কোভিড এবং শিখা

করোনাকালের প্রতীকী ছবি
প্রথম আলো

আজ অনেক দিন পরে সকালে হাঁটতে বের হয়েছিলাম, বেশ অনেক দিন পরে। কোভিডকাল অনেক বদলে দিয়েছে জীবন, অনেকটাই বদলে গেছে নিয়ম—আমার বদলেছে সকালটা, এই শহরে গত ১৪ বছরের অভ্যাস, ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাওয়ার তাড়া থাকে সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন, কিন্তু গত ছয় মাসে করোনা বদলে দিল সেই রুটিন, ঘুম থেকে উঠে এখন সপ্তাহে ৪ দিন বসি নিজের ঘরেই পড়ার টেবিলে ল্যাপটপ নিয়ে, বিছানা আর পড়ার টেবিলের দূরত্ব দুই হাত মাত্র, এভাবেই বদলে গেছে সকালে বের হওয়ার অভ্যাস, জানি না সামনে কী দিন আছে।

ইদানীং বাড়ি থাকতে থাকতে এমন হয়েছে যে বাইরে বের হলে, মুক্ত আকাশ দেখলে মনে হয় আহ কত দিন পর খোলা দুনিয়া দেখছি। আজকে সকালে নিজের বাসার চারপাশজুড়ে যে বড় বড় মাঠ আর সবুজ দিয়ে ঘিরে থাকা আবাসিক এলাকা আছে, সেখানে থেকে ফিরে বসলাম লিখতে। কী লিখি? এমন ভাবনাও মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে অনেক সময়, এই ঘরবন্দী জীবনে কটতুটুই-বা বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে টানাপোড়েন থাকে যে নানা রসদ নিয়ে লিখতে বসব?

গতকাল অনেক দিন পর গিয়েছিলাম একটা দোভাষীর অ্যাসাইনমেন্টে। প্রায় ৭ মাস পর দোভাষীর ‘ফেস টু ফেস’ কাজ দিতে শুরু করেছে। রেগুলার জব কষ্টিতে ছুটি চলছে এই সপ্তাহজুড়ে, তাই খুশি মনেই দোভাষীর কাজ করতে গেলাম, একদম শহরের পূর্ব দিকে বাসা থেকে মোট দেড় ঘণ্টার পথ, বাস/সাবওয়ে ধরে পৌঁছে গেলাম, ‘জেন আর ওলনার’ অ্যাভিনিউতে, বৃহত্তর টরন্টো শহরের ভীষণ পুরোনো এলাকা ওই সব দিকটা।

পথেই ভাবছিলাম, এই বাঙালি লোকালয় ছেড়ে ওই অত দূরে কোনো বাংলাদেশি পরিবার বাস করে? কী তাদের সমস্যা? স্বামী-স্ত্রীর কতটুকু গন্ডগোল যে এই কোভিডকালেও চিলড্রেন এইড সোসাইটি (সিএএস) জড়িত হয়েছে? একটা দোভাষীর কাজে বেসিক কিছু তথ্য আমরা পাই, কিন্তু পুরো চিত্রটা বোঝার জন্য কাজ শুরু করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। বাস থেকে নেমেই স্মৃতিতে স্পষ্ট ধরা পড়ল, এখানে এই অ্যাপার্টমেন্টেই ২০১৭ সালে একবার এসেছিলাম, একই পরিবার নাকি আজও? শিখার বাসার সদর দরজায় যখন আমি আর নিকি ঢুকছি তখনই ‘মন’ বলে উঠল, এ সেই এক বাসা, এক ঘটনা।

শিখাকে ওর স্বামী বাংলাদেশ থেকে স্পনসর করে নিয়ে এসেছে বছর পাঁচেক আগে। বিয়ে হয়েছে ১২ বছর আগে, এক মেয়ে, এক ছেলে, ছেলের বয়স ১০, মেয়ের বয়স ৮। চিলড্রেন এইড সোসাইটি (সিএএস) বাচ্চাদের নিরাপত্তার জন্য নর্থ আমেরিকাজুড়ে কাজ করে। ‘সিএএস’ কর্মী গত তিন বছরের ফাইল ক্লোজ করতে চায়, তাই তারা শিখার সঙ্গে শেষবার ভিজিট করতে এসেছে, কিন্তু শিখা চায় ‘সিএএস’ যেন কেস বন্ধ না করে, কারণ শিখার স্বামী রাসেল প্রায়ই শিখার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, বাচ্চাদের সামনে শিখাকে গালিগালাজ করে, আবার দু-একবার গায়ে হাত তোলে, গত তিন বছরের অভিজ্ঞতায় শিখা বুঝতে পেরেছে, যদি ‘সিএএস’ স্টাফ জড়িত থাকে তাহলে রাসেল একটু সমঝে চলে। কিন্তু ‘সিএএস’ স্টাফ নিকি বলছে এভাবে একজন মানুষকে দূর থেকে মনিটর করার দায়িত্ব তারা নিতে পারে না। কারণ প্রতিটা স্টাফকে অনেক বেতন দিয়ে কাজ অফার করতে হয়, শিখা ও রাসেল যেন নিজেরা-নিজেদের ভালো থাকার জন্য পরিকল্পনা করে।

