করোনার থাবায় আচমকা হারাল আপনজন

৫ জুন, খুব ভোরবেলা ঘুমটা হঠাৎ করেই ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার পরপরই মনে পড়ে গেল, আজ থেকে বরাবর দুমাস আগে ৫ এপ্রিল মোনাক্কা ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদটি পেয়েছিলাম ছোট একটি বার্তার মাধ্যমে, ‘ছোট মামা আর নেই’, উনার ভাগনে জানিয়েছিল। বার্তাটি দেখে অবিশ্বাস্য ঠেকেছিল, যেমন আজও লাগে।

মার্চ মাসের শুরু থেকেই আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত হয় বাংলাদেশ। প্রতিদিনই বাড়ছিল আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। সারাক্ষণ একটা দুশ্চিন্তা নিয়ে থাকতে হতো, আমাদের আপনজন কে, কখন, কীভাবে জীবনঘাতী এ ভাইরাসের ছোবলে পড়ে! প্রায় দেড় বছর হতে চলল, সারা বিশ্বে করোনা তার তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে, যার কাছে গোটা মানবজাতি অসহায়। প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আমরা আক্রান্ত ও মৃত্যুর হালনাগাদ পেয়ে থাকি। সেগুলো একসময় নিছকই সংখ্যা মনে হতো। সংবাদগুলো অবশ্যই দুশ্চিন্তাদায়ক ও পীড়াদায়ক, কিন্তু ততটা আত্মস্থ হতো না। কারণ, তখন পর্যন্ত নিজে বা নিজের কেউ আক্রান্ত হয়নি। আপাতদৃষ্টিতে স্বার্থপর মনে হলেও কথাটা সত্যি যে যতক্ষণ নিজের ওপরে না কিছু বর্তায়, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ কোনো কিছু সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে না।

এ দুশ্চিন্তার মধ্যেই গত মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে জানতে পারলাম, ঢাকায় আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই করোনায় আক্রান্ত। বাসায় আমার শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-ননদের স্বামী ও তাঁদের দুই ছেলেসহ ছয় সদস্যের বসবাস। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ও মোনাক্কা ভাইকে (ননদের স্বামী) হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। শাশুড়ি হাসপাতালের ছাড়পত্র পাওয়ার পর, খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা আশা করছিলাম, শিগগিরই বাকি দুজন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন। কিন্তু এত বড় দুঃসংবাদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। শাশুড়ি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও আমার শ্বশুর ও মোনাক্কা ভাই প্রায় এক মাস করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করে সব ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতি ও সবার আপ্রাণ চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ৫ এপ্রিল মোনাক্কা ভাই ও ১৩ এপ্রিল আমার শ্বশুর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন পরপারে।

প্রথম মৃত্যুসংবাদটি ছিল অচিন্তনীয়। সদা উৎফুল্ল, ফুর্তিবাজ, বন্ধুপরায়ণ, প্রাণবন্ত, তারুণ্যে উচ্ছ্বসিত, কর্মোদ্যমী, সদাব্যস্ত তরতাজা মানুষটি একনিমেষে লাশ হয়ে গেল! এ কী করে সম্ভব! মুহূর্তেই শত শত স্মৃতি মনের জানালায় উঁকি দিতে লাগল। এই তো সেদিনের কথা, আমাদের বিমানবন্দরে ছেড়ে গেলেন। মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, করোনার বাধ্যবাধকতার কারণে বিমানবন্দরে ভেতরে ঢুকতে পারেননি। খানিকটা অতৃপ্তি নিয়েই বিদায় জানালেন। ওই সময় উনার চিন্তার অন্ত ছিল না যে এ করোনার ভয়াবহতার মধ্যে আমি একা দুই মেয়েকে নিয়ে আমেরিকায় যাচ্ছি। তিনি মানুষটাই ছিলেন এমন যে সংসারের বাকি সবার চিন্তা তাঁর নিজের একার এবং সবার সবকিছু তাঁর নিজ হস্তে, নিজ দায়িত্বে করতে হবে। আর এসব করতেই উনি আনন্দ পেতেন। আমরা দেশে গেলে বিমানবন্দরে রিসিভ করা থেকে শুরু করে দেশে থাকা সম্পূর্ণ সময়টা খেয়াল রাখতেন। আবার ফিরে আসার সময় আর কেউ বিমানবন্দরে যাক বা না যাক, মোনাক্কা ভাই থাকতেন, আমাদের বিদায় জানাতে। আমরা যেহেতু দেশের বাইরে থাকি, এ কারণে দেশে গেলে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন আমাদের দেশি বিভিন্ন মৌসুমি ফল বা সবজি, দই-মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য; যেসব আমরা বিদেশের মাটিতে সচরাচর পাই না।

