করোনায় মাস্কের আত্মকথন

আবুল খায়ের যখন ব্যাটারির সমস্যায় হিমশিম খেতেন, আমার তখন হাসি পেত। আমার নাম মাস্ক। দুনিয়ার মানুষ আমার নাম জানত না। এর চেয়ে বড় হিমশিম আর কী হতে পারে? আমি অচল বস্তু। আমার অতীত ইতিহাস বেদনাদায়ক।

ইংরেজিতে একটি কথা আছে। Day comes after night and Night comes after day. সব সময় মানুষের এক রকম যায় না। সময় ঘোরে। ঠিক তা–ই। ইতিহাস এখন আমার। আমার এখন পূর্ণ যৌবন।

‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’। তেমন কেউ ডেকে কাছে নেয়নি। যারা ডেকেছে, তারাও যেখানে–সেখানে ফেলে রেখেছে আমাকে। আদর পাইনি অতীতে। ডাক্তারের অস্ত্রোপচার করার সময় শুনেছি অস্ত্রের ঝনঝনানি। মেডিসিন গবেষণায় ওষুধের গন্ধে বমি এসে যেত। এই মুষ্টিমেয় কিছু জায়গাতে ছিল আমার ওঠা–বসা।

জন্মের পরে বসে থাকতাম একটি বদ্ধ রুমে। গান গাইতে ইচ্ছা করত, ‘আমি বন্দী কারাগারে, আছি মা বিপদে’। এমন কোটি কোটি মানুষ আছে, যারা কোনো দিন আমার চেহারা দেখেনি, যারে চোখেই দেখেনি, তার তো গল্পও হয় না। তাকে ভালোবাসা যায় কী করে? আর ব্যবহার তো দূরের কথা।

গত থার্টি ফার্স্ট নিউ ইয়ার, হ্যাপি নিউ ইয়ার ড্যান্সিং দিয়ে কত ঘনঘটা করে ২০২০ সালকে স্বাগত জানাল। কিন্তু তাদের সেই আনন্দকে ধূলিসাৎ করে আমি এমন আনন্দে উদ্বেলিত হব, তা তো নিজেও কখ‌নো ভাবিনি। সব ড্যান্স থেমে গেছে, গায়কের গান নেই। সবাই এখন আমাকে ঠোঁটে লাগিয়ে চুমু দিচ্ছে।

করোনাকে কেউ স্বাগত না জানালেও আমি কিন্তু মহাখুশি। বিশ্বের রাজা–বাদশা, মন্ত্রী, সচিবেরা পর্যন্ত এখন আমার ঘ্রাণ নিচ্ছে। আমি মাস্ক, কে না আমায় চেনে? এখন কেউ বলে না, ‘চেনাচেনা লাগে, তবু অচেনা’। সবাই গাইছে, ‘চিনেছি চিনেছি তোমারই মন’। তবে আমি প্রতিনিয়ত গাচ্ছি, ‘নাম ধরে কে যেন ডাকে আমারে’।

যখন শুনি সরকারপ্রধান আমাকে বাধ্যতামূলক করেছে, তখন তো আমি মাস্ক আহ্লাদে গদগদ হই। শিওর শিওর ওভার শিওর হয়ে যাই যে আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর ভালোবাসা পাচ্ছি।

প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আমাকে তৈরি করতে মহা ব্যস্ত। খুব বেশি ব্যবহার হতাম না। মেশিনগুলো জং জং অবস্থায় দেখা যেত। কিন্তু এখন অনেক যত্ন হয় সেগুলো। আমি এখন ছুটে চলেছি, এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। শুধু কি রানার ছুটে চলে? মাস্কও ছুটে চলে। আমি তো এখন পারিবারিকভাবেও তৈরি হচ্ছি।

আমি মাস্ক। এই মহা দুর্যোগে আমি মানুষকে সুস্থ রাখতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখে চলেছি, তাতে আমি অহংকারিত। আমাকে সঙ্গে না নিয়ে কেউ কোথাও যেতে পারে না। দোকানে, বাসে, মলে, বাজারে, অফিসে, কাজে–কর্মে যেখানেই যে যাক, আমাকে সঙ্গে না নিলে ধাক্কা একটা নিতেই হয়। নিজেকে আর বলা লাগে না, ‘যেয়ো না সাথি’, বরং তারাই বলে, ‘আয় খুকু আয়’।

‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’–এর মতো আমিও কত রঙে রঙেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বহু রঙের হয়েছি আমি। নীল, সাদা, কালো, চকরাবকরা—আরও কত।

মানুষের দুই কান ধরে যখন ঝুলে থাকি, তখন চিলে কান নেবে সে চিন্তা কারও আর থাকে না। মাস্টারমশায়ের মতো কান মলে লাল করতে থাকি সারাক্ষণ, তবু কেউ উহ্‌–আহ্‌ শব্দ করে না।

‘এত সুখ সইব কী করে’! মহামারির চিন্তা মাথায় এলে নিঝুম রাতেও ঘুম আসে না। সালাম সালাম হাজার সালাম দিতে পারি না এই মহামারিকে। মানুষের মৃত্যুতে এভাবে আমি চলতে পারি না। কারও নেশায় পরিণত হতে চাই না। এই নেশার লাটিম ঝিম ধরুক। মানুষ, আবার তোরা মানুষ হ।