কীভাবে আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সার্বক্ষণিক বজায় রাখতে পারি?

রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বড়করিমপুর গ্রামে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে শেষ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ঘরবাড়ি
ফাইল ছবি

এমন বাংলাদেশ চাই না, যেখানে ধর্মের দোহাই দিয়ে উগ্রতার পদতলে চলে যাবে মানবতা, সভ্যতা ও বিবেক। মুসলিম হলাম, হিন্দু হলাম, বৌদ্ধ হলাম, খ্রিষ্টান—আর মানুষ হতে ভুলে গেলাম! এমন বাংলাদেশ চাইনি এবং চাইও না।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে কমে আসছে। আর এ কারণেই আজ একদল অশুভ শক্তির দ্বারা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে যেকোনো অজুহাতে একের পর এক সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীরা হামলার শিকার হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ বিচারহীনতা। দৈনিক প্রথম আলোর চিঠিপত্র ও মতামত (১৯ অক্টোবর ২০২১) থেকে নিচের লেখাগুলোতে স্পষ্ট:  ‘বিচার না হলে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এভাবে হামলার শিকার হতে থাকবে।’ লিয়াকত হোসেন।

‘শারদীয় দুর্গাপূজায় কুমিল্লায় যা শুরু হয়েছিল, তাতে আগুনের হলকা যুক্ত হলো রংপুরে। একের পর এক চৌমুহনী, হাজীগঞ্জ, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুরসহ চট্টগ্রাম বিভাগীয় বেল্ট থেকে তা লাফিয়ে গিয়ে পড়ল রংপুরের পীরগঞ্জের দরিদ্র জেলেপল্লিতে। ১৭ তারিখ রাতে সেখানকার একটি গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আজ সেখানে সর্বস্ব হারানো, নির্যাতিত ও অপমানিত মানুষের আহাজারি শোনা যাচ্ছে। সবার মনেই প্রশ্ন, প্রশাসন কোথায় গেল?’ (ফারুক ওয়াসিফ)
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সরকার, তথা প্রশাসন চাইলে কোনো দাঙ্গাই চলতে পারে না। সরকার বা প্রশাসন খুব ভালোভাবেই জানে, কোন কোন সময়ে এবং কোন পরিস্থিতিতে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়। সরকারি প্রশাসনযন্ত্র সারা দেশে বিস্তৃত।

সুতরাং, এসব দাঙ্গা রোধ না করতে পারার পেছনে কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি থাকতে পারে না। চাই সরকারের দৃঢ় ইচ্ছা ও কঠোর ব্যবস্থাপনা, তথা কঠোর আইনের শাসন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সার্বক্ষণিক বজায় রাখতে সরকারের দৃঢ় ইচ্ছা ও কঠোর আইনের শাসনের কোনো বিকল্প নেই।

শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও প্রচারণা

সরকারের দৃঢ় ইচ্ছা ও কঠোর ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সমান্তরালভাবে প্রাথমিক থেকে হাইস্কুল-মাদ্রাসা সর্বস্তরে সাম্প্রদায়িক সচেতনতা শিক্ষা দিতে হবে। যেখানে ‘সবার উপর মানুষ সত্য’ অগ্রাধিকার পাবে। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে উল্লেখযোগ্য রেফারেন্স অবশ্যই থাকতে হবে।

বিশ্ব জনসংখ্যা ও মুসলিম ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী

এবার আমি, বিশেষভাবে আমার মুসলিম ভাইবোনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিশ্ব জনসংখ্যা ও মুসলিম ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর বসবাস সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। ২০২০ বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, আমাদের বর্তমান বিশ্বে জনসংখ্যা প্রায় ৮ বিলিয়ন। এর মধ্যে প্রায় ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন মুসলিম। ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন মুসলিমদের মধ্যে মাত্র ১৫৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন মুসলিম (এবং ১৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন সংখ্যালঘু) জনসংখ্যা বাংলাদেশে বসবাস করেন। ৪০০ মিলিয়ন মুসলিম জনসংখ্যা বসবাস করেন বিশ্বের ১৮০টি দেশে, যেখানে তারা সংখ্যালঘু। এখন একবার ভাবুন, ১৮০টি দেশের ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী যদি ৪০০ মিলিয়ন মুসলিম ভাইবোনদের নিরাপত্তা না দেয়, যেখানে হয়তো আপনারই কোনো আপনজন বসবাস করছেন, তখন আপনার মনের অবস্থা কেমন হবে?

আমাদের অবশ্যই ১৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন সংখ্যালঘু ভাইবোনের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস নিশ্চিত করে সঠিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তাদের জানমাল-ইজ্জত রক্ষা করা আমাদের সবার পবিত্র দায়িত্ব।

আমরা জানি, বিশ্বের অন্য দেশেও সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতি অত্যাচার-অবিচার করা হয়েছে এবং হচ্ছে। তা কিন্তু আমাকে বা আপনাকে কোনো অধিকার দেয়নি, আমাদের দেশে বসবাসকারী অন্য ধর্মে বিশ্বাসী ভাইবোনদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার। আর তা যদি আমরা করি, তা হবে গুরুতর অপরাধ। ভাবুন, ১৮০টি দেশের ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর দেশে বসবাসকারী ৪০০ মিলিয়ন মুসলিম ভাইবোনের কথা।

দুই একটি দেশের খারাপ উদাহরণ যেন আমাদের কোনোভাবেই প্রভাবিত না করে।
আসুন আমরা সবাই যার যার ধর্মমুক্ত মনে ও মুক্ত প্রাণে পালন করি। আসুন আমরা সবাই সব ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গের ভেদাভেদ ভুলে সব মানুষের জন্য একযোগে কাজ করি। সব মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করি এবং সামনের দিকে, তথা অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাই। এখানেই আমাদের মঙ্গল ও সফলতা।

*লেখক: আশরাফ রহিম, ডালাস, টেক্সাস, আমেরিকা। [email protected]