একদিন তো ১৯টি ইলিশ মাছ এনে ডাকাডাকি! কখনো শীতের সন্ধ্যায় গরম-গরম ভাপা পিঠা বা চিতই পিঠা নিয়ে হাজির। সবার খুঁটিনাটি সব বিষয়ে খেয়াল রাখার এক অনবদ্য মানসিকতা ছিল। যেকোনো পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠান, তা ছোট হোক আর বড় হোক, নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতেন। কাউকে কিছু নিয়ে বেগ পেতে হতো না। সবচেয়ে বড় বিষয়, মোনাক্কা ভাই এমন একজন ব্যক্তি, যিনি খুব সহজে বড়-ছোট সবার সঙ্গে মিশে যেতেন, যাঁকে সবাই ভালোবাসতেন। তিনি নিজের অজান্তেই সবার অন্তরে একটা জায়গা করে নিয়েছিলেন। ওনার মৃত্যুর পর তা আরও প্রকটভাবে সামনে এসেছে। আমার বিয়ের পর থেকেই মোনাক্কা ভাইয়ের সঙ্গে সখ্য ছিল। সব সময় দায়িত্ব নিয়ে বড় ভাইস্বরূপ আচরণ করতেন। এবার দেশে গিয়ে আমাদের সেই সখ্য আরও কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল। বুঝতেই পারিনি এত তাড়াতাড়ি মানুষটা জীবনের সব লেনদেন চুকিয়ে দেবেন, থেমে যাবে সব হাঁকডাক। সবার ভালোবাসায় সিক্ত মানুষটি আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন আরও অনেক যুগ। এরপর যখন দেশে যাব, তখন দেশের মাটিতে পা দিয়েই নিজেদের অজান্তেই খুঁজতে থাকব সেই মুখ, আর স্মৃতির আয়নায় ভেসে উঠবে মোনাক্কা ভাইয়ের প্রতিচ্ছবি!

শ্বশুরকে ‘বাবা’ ডাকতাম। শেষ কথা যেদিন হয়েছিল, ঠিক কথা বলা যাবে না উনি শুধু আমাদের নাম অস্থির কণ্ঠে বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করে গেলেন। আর কিছু বলেননি, আমাদেরও কিছু বলতে দেননি। সেই ডাক আমার কানে এখনো স্পষ্ট বাজতে থাকে।

এমনভাবে ডেকেছিলেন যেন আর কোনো দিন ডাকতে পারবেন না, হয়েছেও তাই, বুঝতে পারিনি। বিয়ের পর বেশ কিছু বছর আমার শ্বশুরবাড়িতে কেটেছে। আমেরিকা আসার পর প্রতিবছরেই দেশে গিয়েছি ও লম্বা সময় থাকতাম। সে কারণে এত দূরে থেকেও শ্বশুরবাড়ি থেকে নিজেদের কখনো বিচ্ছিন্ন মনে হতো না। সম্প্রতি দেশে গিয়ে পুরো একটা বছর সবার সঙ্গে থেকে এসেছি, যা জীবনের একটি বড় পাওয়া। আমাদের বাড়িতে আমার শ্বশুর যেদিন প্রথম আমাকে দেখতে এসেছিলেন, সেদিন থেকেই আমার উনার প্রতি শ্রদ্ধা জন্মেছিল। বিয়ের পর শ্বশুর-বউয়ের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। প্রথম দিকে বউমা বলে ডাকতেন, পরে নাম ধরেই ডেকেছেন।

