিকা দেওয়ার পর ১৫ মিনিট সবাইকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে এ দেশে।

যাঁদের সিভিয়ার অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশনের হিস্ট্রি আছে, তাঁদের এই ইনজেকশন নেওয়ার আগে অ্যালার্জি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

কিন্তু এ রোগে মৃত্যুহার সে তুলনায় অনেক বেশি। সুতরাং সুযোগ পাওয়ামাত্র এই টিকা নিয়ে নেওয়া উচিত।

টিকা নেওয়ার পর কী কী হয়

সাধারণ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এই টিকায় আছে। টিকার জায়গায় ব্যথা, লাল হয়ে ফুলে যাওয়া, জ্বর বা জ্বর জ্বর ভাব, মাথাব্যথা, দুর্বল লাগা, শরীরব্যথা, যা খুব বেশি দিন স্থায়ী হয় না। মডার্না টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে ২১ ডিসেম্বর থেকে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া একই রকম। কোভিড–১৯ ইনফেকশন হওয়ার পরও এ টিকা দিতে বলা হচ্ছে, তবে বলা হচ্ছে এ ইনফেকশন হওয়ার তিন মাসের মধ্যে আবার ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা কম, সুতরাং তিন মাস দেরি করা যেতে পারে কিন্তু লক্ষণ সেরে গেলেই এই টিকা নেওয়া যেতে পারে। আপাতত দুটি ডোজের বেশি না এবং দুই কোম্পানির টিকার যেকোনো একটা বেছে নিতে বলা হচ্ছে। শুধু যাঁরা অ্যান্টিবডি ট্রিটমেন্ট নিয়েছেন, তাঁদের তিন মাস পরে এ টিকা নিতে বলা হচ্ছে। টাইলেনল (এসিটোমিনোফেন/প্যারাসিটামল) খেতে বলা হয়েছে যদি এ রকম লক্ষণ হয় ১-৩ দিনের মধ্যে এবং লক্ষণ শুরুর ১-৩ দিনের মধ্যে এটা চলে যায়।
বাংলাদেশ অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকা টিকা পাবে ২৫ জানুয়ারির মধ্য ভারতের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ‘সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া’ থেকে। এ জন্য বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালের মাধ্যমে চুক্তি হয়েছে। প্রথম ফেজে ৫ মিলিয়ন ডোজ পাবে আমার দেশ। এ টিকা ৩০ ডিসেম্বর অনুমোদন পেয়েছে ইউকের ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রামে। আর এই বছরের ৪ জানুয়ারি থেকে দেওয়া শুরু হয়েছে ইউকেতে। এই টিকা পাচ্ছেন ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষ, দুটি ডোজ, এক মাসের ব্যবধানে দিতে হবে। টিকার জায়গায় ব্যথা, ফুলে যাওয়া বা লাল হয়ে যাওয়া কমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। সিভিয়ার অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। প্রায় ৭০ শতাংশ ইমিউনিটি দেবে এ টিকা। এ টিকা সাধারণ রেফ্রিজারেটর তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়।

সিডিসি গাইডলাইন অনুযায়ী

ফেজ ১–এ টিকা পাচ্ছেন হেলথ কেয়ার পারসোনাল আর নার্সিংহোমের বাসিন্দারা (প্রথমেই যাঁরা পেয়েছেন)।
ফেজ ২ বি–তে পাচ্ছেন ৭৫ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষ এবং যাঁরা কাজকর্ম করছেন আবশ্যিকভাবে ফ্রন্ট লাইনে।
এখন পাবেন ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষ, যাঁদের ডায়াবেটিস বা অন্য কোনো রোগের কারণে ইমিউনিটি কম।
আমাদের দেশেও এ রকম ম্যাথডিক্যালভাবে টিকা দেওয়া শুরু হবে আশা করছি। কোভিড–১৯ কোনো বয়স মানছে না। টিকা যখনই পাবেন, নিয়ে নিন সবাই। একটা সুস্থ পৃথিবীর আশায় দিন গুনছি আমরা।