করোনাকালের জীবনগাথা
ছবি: প্রতীকী

এ জটিল যৌগিক অঙ্কের সমাধান কোথায়? শিখার আরও দাবি, গত ৫ বছর হতে চলছে সে এ শহরে আছে কিন্তু সে কিছুই জানে না, চাকরি, ইংলিশ, নিজের জীবন চালানো, বাচ্চাদের বড় করা, এমনকি বাচ্চাদের যদি সামান্য অসুখ হয় তাহলেও রাসেলই তার ভরসা, তাহলে শিখা এ চক্র থেকে কী করে বের হবে? নিকি যেন তাকে ‘স্বাবলম্বী’ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু নিকি বলছে, দেখো, আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে দিতে পারি, কিন্তু আমি কি নিজে তোমাকে ‘স্বাবলম্বী’ করে দিতে পারি? তোমাকেই তোমার জীবনের জন্য চেষ্টা করতে হবে, এই চেষ্টা কেউ করে দিতে পারে না। অন্যদিকে শিখা বলছে, বাচ্চাদের আমি আর রাসেল মিলে খুব ভালোভাবে বড় করতে চাই। কিন্তু বাচ্চারা তো আমাদের এই মারামারি দেখে বড় হচ্ছে, এটা বাচ্চাদের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলছে। নিকি, তুমি রাসেলকে বুঝিয়ে বল।

করোনাকালের জীবনগাথা
ফাইল ছবি

এই ডিম আগে না মুরগি আগে—এ তর্ক ৩ বছর আগেই দেখেছিলাম। গতকালও সেই একই তর্ক জিইয়ে রেখেই শিখার বাসা থেকে নিকির সঙ্গে বের হলাম, কী সমাধান এই পথের? হাজারো পরিবার যে এ অবাক করা সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, জীবন বয়ে যাচ্ছে। নিকির কথা অনুযায়ী—শোন শিখা, তোমরা যা করছ, বাচ্চারা তাই করবে, তুমি–রাসেল যা করছ, তোমার দুই বাচ্চা সেই একই জীবনেরই অংশীদার হবে, ওদের পারিবারিক জীবনেও ওরা মারামারি আর হানাহানিকে বরণ করবে বা সহজ করে দেখবে, এই সত্য তুমি কেন মেনে নিতে পারছ না? তুমি বারবার বাচ্চাকে পুঁজি করছ, কারণ তুমি নিজেই বাঁচতে জানো না বলে বাচ্চাকে আঁকড়ে ধরে এই জীবন বেছে নিয়েছ।

এসব ‘বস্তা-পচা’ কথা আমি গত ১৪ বছরে অনেকবার বলেছি। অনেকভাবে বলেছি, বলতেই হয়েছে কারণ আমারও আর অন্য কোনো কথা নেই, আমার প্রতিদিনের কাজ জুড়ে থাকে এসব ঘটনা–কাহিনি—কী করে অন্য কথা লিখি, সেই তরিকাও তো জানা নেই। কেবলই একটা প্রশ্ন অবিরত মনকে আলোড়িত করে রাখে, এই একটা মাত্র জীবন পাই আমরা। কার সঙ্গে কতটুকু বোঝাপড়া করে এই জীবনকে বয়ে নিয়ে বেড়াই, তার সঠিক সুতো মনে হয় কেউই মন খুলে বলতে পারি না কোনো দিন। কিন্তু এ–ও সত্য এই একটাই জীবনের সব হিসাব মেলানোর জন্য যে বিপুল আয়োজন নিত্য করে ফিরি, যে অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রাণান্ত পথ শিখারা বেছে নেয়, সেখানেও কি শেষ বিকেলে হিসাব মেলে? ঘুঘু ডাকা নীরব সকাল–দুপুর বা গভীর রাত আমার চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

ফিরতি পথে শহর দেখতে দেখতে ফিরে আসি নিজের ডেরায়। নিজেকে বলতে থাকি, তবুও কী ভীষণ প্রাপ্তিযোগ, অপরূপ এই পৃথিবীর রূপ/রস/গন্ধ দুচোখ মেলে দেখতে পারছি, পাশাপাশি জীবনের অসীম হাহাকার এখনো আমাকে ভাবিয়ে তোলে, এই বা কম কি?

*লেখক: লুনা শীরিন, কানাডা