লিখতে গিয়ে একটা মজার স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আমার বিয়ের পর বিকেলের নাশতার জন্য খুব শখ করে প্রথমবার সবজি পাকোড়া বানাতে গেলাম। গরম-গরম পাকোড়া ভাজা হচ্ছিল। সবাই টেবিলে বসে খাচ্ছিল। ভাজতে গিয়ে খেয়াল করলাম আমার আঙুলের আংটিটা নেই। তড়িঘড়ি করে রান্নাঘর ও নিজ ঘরে খুঁজতে শুরু করলাম। বুয়া জিজ্ঞেস করছিল, ‘ভাবি, আপনে কী খুঁজছেন?’ আমি কিছু না বলে চুপ করে ছিলাম। টেবিলে বসা সবাই বুঝতেছিল আমি অস্থির হয়ে কিছু একটা খুঁজছি। আমার এঘর-ওঘর করা দেখে একপর্যায়ে আমার শ্বশুর বলে উঠলেন, ‘বউমা, আর খোঁজাখুঁজি কোরো না, তুমি যা খুঁজছ তা জিয়ার (আমার স্বামী) কাছে!’ একটু লজ্জা পেলাম। আংটিটা ঢিলে হওয়ায় কারণে খুব সহজেই পাকোড়া মাখানোর সময় খুলে পড়েছিল। আংটিসহ ভাজা পাকোড়াটি জিয়ার ভাগ্যেই জুটেছিল! ভাগ্যিস দাঁত ভাঙেনি।

বাবা আমাকে খুবই ভালোবাসতেন, সবকিছু নিয়েই প্রশংসার সুরে কথা বলতেন। ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ছিলেন। একদিন কোনো এক কথার সূত্রপাতে আমাকে বললেন, ‘আমার ব্যাংকারের চোখ, আমি প্রথম দেখেই বুঝেছিলাম খুব ভালো মেয়ে হবে।’ অথচ আমাদের নিজেদের পছন্দের বিয়ে। কিন্তু তিনি এভাবে সব কৃতিত্ব নিয়েছিলেন যেন উনি নিজে পছন্দ করে আমাকে ছেলের বউ করে এনেছেন। খুব ভালো লেগেছিল সেদিন, এক =ধরনের পূর্ণতা অনুভব করেছিলাম।

ঢাকার বাসায় আমাদের ওপরের তলায় এক খালাম্মা ছিলেন, বছর তিনেক আগে মারা গেছেন। দেখা হলেই বলতেন, ‘তোমার শ্বশুর-শাশুড়ি তোমার এত প্রশংসা করে, তুমি অনেক গুণবতী মেয়ে।’ এ ধরনের কথায় আমি খুবই লজ্জা পেতাম, সেই সঙ্গে গর্ববোধ করতাম। আমি জানি না কেন উনারা আমাকে এত আপন করে নিয়েছিলেন। তেমন কিছু তো করা হয়নি, সেবা করারও সুযোগ পায়নি, শুধু আপন করে নিয়েছিলাম। প্রতি সপ্তাহান্তে দেশে নিয়ম করে ফোন দিতাম, মাঝেমধ্যে মনে হতো কেন আরও বেশি করে ফোন দিই না, কিন্তু সংসারের ব্যস্ততায় সপ্তাহ নিমেষে কেটে যেত। এ ফোন দেওয়া দুই পক্ষেরই একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল, এর কোনো ব্যত্যয় ঘটতো না।

শনিবারেই বেশি দেশে ফোন দেওয়া হতো। কোনো দিন যদি শনিবার থেকে রোববার হয়ে যেত, তাহলে আমার শ্বশুর অস্থির হয়ে পড়তেন। শাশুড়িকে বলতেন, ‘সাথি তো আজ ফোন দিল না।’ ফোন দিতেই আমার শাশুড়ি ওপার থেকে বলে উঠতেন, ‘তোমার ফোন না পেয়ে তোমার শ্বশুর অস্থির হয়ে যাচ্ছে।’...আজ আর এই ফোন খেলা খেলতে হয় না, কেউ আর অপেক্ষা করেন না, বাবার মধুর কথাগুলো আর শুনতে পাই না।
রোববার বাবা দিবস। বাবা দিবস, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীতে ফোন দিলে বাবা বলতেন, ‘তোমাদের এসব দিবস আমাদের মনে থাকে না, কিন্তু তোমরা মনে করে ফোন দাও, এটা-সেটা পাঠাও, শুভেচ্ছা জানাও, তা খুব ভালো লাগে।’ আমাদের গ্রামের বাড়ি বাবা খুব পছন্দ করতেন। বেশ কয়েকবার বাবাকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছি। শেষবার যখন গিয়েছিলেন, তখন আমার আব্বাকে বলেছিলেন, আর হয়তো আসা হবে না আপনাদের গ্রামের বাড়িতে, এবার আপনারা আসেন। নিছকই একটা কথা ধরে নিয়েছিলাম, গভীরতা বুঝতে পারিনি। আমার শ্বশুর একটা নতুন বাড়ি বানাচ্ছিলেন, তা নিয়ে বেশ খুশি ছিলেন, আব্বাকে আগাম দাওয়াতও দিয়ে রেখেছিলেন!

যখন দেশে ছিলাম, তখন বিকেলে চায়ের আড্ডাতে আমার শ্বশুর উনার জীবনের গল্পের ঝুলি নিয়ে বসতেন। জমানো অনেক না–বলা কথা নির্দ্বিধায় মনখুলে বলতেন, যেন তার আপন মেয়ের সঙ্গে কথা বলছেন। আমাদের আড্ডায় আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আর আমি থাকতাম। আজ ভীষণভাবে মিস করছি সেই আড্ডা! কথা ছিল আমাদের স্বপ্নের বাড়ির খোলা বারান্দায় বসে আবার এমন তুমুল আড্ডা হবে সংসারের আর বাকি সবাই মিলে। সে আর হলো না, আমাদের চরম ফাঁকি দিয়ে না–ফেরার দেশে চলে গেলেন দুজন মানুষ চিরতরের জন্য। সবকিছুই হচ্ছে ও হবে, কিন্তু মানুষগুলোই আর বেঁচে থাকল না। আমাদেরও কোনো কিছু থেমে নেই, জীবন চলছে জীবনের নিয়মে। এভাবে চলতে-ফিরতে যখন হঠাৎ করে মনে হয় আমাদের স্নেহ করার, ভালো কিছু বলার, আগলে ধরে রাখার মানুষগুলো আর নেই, তখন বুকটা হুহু করে কেঁদে উঠে, প্রচণ্ড শূন্যতা ভর করে। মহান আল্লাহ তাআলা উনাদের বেহেশত নসিব করুন।

আমাদের সবাইকে একদিন পৃথিবী ছেড়ে যেতে হবে। অসময়ে কারও মৃত্যু আমরা কেউ কামনা করি না। তাই যে আপনজনগুলো এখনো বেঁচে আছেন, তাঁদের প্রতি ও নিজেদের প্রতি আরও যত্নশীল হতে হবে। জীবন থেকে এমন শিক্ষা পেয়েছি যে এখন সুযোগ পেলেই শাশুড়ি ও নিজের আব্বা-আম্মা, ভাই-বোনকে ফোন দিই। কোনো কিছু আর হাতছাড়া করতে চাই না। চোখের নিমেষে এ সুন্দর জীবন ফুরিয়ে যাবে!

বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতি দেখলে কেউ বলবে না দেশে করোনা নামক কোনো ভাইরাস আছে। করোনার ব্যাপারে দয়া করে সবাই সতর্ক হোন। গাফিলতি না করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, মাস্ক পরুন। নিজে সুস্থ থাকুন সেই সঙ্গে নিজের পরিবার-পরিজন সবাইকে সুস্থ থাকার সুযোগ করে দিন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই বিপদ থেকে মুক্তিদান করুন।

*লেখক: সুরাইয়া সিদ্দিকী, ডালাস, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র